শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর। বাবার পিছন না ছাড়ায় এমন একটি সুযোগ পেয়েছিলাম।
আনুষ্ঠানিকভাবে কনে দেখার দিন তারিখ আজ মনে করতে পারছি না, তবে সঠিক তারিখ মনে না থাকলেও মাসের নামসহ ঘটনাগুলো মনে আছে। বাংলা তেরোশ' পঁচাত্তুর সাল, মাসটি ছিল পৌষ মাস। দুপুরের দিকে আমি এবং বাবাসহ প্রায় সাত আটজন মেয়ের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। বাড়ির সামনে বিশাল উঠান। উঠানের পশ্চিম পার্শ্বেই এক সারিতে বড় বড় চারটি টিনের ঘর। ভিতর বাড়ির উত্তর এবং পশ্চিম পার্শ্বে আরো টিনটি টিনের ঘর। দক্ষিণ পার্শ্বে গোয়াল ঘর ও খানকা ঘর। বাহির বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে বিশাল বিশাল তিনটি খড়ের গাদা।
কনের বাবারা দুই ভাই। দুই ভাইয়ের চারটি স্ত্রী। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনীসহ ২৫/২৬ জনের সংসার। কনে হলো বড় ভাইয়ের বড় স্ত্রীর সাত সন্তানের মধ্যে সব চেয়ে ছোট। বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হাট বাজারের মত। ছোটদের চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটি আর বড়দের হাউকাউ কথার চোটে সবসময় গমগম করে। খড়ের গাদা, বাড়ির সাইজ আর লোক সংখ্যা অনুযায়ী বড়সর গৃহস্থ বাড়িই বলা চলে।
বাড়িতে পৌছার সাথে সাথেই দুইজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে ছালাম দিয়ে সবার হাতে হাত মিলালেন। হাত মিলানো হলে আমাদেরকে সাথে নিয়ে সামনের সারির মাঝখানের একটি ঘরে বসতে দিল। লম্বা টিনের ঘর। পুরো ঘরে কোন পার্টিশন নেই। ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত মাটির মেঝেতে ধানের খড় বিছিয়ে তার উপরে নক্সি কাঁথা বিছানো আছে। আমরা ছেলে পক্ষের আটজন মাঝামাঝি বসলাম। মেয়ে পক্ষের কয়েক জন লোক আগে থেকেই বসা ছিল। বর পক্ষের লোকজনের মধ্যে আমিই ছোট বাকি সবাই বয়স্ক। দুপুরের খাওয়া খেতে খেতে প্রায় বিকাল হয়েছিল। কনে দেখা উপলক্ষে মেয়ের বাড়িতে যে খাবারগুলো দিয়েছিল তার অনেকটাই এখনো মনে আছে।
ঘরটি ছিল পশ্চিম দুয়ারী। খাবারের জন্য আমরা পশ্চিম মুখ করে বসলাম। আমরা ছাড়াও মেয়ে পক্ষের লোকজন বসেছে। সম্ভাবত তারা ঝি জামাই, বেয়াই টেয়াই হবে। ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫/২৬ জন লোক। প্রত্যেকের সামনে একটি করে থালা দেয়া হলো। থালা দেয়ার পর একজন কাসার বদনা দিয়ে থালার ভিতর পানি ঢেলে হাত ধুয়ে দিল। আরেকজন থালার পানি একটি বালতিতে ঢেলে থালা ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। ধোয়া হাতে থালা সামনে নিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষ করছি, এমন সময় একজন মুখ ছড়ানো একটি মাটির নতুন হাঁড়ি নিয়ে হাজির। এর আগে কখনও এরকম অনুষ্ঠানে খাওয়ার সৌভাগ্য না হওয়ায় হাঁড়ির ভিতর কি আছে বুঝতে পারি নাই। যখন হাঁড়ি থেকে প্রত্যেকের পাতে পাতে দু’টি করে গোল গোল দিয়ে গেল তখন বুঝতে পারলাম এগুলো মুড়ির মোয়া। মুড়ির মোয়া কড়মড় করে খেতে না খেতেই আরেকজনে চিড়ার মোয়া দিয়ে গেল, আরেকজনে কাউনের মোয়া, তিলের মোয়া, খইয়ের মোয়া, চাউল ভাজার মোয়া এমনি করে এক এক করে প্রায় সাত আট প্রকারের মোয়া দিয়ে যাওয়ার পরে নিয়ে এলো নারকেলের কুলি পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, চিতই পিঠা, সব শেষে দিল দুধে ভিজানো রসের পিঠা।
মোয়া আর পিঠা খেয়েই আমার পেট ভরে গেল কিন্তু তখনও অর্ধেক আইটেম বাকি ছিল। পিঠা খেতে না খেতেই নিয়ে এলো চাউলের পায়েস, কাউনের পায়েস। আখের গুড় আর গাভীর খাঁটি দুধে তৈরী পায়েস, আহা! কি যে মজা হয়েছিল তা বলে বুঝানো যাবে না। এখনও অনেক পায়েস খাই কিন্তু সেই দিনের মত অত স্বাদের পায়েস আর পাই না। যাই হোক, সেই স্বাদের পায়েস আমার পক্ষে এক থালার বেশি খাওয়া সম্ভব হলো না কিন্তু আমি খেতে না পরলে কি হবে অনেকেই সেই পায়েস দুই তিন থালা করে খেতে লাগল। বিশাল এক গামলা ভরে পায়েস নিয়ে এসেছিল। দুই তিন থালা করে পায়েস খাওয়ার পরও গামলার পায়েস শেষ হলো না। আধা গামলা পায়েস তখনও ছিল। পায়েস ওয়ালা বলল, আপনারা কি পায়েস আরো নিবেন না ফেরৎ নিয়া যামু?
যাদের পেট ভরেছে তাদের অনেকেই বলল, অনেক খাইছি, আর লাগবো না, ফেরৎ নিয়া যান।
মেয়ে পক্ষের এক বৃদ্ধ বলে উঠল, কি খাইলেন আপনারা? এক গামলা পায়েসের আধা গামলাই বেশি হইল? আপনাদের মধ্যে মনে হয় পায়েস খাওয়ার লোক নাই?
বৃদ্ধের এমন খোঁচা মারা কথায় ছেলে পক্ষের এক বৃদ্ধের মনে হয় আঁতে ঘা লাগল। তিনি বলে উঠলেন, আধা গামলা পায়েস ফেরৎ নিতে যহন আপনাদের আপত্তি তহন আর ফেরৎ নেওনের দরকার কি? নিয়া আইসেন চেষ্টা কইরা দেখি খাওয়া যায় কিনা।
আমার যত টুকু মনে পড়ে সেই আধা গামলা মানে বর্তমানের দশ প্লেটের কম নয়। যে বৃদ্ধটি পায়েস ফেরৎ আনতে বলল তার পাশে আরো দুইজন বৃদ্ধ বসা ছিল, একজনে পায়েস ফেরৎ আনতে বললেও তারা তিন জনে মিলেই খেতে লাগল এবং মুহুর্তেই আধা গামলা সাবার করে ফেলল। তাদের খাওয়ার কথা মনে হলে আজও আমার চোখ কপালে উঠে যায়। বৃদ্ধদের পায়েস খাওয়ার নমুনা দেখে আমি আশ্চার্য হয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আমার মত অনেকেই তাদের পায়েস খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পরে শুনেছিলাম ঐ বৃদ্ধকে পাল্লাপাল্লি করে পায়েস খাওয়ার জন্যই দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। বৃদ্ধদের পায়েস খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাকি সবাই হাত গুটিয়েই বসে থাকলাম।
তিন খাদোকের পায়েস খাওয়া শেষ হতে না হতেই বাঁশের তৈরী ঝাকা ভরে ভাত নিয়ে এলো। থালা ভর্তি করে ভাত দিয়ে গেল। আমার সামনে টিনের থালা আর বুড়োদের সামনে কাসার থালা। কাসার থালাগুলি সাইজে এত বড় ছিল যে থালা ভরতে সেই সময়ের মাপে কমপক্ষে আধা সের চাউলের ভাত লাগত। সেই থালা ভর্তি করেই ভাত দিয়ে গেল।
ভাত দেয়ার পরপরই একজনে পাতের কিনারে একটু করে লবন দিয়ে গেল, লবন দেয়ার পরপরই আরেকজন কাসার চামুচ দিয়ে আলু ভাজি দিয়ে গেল। যতটুকু মনে পড়ে নতুন দেশি আলূ চিকন চিকন সুতার মত করে কাটা। মুখের মধ্যে দিলে চিবাতে হয় না এমনিই মিলিয়ে যায়। সেই আলু ভাজির স্বাদের কথা কি আর বলবো। আজো সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে।
এরপর দিয়ে গেল গোল গোল করে ভাজা বেগুন ভাজি, লাউ ভাজি, মিস্টি কুমড়ার ফুল ভাজি, কয়েক প্রকারের শাক একত্র করে শাক ভাজি। শাক ভাজির কথা কি আর বলবো, হেলাঞ্চা শাক, বতুয়া শাক, পুন্যনাপা শাক, খুদিয়ামন শাক, এইরকম সাত প্রকারের শাক একত্র করে নাকি এই শাক ভাজা হয়েছিল। ঐ বয়সে আমি বাড়িতে খুব একটা শাক খেতাম না। কিন্তু কনের বাড়ির ঐ শাক আমার কাছে এত মজা লেগেছিল যে পুরো শাক খেয়ে বাবার পাত থেকে আরো একটু নিয়েছিলাম। সেই শাকের মজা বলে বুঝাতে পারবো না।
পরবর্তীতে শুনেছি ঐ শাকের মধ্যে নাকি অল্প পরিমাণ দুর্বা ঘাসও দেয়া ছিল। দুর্বাঘাস দেয়ার কারণ এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে যতটুকু জেনেছি শাকের ভিতর দুর্বা ঘাস দেয়াটা ছিল সেই সময়ে গ্রামের কুসংস্কারের অংশ।
শাকসব্জির ভাজি খাওয়া শেষ করতে না করতেই নিয়ে এলো কই মাছের ভাজি, রুই মাছের ভাজি (নলা জাতীয় রুই মাছ), বড় বড় পুঁটি মাছের ভাজি। এইরকম প্রায় আট নয় প্রকারের ভাজি দেয়ার পরে এলো মুরগীর মাংসের ভুনা। ভুনা মাংস খাওয়া শেষ হতে না হতেই আলু দিয়ে মাংসের তরকারী। মাংস খাওয়ার পরে এলো মাসকালাইর ডাল। আমি ভুনা মাংস খেয়েই খাওয়া শেষ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম কিন্তু এত কিছু খাওয়ার পরেও ঐ তিন বুড়ো কমপক্ষে আধা গামলা ডাল চুমুক দিয়ে খেলেন। ভাত খাওয়ার পর মনে করেছিলাম খাওয়া বুঝি এখানেই শেষ কিন্তু হাত ধুতে চাইলে নিষেধ করল। চেটে খাওয়া থালায় আরো একটু ভাত দিয়ে গেল, ভাত দেয়ার পরপরই গরম গরম দুধ ঢেলে দিল। দুধের পরিমান একেবারে কম নয়। আমার থালে যে পরিমাণ দিয়েছে তাতে আধা শের না হলেও এক পোয়া তো হবে। ভরা পেটে খুব কষ্টে দুধ ভাত খাওয়া শেষ করলাম। বুড়োগুলো এত খাওয়ার পরও দুধ ভাত খেতে কৃপণতা করলেন না। কম করে হলেও এক দেড় সের করে খেয়ে নিল। তাদের খাবার দেখে হা করে তাকিয়ে ছিলাম। আহারে খাওয়ারে! তারা একজনে যে খাবার খেলেন বর্তমানে দশজনেও এ খাবার খেতে পারবে কিনা সন্দেহ! সেকালের খাওয়ার কথা এখন শুধু স্মৃতি।
দাদীর কাছে গল্প শুনেছি-- বিয়ের অনুষ্ঠানে নাকি অনেকেই এক মণ চাউলের ভাত খেয়ে ফেলতো। এত খাবার খেয়েও তাদের নাকি পেট এক ইঞ্চিও উঁচু হতো না। আমরা দাদীকে প্রশ্ন করতাম, দাদী-- এত ভাত পেটের কোন জায়গায় যেত? দাদী বলতো, আরে বোকা, ভাত মুখে পুরলেও পেটে যেত না, যাদু টোনার মাধ্যমে বাইরে চলে যেত। বুড়োদের খাবার দেখে ঐদিন আমারও তাই মনে হয়েছিল।
ছোটকালে এসব বিশ্বাস করলেও বর্তমানে যতটুকু জানি, যাদুটোনা বলে কিছু নেই। আমার দেখা খাদোক বুড়োগুলোও যাদুটোনার লোক ছিল না। তারা ছিল তাদের এলাকার মাতব্বর। প্রতি মাসেই এরকম দু'চারটি বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত থাকতো। প্রতিযোগীতার মধ্যমে খেতে খেতেই তাদের এরকম প্রাকটিস হয়েছিল।
*** অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন পোলাও কোরমা ছাড়া এ কেমন বিয়ের খাওয়া! সেই সময় গ্রামের ঐসব এলাকায় বিয়ের দাওয়াতে সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি পোলাও কোরমা খাওয়ানোর প্রচলন ছিল না। বিভিন্ন প্রকার পিঠা, পায়েস এবং ভাতের সাথে নানা রকম মাছ, মাংসের তরকারী খাওয়ানো হতো। তবে এটাও সত্য-- পোলাও কোরমা খাওয়ালে কারো পক্ষেই এত খাওয়া সম্ভব হতো না। আশির দশকের পরে আস্তে আস্তে গ্রাম পর্যায়ে পোলাও কোরমা খাওয়ানো শুরু হয়। বর্তমানে পোলাও কোরমা ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান চিন্তাই করা যায় না। পোলাও কোরমার সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করায় পিঠা পায়েসের প্রচলন উঠেই গেছে। আমি যে এলাকার বিয়ের বর্ণনা দিচ্ছি সেটা ছিলা তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত জামাল পুর মহকুমার যমুনা নদী বেষ্টিত চরাঞ্চল।
আরেকটি কথা না বললেই নয়-- যে বুড়ো খাদোকের খাওয়ার উল্লেখ করেছি তিনি নাকি এক বসায় চার সের জিলাপী এবং আড়াই সের রসগোল্লাও খেতে পারতেন। তবে তিনি যে ভালো খাদোক এটা সেদিন তার খাওয়া দেখেই বুঝেছি।
(ছবিঃ ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১৫