somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি; ২১ আগষ্ট

২১ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০৪ সাল, ২১ আগষ্ট।

আমি তখন কলেজে যাচ্ছি, অফিস শেষে সেদিন আগেই বের হয়েছিলাম। মতিঝিলে তখনও পৌছায়নি, বাসের ঠিক পেছনটায় বসা ছিলাম। অন্য সব দিনের মত রাস্তায় মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ছিলো। সবকিছু স্বাভাবিক।

শাপলা চত্বরে পৌছাবার বেশ কিছু আগেই যাত্রী ওঠা নামায় বাস’টা থেমে ছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ চিৎকার – চেঁচামেচিতে মতিঝিলের শাখা রাস্তাগুলো থেকে বের হয়ে আসা আতংকিত মানুষের এলোপাথাড়ী দৌড়ানো। কিছু বুঝে উঠবার আগেই বাসের পেছনের কাঁচ দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করতেই বাসটি সজোড়ে চালিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে নটরডেমের দিকে চলে যায়। কিছু মানুষ অপ্রস্তুতভাবে বাস থেকে নেমেও পড়ে। বাসের ভেতর সকলেরই বাড়তি উৎকন্ঠা পরিবেশ’টাকে আরো গাঢ়ো করে তুলছিলো। আমি আমার গন্তব্যে নেমেছিলাম।

সন্ধ্যা প্রায়। কলেজের বারান্দায় বসা। আমার সাথে আরো গোটা তিন চারজন। একটা জুনিয়র ছেলে বাকী সবাই ক্লাস মেট। কেউ কিছু অনুমান করতে পারছিলাম না। কিন্তু ভেসে আসা উড়ো খবরে বিশ্বাসও করতে কষ্ট হচ্ছিলো। আনমনে পায়চারী করছি আর বাড়তি অনেক চিন্তা মাথায় ভর করছিল, সবারই একই দুশ্চিন্তা। কেউ কাউকে আলাদা করে শেয়ার করার মত কিছু ছিলনা।

ইলেকট্রিসিটি অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক-ও কাজ করছিলো না ঠিকমত। আমি তখনও মোবইল ব্যবহার করতাম না। বন্ধুর একটা ফোন থেকে বাড়ীতে কয়েকবার কল করলাম কিন্তু গেলনা, আরো দুশ্চিন্তা মাথার আশেপাশে। ঠিক ওসময় এমন পরিস্থিতে বের হওয়া ঠিক হবে কিনা সেটা ভাবছি আর বাইরের পরিবেশের কথা অনুমান করছি শুধু। কারণ কলেজের বারান্দা থেকে যে রাস্তাটুকু দেখা যায় তাতে বুঝতে পারছিলাম কোন সাধারণ ঘটনা ছিলনা ওটা।

আমি আর দুজন তখনও কলেজে। ক্লাস হবেনা জানিয়ে দিয়েছিল বেশ অনেক আগেই। অন্যরা সবাই যে যার মত বেরিয়ে পড়েছিলো। যখন রাস্তায় নামলাম প্রায় অন্ধকার চারদিক। রাত তখন। দোকান পাট প্রায় সব বন্ধ। কোন রিকশাও পর্যন্ত চলছিলো না। শুধু রাস্তার লেন, রাস্তা ধরে সারি সারি মানুষের হেটেঁ চলার ঢল। তখন আর কাউকে ছোটাছুটি করতে দেখিনি।

শাপলা চত্বরে পৌছে পাশে থাকা বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার পথে এগুলাম। কেমন একটা চাপা গুমোট –ভয়াবহ লাগছিলো চারদিক। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের চোখে মুখে আতংক আর ভয় দেখেছিলাম। রাস্তায় বাস তেমন ছিলনা। দু-একটা কোথা থেকে যেই মূল রাস্তায় উঠে আসছিল অপেক্ষমান মানুষের হামলায় তাতে ওঠাই দায় ছিলো।

আমি তখন অন্য চিন্তায় নিজেকে আরো বেশী অস্থির লাগছিলো। বাড়ীতে বাবা – মা জানতেন আমি এদিকেই আসছি, তারা হয়তো পুরোপুরি খবর জেনে গেছেন ইতোমধ্যে। তাদের উদ্বিগ্নটা আঁচ করতে পেরেই বাড়ী ফেরার বদলে খোঁজ করছিলাম কোথা থেকে খবর পাঠানো সম্ভব হয় কিনা। শাপলা চত্বর থেকে ডান দিকে এগুতেই, বন্ধ থাকা সব দোকানের মাঝ থেকে গলির মুখের একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান খোলা দেখে ছুটে গেলাম। ডায়াল করলাম। কিন্তু দোকানের ছেলেটা জানালো মোবাই নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ।

তখনও পুরোপুরি খবর জানতে পারেনি আসলে কি ঘটেছিলো, মনে হয়েছিলো দোকানের ছেলেটা হয়তা জানতে পারবে, সে অনুমান থেকেই জিজ্ঞেস করা। এরপর নানা গুজবের মাঝ থেকে সত্যটা জানলাম, সেদিনকার মিটিং-এ বোমা হামলা হয়েছে। অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। নিহত-আহতের সংখ্য সঠিক কিছু না বলতে পারলেও ছেলেটার ভাষায় “ম্যালা মানুষ মরছে”

বাড়ী ফেরার চিন্তা মাথায় তখন। এতদূর পথ হেঁটেও ফেরা অসম্ভব না হলেও সময়ের হিসেবে অনেক পথ। অগত্যা কোন উপায়ন্তর না দেখে অনেক মানুষের ভীরে আমিও হাঁটতে শুরু করেছিলাম। বিশেষ করে যেসব মেয়েরা বাড়ী ফিরছিলো ওদের কষ্টটা ছিলো অবণর্নীয়। তবুও সবাই একটা চাপা ভয়কে সঙ্গী করে যে যার গন্তব্যে এগিয়ে চলছে । অনেকেই জানা – অজানা দু-একট ঘটনার বাক্য বলে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া আমি আবার থেমে থেমে শুনে যাচ্ছি আর ভাবছিলাম সত্যি যদি তাই হয় তাহলে দেশের নিরাপত্তা কোথায়। আর আমরা সাধারণ যারা এদের কথা তো তাদেরই ভেতরে।

শাহবাগে পৌছানোর বেশ আগেই পেছন থেকে ছুটে আসা একটা বাসের দরজার হ্যান্ডলে হাতাখানা বাড়িয়ে ধরে ফেললাম। পা টা গিয়ে পড়েছিলো আরেকজনের পায়ে। তিনি নমনীয়তায় আমাকে যতটুকু পারা যায় আগলে রাখলেন। এভাবেই ঝুলতে ঝুলতে বাকী’টা পথ পেরুনো।
বাসায় তখনও পৌছায়নি। এলাকার রাস্তাগুলোতেও অন্য সব দিন থেকে আলাদা মনে হলো, মতিঝিলের এ ঘটনার ভয়াবহতার ছাপ ওখানেও লেগে আছে। মানুষজনের চলাফেরা কম, রিকশাও যা চলছে দু-একটা। হেঁটেই বাড়ী পর্যন্ত চলে গেলাম।

ঘরের কলিং বেল দিতেই, মা ছুটে এসেছিলেন। কিছু বলার আগেই মা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন, বাবাও তখন উঠে এসেছেন, ছোটটা আমার পাশে। বুঝতে পেরেছিলাম, ওই সময়ের ঘটনায় আমার দুশ্চিন্তার চেয়ে বাবা-মা কতটা দু:সহ আর অসহায় সময় পার করেছেন। রাতে টেলিভিশনে বিস্তারিত জানলাম।

অনেকদিন পর আজ যখন আবার বছর কয়েক ঘুরে সেই ২১ আগষ্ট, এর মাঝে আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম জীবনের অনেক আনন্দ – কষ্টের বেশকিছু স্মৃতি। আসলেই হয়তো ভুলেও গেছি অনেক কিছু। কিন্তু সেদিনকার সেই দু:সহ স্মৃতি ভুলতে পারিনি, আরো অসহায় বোধ করেছি যখন টেলিভিশনে দেখেছি ছিন্ন-ভিন্ন লাশের টুকরো, মানুষের আহাজারি, স্বজন হারানোর ব্যথা – তীব্র চিৎকারের কান্না। আমি কোন দলের নয়, নির্বিশেষে এ দেশের একজন খুব সাধারণ মানুষ। সে বিবেচনায় সেদিনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছিলো আজও তাদের তীব্র ঘৃনা করি এবং ধিক্কার জানাই।

কিন্তু আফসোস হয়, কেউ প্রকৃত ঘটনা না পেরেছে উদঘাটন করতে, না বিচার, শুধু দলীয় কোন্দলে একে অপরকে দোষারপ ছাড়া।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×