somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: শেকড়-নীতি

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাঝে মধ্যে ঠিক মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কেমন যেন একটা তৃষ্ণা জাগে। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই, মাথাটা একেবারে খালি মনে হয়, হাত কাঁপে। লাইট জ্বালিয়ে টেবিলে খাতা কলম নিয়ে বসি। কিচ্ছু লেখার নেই, কিচ্ছু মাথায় আসছে না। অস্থির লাগে। তখন হয়তো দেয়াল বেয়ে একটা মাকড়সা ছুটে যায়। লিখে ফেলি, ''তিড়বিড়িয়ে একটা লোমশ প্রাণী ছুটে গেল। আটটা পা, আটটা চোখ। কিন্তু মাথা একটা, ছুটছে এক দিকে। কোন বিভ্রান্তি নেই ....''

থেমে যেতে হয়। নাকি থেমে গেলাম? 'থেমে যেতে হয়' আর 'থেমে গেলাম' এর মাঝে বোধহয় খুব একটা ব্যবধান নেই। প্রতিটা রাতই এখন একরকম মনে হয়, বা 'হচ্ছে'; কোন আজ-কাল নেই। অসীমসংখ্যক সরলরেখাদের মাঝে কি কোন পার্থক্য থাকে? হয়তো একেক সরলরেখার উদ্দেশ্য একেক রকম। আমার উদ্দেশ্যটা বের করা দরকার। কি লিখতে চাইছি? ফিলোসফিকাল কিছু? মাঝরাতে উঠে কেউ দর্শন লেখে? অদ্ভুত।

কিন্তু দর্শন নিয়ে তো কিছু জানি না। একমাত্র মধ্যবিত্ত দর্শনে অভিজ্ঞ, কিন্তু ওটার কথা আর কত বলা যায়? সারাদিন গাধার মত খেটে মাঝারি আয়ে পরিবার চালাই, তবু খাই মেটে না। খাব খাব খাব খাব। একমাত্র নীতি, একমাত্র আদর্শ। প্রথম প্রথম মেজাজ খিঁচড়ে উঠত, এখন তাও হয় না। পুরো দিনটা কাটিয়ে হাঁফ ছাড়ি- আরও একদিন গেল। সংসারের জোয়াল টানার শাস্তি আরও একদিন কমল। এইতো বাঁচা! কেমন আছেন আসাদ সাব? মুখে হাসি টেনে বলি, আছি ভাই, আলহামদুলিল্লাহ।

লেখা এগোতে চাইছে আবার-

''...সংশয় নেই, পেটে ডিম নিয়ে একছুটে পালিয়ে গেল। হয়তো এখন গিয়ে ঘরের অন্ধকার কোণায় লুকোবে, সঙ্গীর বোনা সংকীর্ণ জালে বসবে, তারপর পেটের ডিমটায় হাত বুলিয়ে বলবে, বেশ আছি তো! গল্পের টিকটিকি দেয়ালের ওপরে লটকে সায় দেবে, ঠিক ঠিক ঠিক!''

কালকে কি শুক্রবার? ছুটি? ক্যালেন্ডার দেখা দরকার। কিন্তু টেবিল ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। সত্যি বলতে কি, উঠতে পারবও না। এই সময়টায় চেয়ারে বসার পর উঠতে গেলে হাত প্রচণ্ড ব্যথা করে, সারা দিনে সে ব্যথা যায় না। কিন্তু আমি হাতে কলম নিয়ে বসে থেকে দেখেছি, তখন কোন ব্যথা করে না। সপ্তাহে দুই তিন রাত এভাবে রাত জেগে কাটে আমার, ঘুম আসে না। শুধু শুধু হাতে কলম নিয়ে চেয়ারে বসে রাত কাটিয়ে দেওয়াটা কারো চোখে স্বাভাবিক লাগবে না, তাই লেখার ভান করতাম। ভান করতে করতে কখন আসলেই লেখা শুরু করে দিয়েছি, জানিই না। দেখলাম, লিখলে হাতের ব্যথা আরও কমে যায়। এখন তাই সময় কাটাতে, ব্যথা কমাতে লিখি।

''কিন্তু এদের পারস্পরিক ছোটাছুটি ও লটকালটকি জালের অন্য মাকড়সাটিকে বিরক্ত করে না। সে বরং আগ্রহ নিয়ে পেটের ডিম ফুটে কি বেরোতে পারে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে আর জালে ঠেস দিয়ে বসে পঁচা মাছি গিলতে গিলতে অপেক্ষা করে। তার মাঝে কোন না কোন ভাবে ঘুমহীন প্রতীক্ষা আর অলস আগ্রহের স্বর্গীয় মিশ্রণ ঘটে গেছে। বাইরে তখন কৃষ্ণকালো আঁধার।''

বাইরে আসলেই কালো আঁধার। চেয়ারে বসে কোনোমতে টেবিলের কাছের জানালাটা খুললাম, একেবারে 'অন্ধ রাত্রি'। জ্যোৎস্না নেই, আকাশে বোধহয় মেঘ করেছে- তারা-টারা কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। রুনা জেগে থাকলে ভালো হত, চা-টা করে দিতে পারত। কিন্তু ও পেটে হাত রেখে একেবারে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। থাক, অনেক সকালে উঠবে তো, ঘুমাক।

শব্দের ব্যবহারটা কি ঠিক হল? 'কৃষ্ণ' কালো? এই কৃষ্ণ কি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনির কৃষ্ণ? তিনি বোধহয় কালো ছিলেন না, তার গায়ের রং নীল হবার কথা। কি জানি! খেয়ালে নেই। তবে রুনার সাথে টিভিতে কৃষ্ণের অ্যানিমেশন কার্টুন দেখেছিলাম। ও ঠিক বাচ্চাদের মত, এসবের খুব ভক্ত। চীনা-জাপানি-ভারতীয়-আমেরিকান সব টাইপের কার্টুনই তার পছন্দ। যাই হোক, ওই কার্টুনে কৃষ্ণের বালক ভার্সন দেখেছিলাম। একহারা নীল দেহ। কেমন যেন ঘন নীল, পূর্ণিমার রাতে আকাশের রঙের মত। সেদিন ভালই লেগেছিল দেখতে।

আজকের পরিবেশটাও আসলে খারাপ না। চারিদিক নিস্তব্ধ, অনেক রাতে মাঝে মাঝে শব্দের অভাবে অদ্ভুত লাগে, মনে হয় নতুন কোন মহাশব্দের জন্মের প্রতীক্ষা করছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কালো রাতের আঁধারে আকাশ থেকে বালু ঝরছে ঝিরঝিরিয়ে। বালুর ওই কণারা কিন্তু অদৃশ্য, তারা মানুষের চারপাশে ভরে উঠে একসময় ডুবিয়ে ফেলে, মানুষেরা বুঝতেও পারে না। তারা বালু ঠেলে ঠেলে বাঁচে। উফ! হাতে কাঁপুনি লাগছে আবার! মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে এসব; কেউ একজন মনে করিয়ে দিচ্ছে, অনর্থক ভেবো না, লেখো!

''দুর্ভাগ্যবশতঃ দুদিনের বাসি পঁচা মাছি মাকড়সার পেটে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাকড়সাটি পেট চেপে কোনোমতে জাল থেকে নামে, তারপর মেঝেতে হড়হড়িয়ে বমি করে দেয়। থুঃ করে মুখে লেগে থাকা মাছির পাখার অবশিষ্টাংশ ফেলে সে এক পায়ে মুখ মোছে। নিঃশব্দে গাল দেয় কাকে যেন। অন্য মাকড়সাদের মত তার পশ্চাতে সুতার অসীম ভাণ্ডার নেই, এমনকি তার টিকটিকির মত লম্বা জিহ্বাও নেই। অন্যরা পশ্চাত নাড়াতেই জিলাপির প্যাঁচের মত নকশা করে মিহি সুতা বেরোয়, তারা বিনা ক্লেশে শিকার করে। কিন্তু তার পশ্চাৎজাত সুতা অপর্যাপ্ত। সে জাল বুনতে গেলে ধার করে বোনে। এমন অপারগতার ফলাফল অবধারিত, সংসারে তার সম্মান নেই। পোয়াতি মাকড়সা অবশ্য খোঁটা দেয় না, প্রতিদানে সে পাড়া ঘুরতে গেলে মানা করাও যায় না। তবে বর্তমানে পোয়াতি হওয়ায় ব্যাপারটা উল্টে গেছে, পাড়া-ই এখন পোয়াতি মাকড়সার কাছে ঘুরতে আসে।''

এসব কি যে আবোল তাবোল লিখি! এসব কি বোঝার উপায় আছে, কেউ বুঝবে? দর্শন থেকে সরে এখন মনোযোগ পিওর সাহিত্যে শিফট হচ্ছে বোধহয়, আস্তে আস্তে দুর্বোধ্য হচ্ছে কিনা! রুনা পড়লে বুঝত, কিন্তু ঘুমোচ্ছে যে! হয়তো না বুঝেই খোঁটা দিত, ওমা! কি লিখসো বলে মুখ চেপে হাসত। তারপর সকালে খাতা নিয়ে ওপরে সাদেক কবি-র ফ্ল্যাটে যেত, অতি শুদ্ধ ভাষায় বলত- 'হিহিহি সাদেক ভাই দেখেন, আপনার আসাদ ভাই এইগুলো কি লিখেছে!' সাদেক হয়তো খাতাটা একমুহূর্ত চেয়ে দেখত, তারপর বিদ্রুপের সুরে বলত, 'দারুণ হইছে তো! জমায়া রাখবা, কেজিদরে বেচলে লাভ আছে।'

কেন লোকটা আমাকে পছন্দ করে না, কে জানে? আমি তো আদর্শ প্রতিবেশি, সবসময় ভালো আচরণ করি। রুনাকে নাম ধরে ডাকলেও কিছু বলি না। ঘরে এলে তার সাথে রাজনীতি, সমাজ এবং ধর্ম নিয়ে কথা বলি। কবিতা লিখে ও এত টাকা পায় কিভাবে তা কোনোদিন জিজ্ঞেস করি নি। রুনা ভালমন্দ কিছু রান্না করলে আমিই মনে করিয়ে দেই, যাও সাদেককে এক বাটি দিয়ে এসো। এমনকি অফিস থেকে এসে ওকে ড্রয়িংরুমে দেখলেও কখনো বিরক্তবোধ করি না। তাহলে? নাকি ছাপোষা কেরানি জাতটাই তার অপছন্দ?

হয়তো অন্যের বিষয়ে নাক গলানো হয়ে যাচ্ছে। ব্যাচেলর কবি সাদেক, তার সাফল্য এবং তার মনোভাব নিয়ে ভাবার আমি কে? ওই টপিক বাদ। মাকড়সার লেখাটায় এগোনো যাক।

''মাকড়সাটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আকাশে আটটা পা তুলে সে চিত হয়ে শোয়, উদাস মনে কিছুক্ষণ সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ চোখের কোণে একটা কিছু নড়ে ওঠে। মাকড়সাটি অষ্টচোখে মিটমিট করে, ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে। ওপরে লটকে থাকা টিকটিকি-টা তার অনুপস্থিতির সুযোগে জালের কাছে নেমে এসেছে। পোয়াতি মাকড়সার তাতে কোন আপত্তি নেই মনে হচ্ছে, সে আরও উৎসাহী হয়ে টিকটিকির আগমনের অপেক্ষা করছে। মাকড়সাটির তৎক্ষণাৎ কোন প্রতিক্রিয়া হয় না, সে খুব করে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে। কিন্তু আশ্চর্য, অন্যদিনের মত আজ তার মাথার অথর্ব অংশটি বিদ্রোহী অংশের সাথে পেরে উঠছে না! মস্তিষ্কের ভেতরে সশব্দে ছোট ছোট বিস্ফোরণ হচ্ছে। পঁচা মাছির স্বাদ, নাকি পোয়াতির চোখেমুখে নির্লজ্জ আহবান- কোনটা তাকে তাতিয়ে দেয় বলা মুশকিল; কিন্তু আজ মাকড়সাটি শুয়ে না থেকে দেয়াল বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকে।''

ভাবছি লেখাটা রুনাকে দেখাবো। রুনা দেখল মানেই সাদেককে দেখানো হল, বিষয়টা খুব একটা আনন্দের না। কিন্তু রুনা লেখাটা পড়ল মানেই ওর পেটের পরীটাও পড়ল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। পরীটার জন্য তো এসব লেখা। এপর্যন্ত যা লিখেছি, সব তো ও-ই পড়বে। আমার লেখার আর কোন পাঠক কি আমি আশা করতে পারি?

কিন্তু লেখার আগামাথা কিছু বুঝবে কিনা কে জানে? আমি বুঝিয়ে দিতে যাব না। আরে বাবা, এগুলো কেরানি-সাহিত্য - আনপ্ল্যানড, আনপ্যারালালড; বোঝা কি অতই সোজা? তবে আজ রাতে গল্প তরতরিয়ে এগোচ্ছে। প্রথমে একটু দর্শন, তারপর সাহিত্য, এবারে একটু অ্যাকশন আনা যেতে পারে।

''কাছাকাছি যেতেই ওদের কথাবার্তা শুনতে পায় সে। ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে, সঠিক করে বললে ওর জাল নিয়ে। ও জাল বোনায় কতটা অপটু, ওর কত বেশি সময় লাগে, জালের ফাঁক দিয়ে কেমন করে মাছিরা বেরিয়ে যায়- এইসব। এমনকি মাকড়সা-মাকড়সানির আপন গোপন কথাগুলোও রসিয়ে রসিয়ে আলোচনা হচ্ছে। পোয়াতি মাকড়সার কথা বলার রংঢং আর টিকটিকির দৃষ্টি লক্ষ্য করে মাকড়সাটির গা জ্বলে যায়। মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করে সে, কিন্তু আট আটটা পায়ের সাথে পেরে ওঠে না। অনেক দিন নিশ্চল ছিল ওগুলো। কিছু বোঝার আগেই সে ছিটকে চলে যায় টিকটিকির কাছে। টিকটিকি এবং পোয়াতি তার হঠাৎ আগমনে অবাক হয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে, বিরক্তও হয় হয়তবা, কিন্তু মাকড়সাটি কোন সুযোগ দেয় না। আট পায়ে টিকটিকিকে জড়িয়ে ফেলে দাঁত বসিয়ে দেয় তার ঘাড়ে। এমন অতর্কিত আক্রমণে টিকটিকি বিপর্যস্ত হয়ে যায়, শেষে দুজনেই ভারসাম্য হারিয়ে অনেকটা নিচে মেঝেতে পড়ে যায়।''

হুম, আসলেই পোকামাকড়ের গল্প এগোচ্ছে ভাল, পরীর ভালো লাগবে। একটানে বলে ফেললাম অনেকটা কথা। আবর্জনা না, নির্দিষ্ট কিছু একটা হচ্ছে বোধহয়। হাতের ব্যথাটাও প্রায় নেই নেই মনে হচ্ছে। এরপর কি দেওয়া যায়, করুণরস? নাকি গল্পের মাঝে মরাল টাইপ কিছু কথা ঢুকিয়ে দেব? দিলেও সূক্ষ্মভাবে দিতে হবে, যাতে ওর মনে না হয় ওকে কিছু বলা হচ্ছে, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।

''মাকড়সাটি জ্ঞান ফিরে পেল খুব ধীরে ধীরে, সাবধানে চোখ খুলল। তার চারপাশের পৃথিবী মদ্যপ, ঢুলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। একটা নিচু কিন্তু সুতীক্ষ্ণ আর্তনাদে মাথাটা ঝনঝন করে উঠল ওর, শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। পোয়াতি মাকড়সাটা টিকটিকিকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। এমনভাবে কাঁদছে যেন বেচারির স্বামী মারা গেছে। টিকটিকিটা কি মরে গেছে নাকি? লেজ খসে গেছে, ঘাড়ের কাছে ফুলে নীল হয়ে আছে, আধহাত জিহ্বা ঝুলে আছে বাইরে। ঠোঁট বেয়ে বেয়ে বাদামি কষ পড়ছে। হ্যাঁ, নিশ্চিত মরে গেছে। মাকড়সাটি আনমনে দাঁতে পা বোলাল। ওর দাঁতে যে বিষ আছে, এটা আগে ও জানত না। বাপ-মা কখনো বলে নি। তার মানে ও ফেলনা নয়, ওর-ও ক্ষমতা আছে বৈকি! কি আর করা যাবে, টিকটিকি-টার ব্যাড লাক। মাকড়সাটির কেমন হাসি পেতে থাকে, সে পোয়াতি মাকড়সাকে ধরে কোনোমতে ওঠাল। পোয়াতি তার দিকে প্রচণ্ড জিঘাংসা নিয়ে তাকাল- -তুমি কি, মাকড়সা না শয়তান? এমন ভালো একটা প্রতিবেশিকে মেরে ফেললে! তুমি ... তুমি ...এতোটা সন্দেহ কর আমাকে? সন্দেহের বশে একটা টিকটিকি মেরে ফেললে! তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। যাও সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। আমি থাকতে পারব না তোমার সাথে, মরে গেলেও একটা খুনির সাথে একই জালে বসবাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না....' পোয়াতি ফোঁতফোঁত করে কেঁদে ফেলে। তারপর নাক টানতে টানতে দেয়াল বেয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।''

প্রতিটা পাগলাটে রাতেই এমন হয়। প্রতিটা রাত। শুরুতে মনে হয় মাথা বিগড়ে যাচ্ছে, না লিখলে পেট ফেটে, বুক-গলা শুকিয়ে মরে যাব। ইচ্ছেমত লেখার পর দেখি কাগজের পর কাগজ অর্থহীন শব্দ, বাক্য, আঁকিবুঁকিতে ভরে আছে, আর সেই সাথে ডান হাতের ব্যথাটা উধাও। কেন হয় এরকম? কাজের চাপ? মানসিক চাপ? কি জানি! তাহলে তো ডাক্তারি শাস্ত্রে 'দ্য কেরানি সিনড্রোম' নামের একটা কিছু থাকার কথা। তেমন কিছু নেই বোধহয়। এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেছিলাম, অনেকক্ষণ ধরে পুরোটা খুলে বললাম তাকে । তিনি কিছু ওষুধ দিলেন, এক মাস পরে আবার আসতে বললেন। ওষুধ খেয়ে কচুও হয়নি, এক মাস পরে আবার গেলাম।

এবারে সব কথা শুনে তিনি বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললেন, 'আপনার লেখালেখি করার শখ আছে নিশ্চয়ই?'
-'না তো!' আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম।
'ভালো করে ভাবুন। ওষুধে কাজ হচ্ছে না, তাহলে নিশ্চয়ই মানসিক প্রবলেম। সেক্ষেত্রে এটা ক্লিয়ারলি চাপা আবেগের বহিঃপ্রকাশ। হয়তো আপনি শৈশবে লেখক হতে চেয়েছিলেন, সেই ইচ্ছাটা কোনোভাবে চাপা পড়ে যায়। এখন এই বিশেষ 'ঘটনার' মাধ্যমে সেটা প্রকাশ পাচ্ছে, বা এরকম কাছাকাছি কোন ব্যাপার। আমি আপনাকে আরও ওষুধ দিতে পারি, বাট মানসিক ব্যাপার তো, আমার মনে হচ্ছে এসব ওষুধে কোন কাজ হবে না। আমি বলব তারচেয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। ওরা কেসটাকে ভালমত এক্সপ্লয়েট করতে পারবে। আমার পরিচিত একজন আছে, আরামবাগে বসে। তার কাছে যেতে পারেন।'

হ্যাহ, টাকা তো গাছে ধরে! এরা সব হচ্ছে ডাকাত, এক নম্বরের ডাকাত; সবসময় চিন্তা কিভাবে আরও কামানো যায়। সামান্য একটা জিনিস- ঘুমের ওষুধ খেলেই হয়তো ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু না! আমাকে যেতে হবে পাগলের ডাক্তারের কাছে! নইলে আমি ভালো হব না। যত্তসব! লোকটার কথা শুনে প্রথমে এটাই মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু বাড়িতে এসে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবলাম। দেখলাম, চাইলেও ওই ধরণের ডাক্তার দেখানোর বিলাসিতা করতে পারব না। অন্ততঃ এখন। পরীটা পৃথিবীতে আসছে, তার জন্য সামনে টাকাপয়সা দরকার। গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। আবার বাড়িভাড়া আছে। ডাক্তার দেখাতে গেলেই এদের একটা না একটার ওপর টান পড়বে। ব্যাংকে কিছু আছে, কিন্তু ওগুলো বিপদ-আপদের জন্য। সামান্য ঘুম হয় না বলে কি সঞ্চয়ে হাত দেওয়া সাজে?

একটু পরে আজান দিয়ে দেবে, রুনা উঠে সাদেকের সাথে জগিং করতে বেরোবে। আমার পায়ে ব্যথা করে, আমি দৌড়াতে পছন্দ করি না। ওদের সাথে ক'দিন গিয়েছি, এখন আর যাই না, কুলোতে পারি না। রুনাকেও মানা করেছিলাম, পেটে ছ'মাসের বাচ্চা নিয়ে জগিং করা কি ভালো? কিন্তু রুনা বলল, জগিং করলে বাচ্চার নাকি ভালো লাগে। হয়তো।

আজ আগেই ডাক দেব কি? না অর্থহীন লেখালেখি শেষ করব আগে?

যাকগে, একটু পরে উঠলেও খুব ক্ষতি নেই। রুনা রাগ করবে না জানি। ও ভালো মেয়ে, কখনো রাগ করে না। তাইতো খুব ভালবাসি ওকে আমি। মিষ্টি মেয়ে। সাদেক এই কথাটাই হেসে হেসে কাল বলল বার বার, 'আসাদ ভাই, আপনি সত্যি খুব লাকি, রুনার মত একটা বৌ পেয়েছেন। ভেরি ভেরি লাকি।'

''মাকড়সাটি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পোয়াতির প্রস্থানে নতুন আবিষ্কৃত ক্ষমতা বিষবৎ মনে হতে থাকে ওর। আগের মত দুর্বল, একাকি লাগতে থাকে। ওর মনে হয়, সবারই সঙ্গ প্রয়োজন- সঙ্গিনী স্বৈরিণী হলেও, তার পেটে টিকটিকির বাচ্চা হবার সম্ভাবনা থাকলেও। আর জিনিসটা খুব একটা খারাপ হত না। বাচ্চাটা কেমন হবে, দেখতে পারলে ভাল হত। মাকড়সার মত আটপেয়ে, আর টিকটিকির মত লম্বা জিহ্বা হবে, নাকি অন্যরকম বিচিত্র কিছু হবে? হয়তো একটা টিকটিকি হবে, কিন্তু সারা শরীরের এখানে ওখানে একটা একটা একটা করে আটটা চোখ থাকবে! যাই হোক, নতুন একটা জাত দেখা যেত। মাকড়সাটি পোয়াতির পেটে লেপটে থাকা ডিমের প্রতি অদ্ভুত স্নেহ অনুভব করতে শুরু করে। ক্ষণিক আগে মৃতের সম্মান অর্জন করা টিকটিকির ঝুলে পড়া জিভ মাথা থেকে কেমন করে যেন মুছে যায়।

আর্দ্র হৃদয়ে দেয়াল থেকে নামতে নামতে তার পোয়াতির বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্ট, তাই না? কি জানি, হয়তো সত্যিই তার চিকিৎসা নেওয়া উচিত। খুন করে কোন অনুশোচনা তো হচ্ছে না- এটাকে কি স্বাভাবিক বলা যায়? হুম, যাওয়া যেতে পারে, হাজার হলেও পোয়াতি বলেছে! সে ভুরূ কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করে, আশেপাশে কোথাও কোন সাইকিয়াট্রিস্ট বসে কি না ।

একটু পরে দেখা যায়, মাকড়সাটি ঘরের আরেক কোণে এসেছে। তার সামনে একটা সবুজ ঘাসফড়িং বিরক্তি চেপে রেখে মেকি মুখে বসে আছে। বলাই বাহুল্য, ঘাসফড়িংটি আশেপাশে কোথাও বসা সেই সাইকিয়াট্রিস্ট। সে গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বলে, 'তো আপনার সমস্যা কি? রেখেঢেকে বলবেন না, রিলাক্সড হয়ে খোলা মনে সোজাসুজি বলে ফেলুন।'


মাকড়সাটি মুখের কাছে দুটো পা এনে ছোট একটা কাশি দেয়। অস্বস্তি বোধ করছে। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধ সময় কাটার পর সে একটু বিভ্রান্তস্বরে বলে, 'আসলে.....মানে...', তারপর অস্থির ভাবে বলতে শুরু করে, 'মাঝে মধ্যে ঠিক মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কেমন যেন একটা তৃষ্ণা জাগে। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই, মাথাটা একেবারে খালি মনে হয়....'
৬৬টি মন্তব্য ৬৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×