কবি শার্ল বোদলেয়ার এর লেখা ‘The Stranger’ কবিতাটি ‘অচেনা মানুষ’ শিরোনামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু।
“অচেনা মানুষ
বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি
সবচেয়ে ভালবাসো?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধুরা?
ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনোই জানি নি।
তোমার দেশ?
জানি না কোন্ দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য?
পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ,…..চলিষ্ণু মেঘ…….
উঁচুতে……..ঐ উঁচুতে……..
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।”
মূল কবিটি এখানে তুলে ধরা হলো --
“The Stranger
Charles Baudelaire
Tell me, enigmatic man, whom do you love beet?
Your father, your mother, your sister, or your brother?
"I have neither father, nor mother, nor sister, nor brother."
Your friends, then?
"You use a word that until now has had no meaning for me."
Your country?
"I am ignorant of the latitude in which it is situated."
Then Beauty?
"Her I would love willingly, goddess and immortal."
Gold?
"I hate it as you hate your God."
What, then, extraordinary stranger, do you love?
"I love the clouds--the clouds that pass--yonder--the marvellous clouds.”
এই কবিতাটি নাড়াচাড়া করছিলাম গত কয়েকদিন ধরে। এ সময় যে দু’টি অভিজ্ঞতা হলো তারই আলোকে আমার কিছু কথা।
প্রথম অভিজ্ঞতা: যে কোনো ভাষায় লেখার অনুবাদকে বুঝতে হলে অরিজিনাল লেখাটি পড়ে দেখা আবশ্যক কারণ অনুবাদ যত সুন্দরই হোক তাতে অনুভূতির ফাঁক থাকবেই।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা: আলোচ্য কবিতার মর্ম সঠিক ভাবে বুঝার খাতিরে লেখকের জীবন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন যা কবিতাকে ভালো করে বুঝবার জন্য সহায়ক হয়।
আদি কবিতা এবং কবিকে জানা, দু’টি বিষয়ই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমার মতে এই কবিতার কথামালাকে দুই দিক থেকে ভাবা যেতে পারে।
প্রথমত ব্যক্তি কবিকে নিয়ে আর দ্বিতীয়ত কবি দর্শনকে নিয়ে।
যদি ব্যক্তি কবিকে নিয়ে কথা বলি তাহলে বলবো, কবি জীবন আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্ন করছেন আর উত্তরও দিয়েছেন তিনি নিজেই।
কবির হয়তো নিজের কাছে নিজেকে আগুন্তক মনে করেছেন।
এমনো হতে পারে তিনি কাউকে জানতে চেয়ে এ ধরণের কিছু জবাব পেয়েছিলেন যাকে তিনি কাব্যে রুপায়ন করেছেন কিংবা
এমনো হতে পারে কখনো কেউ কবির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তারই উত্তর তিনি দিয়েছেন কবিতার ভাষায়।
কবি শার্ল বোদলেয়ার এর ব্যক্তি জীবনের চিত্র দেখে আমার মনে হয়েছে এই কয়েটা লাইনের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন যেখানে জুড়ে আছে কিছু হতাশা আর না পাওয়া।
হয়তো বা ছিলো না তাঁর ভ্রাতা অথবা ভগ্নী, পিতা হারিয়েছিলেন শৈশবে আর মাতাকেও পান নি একান্ত নিজের মত করে। সমস্যা জর্জরিত জীবনে সঠিক অর্থে বন্ধু বলেও খুঁজে পান নি কাউকে হয়তো বা, জীবনের জন্য যেতে হয়েছে জন্মস্থান ছেড়ে ভিন্ন দেশে, ছাড়তে হয়েছে নিজ দেশের ভৌগলিক সীমানা।
প্রেয়সী বলতে যে স্বপ্ন ছিলো সেখানেও হয়তো ছিলো অন্য রকম চাওয়া যা তিনি পান নি। অভাব অনটনে এক সময় ধনসম্পদকেও ঘৃণা করে মানুষ, বিশ্বাসে ধরে ফাটল, কবিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন বলে মনে হয় না।
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে চলমান মেঘের দিকে তাকিয়ে তিনি উপভোগ করেছেন বিশাল একাকীত্ব। এই সব কথা নিয়েই কবি গেঁথেছেন তাঁর কাব্যমালা ।
কবিতাটি যদি কবি দর্শনের দিক থেকে চিন্তা করি সেক্ষেত্রে বিষয়টি অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং সরল। মানুষ তার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা।
একজন শাশ্বত কবি কোনো বন্ধনেই নিজেকে বাঁধতে পারেন না বা বাঁধতে চান না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, ভৌগলিক সীমারেখা, একক প্রেম, সম্পদ সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি হন কাব্য-সাধক । অসীম খোলা আকাশের চঞ্চল মেঘের মত ছুটে বেড়ান, ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলমান মেঘের মত বন্ধনহীন স্বাধীনতাকে ভালোবাসেন সেই খেয়ালী মানুষটি আমরা যাকে কবি নামে আখ্যায়িত করি।
খালি চোখে দেখলে এটি একটি সাধারণ কবিতা মনে হবে কিন্তু কবিতার অন্তরাত্মায় প্রবেশ করলে এ যে এক গভীর সমুদ্র।
সর্বোপরি, পাঠক হিসাবে কোনো লেখার অন্তরালের ঘটনা সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে আমরা সক্ষম নাও হতে পারি। আমরা যা করি সেটা নিতান্তই অনুমান।
একমাত্র একজন কবি বা লেখকই জানেন তাঁর লেখার প্রকৃত দৃশ্যপট।
একথা স্বীকার করতেই হয় এক কবি হৃদয় শার্ল বোদলেয়ার এর লেখা এই কবিতাটির মাঝে বিলীন হবেনই।
(যার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে এই কবিতা নিয়ে ভাবতে হলো তিনি লেখক খলিল মাহ্মুদ, কৃতজ্ঞতা তাঁর কাছে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪৩