somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালটি ছিল সবচেয়ে ঘটনাবহুল। সেনাবাহিনীতে এ বছরটিতেই সংঘঠিত হয় একের পর এক ক্যু। ৭ নভেম্বর সংগঠিত ক্যু’র মধ্য দিয়ে দেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে দেশের রাজনীতিতে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর জুনিয়ার অফিসারদের দ্বারা সংগঠিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং মোশতাকে ক্ষমতা আরোহন মেনেে নিতে পারেননি। এ অবস্থায় তিনি পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তারা কেউ জানেন না ঠিক সেই সময়টিতেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, শহরের অন্য এক প্রান্তে।

রাজধানীর এলিফ্যন্ট রোডের ৩৩৬ নম্বর বাসাটি তখন সরগরম। জাসদ নেতা আবু ইউসুফের ওই বাড়িটিতে দলের তরুণকর্মীরা ছাড়াও সেনাবাহিনী থেকে চলে আসা অসংখ্য হাবিলদার, সুবেদার, কর্পোরাল, সার্জেন্ট ওয়ারেন্ট। এরা সবাই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। দফায় দফায় মিটিং টার। তারা বিদ্রোহ করতে চান। সবাই মোশতাক ও ফারুক-রশিদকে উৎখাত করতে চান। কেউ কেউ আবার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা জানতে পেরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলের অনুমোদন চায়। কেউবা অফিসারদের খতম করে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার পক্ষে। কর্নেল (অব.) তাহের তাদের লাগামহীন উত্তেজনার রাশ টেনে ধরেন। তাদের বোঝান হত্যা বিপ্লব নয়। তাহের শুধু সৈনিক সংস্থা নয়, জাসদের সামগ্রিক অবস্থাটিও বিবেচনা করতে থাকেন।

৩ নভেম্বর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার সংগঠক ও জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। ওই দিনই অর্থাৎ ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে রক্তপাতহীন ক্যু করতে গিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসে তার নিজ বাসভবনে গৃহবন্দি করেন। দেশ ও সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন খালেদ মোশাররফ। তিনি এসময় বঙ্গবন্ধুর খুনি ও বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তাদের সঙ্গে আপোষরফায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তাদের নির্বিঘ্নে দেশ ত্যাগে সহযোগিতা করেন।

এই পরিস্থিতিতে ৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এ বি এম মহমুদের বাসায় শুরু হয় জসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। আসেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসউদ, কাজী আরেফ প্রমুখেরা। আসেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখেরা। দেশের অন্যতম প্রধান এই দল যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তুমুল দাবি নিয়ে তোলপাড় তুলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তারা একবার দিকভ্রান্ত হয়েছেন শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের কারণে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের যাত্রা। দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন খালেদ মোশাররফ । এবার জাসদ তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করতে চায় এ পরিস্থিতি।

জাসদের প্রধান শক্তি তখন গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। দুটি অঙ্গসংগঠনেরই কমান্ডার ইন চিফ তাহের। তারা বলেন, চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার নামে খালেদ মোশাররফ তার সেনাপ্রধান হওয়ার ইচ্ছাই চরিতার্থ করেছেন শুধু। তাছাড়া বিনা বিচারে শেখ মুজিবের খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ দিয়ে বিরাট অন্যায় করেছেন তিনি। সিপাইরা এর একটা শেষ দেখতে চায়। কর্নেল তাহের বুঝতে পারেন এ মুহূর্তে জাসদের পক্ষে এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আর্মিতে একটা বিদ্রোহ ঘটবেই। এই বিদ্রোহকে যদি জাসদ নিজেদের পক্ষে আনতে না পারে তাহলে নিশ্চিত যে এর ফল ভোগ করবে শত্রুপক্ষের কেউ।

কর্নেল তাহের জাসদ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমি সিপাইদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিতে পারব এবং সেখান থেকে অস্ত্র বের করে আনতে পারব বাইরে। আর বাইরে যদি পিপল রেডি থাকে তাহলে এটি একটি জয়েন্ট আপরাইজিং হতে পারে। জাসদের নেতৃবৃন্দ খানিকটা দ্বিধান্বিত থাকলেও তাহেরের আত্মপ্রত্যয় প্রভাবিত করে তাদের। দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে একটি অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, এরপর জাসদ তার গণবাহিনী এবং অন্যান্য সংগঠনসহ ছাত্র, শ্রমিক জনতাকে এই বিপ্লবে শামিল করবে। এটি হবে সিপাই জনতার বিপ্লব।এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেবেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেল তাহের।

সিদ্ধান্ত হয় পরদিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করা হবে। এর মাধ্যমে অন্যান্য সিপাই এবং অফিসারদের আসন্ন বিপ্লবী উদ্যোগের ব্যাপারে অভিহিত করা হবে। গোপনে বিপ্লবের সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হয়ে গেছে খালেদ মোশাররফ তখনও তার সেনাবাহিনী প্রধানের পদ নিয়ে দেন দরবার করছেন মোশতাকের সঙ্গে। একই সময়ে ০৩ নভেম্বর থেকে নিজ গৃহে বন্দি হয়ে আছেন জিয়া। ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে চাপা উত্তেজনা।

কর্নেল তাহের তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী হাসানুল হক ইনু এবং ছোটভাই আনোয়ার হোসেনকে বলেন, মনে রেখো বিপ্লবটা কিন্তু সিপাহিদের, আমরা তাদের সাফল্যের জন্য যা যা করা দরকার তাই করবো। সিপাহিদের কাজ সিপাহিরাই করবে।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে সিপাহিরা নিজেদের আক্রোশ আর ইচ্ছার কথা লিখে একটা লিফলেট সেনাবাহিনীতে অফিসার দ্বারা নিগৃহিত সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বিলি করেন। এতে লেখা ছিল,সৈনিক ভাইয়েরা, আমরা আর ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে চাই না। নিগৃহীত, অধিকার বঞ্চিত সিপাইরা আর কামানের খোরাক হবে না। আসুন আমরা একটা অভ্যুত্থান ঘটাই। আমাদের এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তন করিবার জন্য হইবে না বরং এই অভ্যুত্থান হইবে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলিয়া সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরাক্ষাকারী একটি বাহিনীতে পরিণত করিব।’

লিফলেটের কারণে সিপাইদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সে খবর খালেদ মোশাররফ পান। এই উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা হিসেবে তিনি খুব দ্রুত বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিপাইদের ঢাকা থেকে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে বদলি করতে শুরু করেন। পাশাপাশি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের খুঁজে বন্দি করারও নির্দেশ দেন তিনি।

৫ নভেম্বর সিপাহীরা তাহেরকে জানান, প্রতিটি মুহূর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ খালেদ মোশাররফ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের বন্দি করছেন, বাকিদের বদলি করে দেবেন ঢাকার বাইরে। তাই খুব দ্রুত কিছু ঘটাতে না পারলে পরে আর করার থাকবে না কিছুই। অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে, ঘটাতে হবে আজই। অভ্যাত্থানের জন্য তারা বেছে নেন ৭ নভেম্বর। ওই তারিখেই লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার চূড়ান্ত বিপ্লবটি ঘটেছিল।

সবদিক চিন্তা করে জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ৬ নভেম্বর এক বৈঠকে কর্নেল তাহের অভ্যুত্থানের বিষয়ে নিজের পরিকল্পনা কথা খুলে বলেন। তিনি বলেন, ‘এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে না থেকেও পরিস্থিতিকে কন্ট্রোল করতে পারব। সেজন্য এই মধ্যবর্তী সময়ে সিপাহী এবং জনগণ সমর্থন করবে এমন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে জাতীয় সংহতি রক্ষা করা দরকার, তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজেদের অবস্থা অনুকূলে এনে তারপর আমরা পাওয়ার নিতে পারি।’

বৈঠকে উপস্থিত নের্তৃবৃন্দ জানতে চান, তিনি এমন কার কার কথা ভাবছেন? তাহের বলেন , আমি জেনারেল জিয়ার কথা ভাবছি। আপনাদের আগেই জানিয়েছি যিনি আমাকে ইতোমধ্যে তাকে মুক্ত করার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। দুই তারিখ রাতে ফোন ছাড়া পরেও এক সুবেদারের মাধ্যমে আমাকে এস ও এস মেসেজ পাঠিয়েছেন। এ মুহূর্তে উনিই সবচেয়ে এক্সেপ্টেবল হবেন। ন্যাশনালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে জিয়ার একটা ইমেজ আছে। জাসদের একটিভিটিজের ব্যাপারে উনি বেশ ভালোমতোই জানেন এবং এ ব্যাপারে সবসময় একটা নীরব সমর্থন তার আছে।

বৈঠকে তাহেরের কাছে জাসদ নেতা কাজী আরেফ জিয়া আমাদের পক্ষে থাকবেন সেটা আপনি কতটা নিশ্চিত? তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জিয়ার অবস্থাটা চিন্তা করে দেখেন। তার ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। তাকে আর্মি থেকে রিজাইন করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বন্দি হয়ে। তাকে মেরেও ফেলতে পারে যে কোন সময়। আমরা তাকে মুক্ত করতে পারলে অবশ্যই তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।
এ পর্যায়ে আলাপ ওঠে অভ্যুত্থান যদি সফল হয়, বিজয়ী সিপাই জনতা কার নামে স্লোগান দেবে। অনেকেই বলেন, অবশ্যই তাহেরের নামে। কিন্তু তাহের আপত্তি করেন। বলেন, ক্যান্টনমেন্টে আমার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আমি আর্মি থেকে রিটায়ার্ড একজন মানুষ তাছাড়া সাধারণ মানুষও জাসদের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানে না। জাসদের কোন পাবলিক ফিগারের নামেই স্লোগান হওয়া উচিত। কিন্তু জনগণের কাছে পরিচিত জাসদ নেতা জলিল, রব, শাহজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। সে ক্ষেত্রে জিয়ার নামে স্লোগান হলেই ভালো। উনি আর্মির লোক, তাকে আমরা মুক্ত করছি তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি আছে।

দশটি রাতের মতোই আরও একটি রাত নামে ঢাকা শহরে। আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত পেরোয়, সেদিন ৭ নভেম্বর। মেজর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করবার দায়িত্ব ছিল হাবিলদার হাইয়ের। তিনি ২০/৩০ জন সিপাহী নিয়ে ‘কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম’ শ্লোগান দিতে দিতে জিয়ার বাসভবনে পৌছে যান। গভীর রাতে টেলিফোনের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাহের যে বাস্তবিকই তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন জিয়াউর রহমান। হাবিলদার হাই জিয়াকে বলেন, কর্নেল তাহের এলিফ্যন্ট রোডে তার ভাইয়ের বাড়ীতে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।খানিকটা দ্বিধান্বিত হলেও জিয়া উঠে পড়েন সৈনিকদের গাড়িতে।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে ফারুক-রশিদের সহযোগী মেজর মহিউদ্দীন এসে জিয়াকে বহনকারী গাড়িটিকে থামান। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মেজর মহিউদ্দীন খুব তৎপর হয়ে উঠেন। সিপাহীরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জিয়াউল রহমান টু ফিল্ড আর্টিলারিতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাইরের কোন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলেন না। জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন, তোমরা বরং কর্নেল তাহেরকে এখানে নিয়ে আস। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা। তাহের এই খবর পেয়ে ইনুকে বলেন, এরা একটা রিয়েল ব্লান্ডার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে।

তাহের টু ফিল্ড আর্টিলারিতে পৌঁছালে জিয়া এগিয়ে এসে তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এসময় জাসদ নেতা ইনু সঙ্গে ছিলেন তাহেরের। জিয়া তাহেরকে বলেন, ‘তাহের ইউ সেভড মাই লাইফ, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।’

তাহের বলেন, আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাইরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম। জিয়া বলেন, ‘‘লেট মি নো হোয়াট নিডস টু বি ডান। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই সবকিছু হবে।’ এরপর তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপে। কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংগঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান। তাহের বলেন, একটা ব্যাপার আমাদের ক্লিয়ার থাকতে হবে যে পুরো বিপ্লবটা করেছে সিপাইরা, এখানে কোন একক পাওয়ার টেক ওভারের ব্যাপার নাই। আমরা এই মুহূর্তে জাসদের সরকার গঠন করতে চাচ্ছি না, আমরা জাতীয় সরকার করতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি একটা সাধারণ নির্বাচন দরকার, রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া দরকার, সৈনিকদের দাবিদাওয়া গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আপনি এখানে একটা ক্রুশিয়াল রোল প্লে করবেন। আগামীকাল আমাদের প্রথম কাজ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা। সমাবেশে আমি এবং আপনি বক্তৃতা দেব। বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারনা দিতে হবে।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও সমাবেশ বক্তৃতার কথা শুনতেই জিয়া বেঁকে বসে। তিনি এতে যোগ দিতে অপারগতা জানান। তাহের বলেন, দেশ একটা সংকট এবং বিভ্রান্তির মধ্যে আছে এ মুহূর্তে জনগণকে সুসংহত করা জরুরি। তাহলে কিন্তু আপনি আপনার কমিটমেন্ট ভঙ্গ করছেন। আপনি বলেছেন আমরা যেভাবে বলব আপনি সেভাবে কাজ করবেন।

জিয়া সরাসরি বলেন, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমি যাবো না। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ইনু বলেন, জিয়া তো কোন কথা রাখবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাহের বললেন, জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আনতে না পারাটা সব পরিকল্পনা এলোমেলে করে দিয়েছে। বিপ্লবের পুরো সেন্টারটা যাতে বাইরে থাকে সেজন্য আমি অভ্যুত্থানের সময় ক্যান্টনমেন্টে গেলাম না। আমি চাচ্ছিলাম অভ্যুত্থানটার একটা সিভিল ডাইমেনশান তৈরি করতে।

রেডিওতেও যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরে ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয় রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। সিপাইদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদ কিংবা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেননি।

এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রীয় ও সেনবাহিনীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়ার আদেশেই সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তারই প্রাণরক্ষক কর্নেল তাহেরকে ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুন জিয়া সরকার গঠিত ১নং বিশেষ সামরিক আদালতে তাহেরকে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ওই আদালত দ্রুততম সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই সেনা বিদ্রোহের ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া এবং চেইন অব কমান্ড ভাঙার দায়ে কর্নেল (অব.) অাবু তাহের দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত ১৭ জুলাই কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্য ৩৩ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদি সাজার রায় ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপতি ১৮ জুলাই এ মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদন করেন। ২১ জুলাই কর্নেল আবু তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পুরো কৃতিত্ব এবং সুফল পুরোপুরি কুক্ষিগত করেন জিয়াউর রহমান, দিনটিকে ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান’-এর বদলে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে শুরু হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত টানা ২১ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে ৭ নভেম্বর দিনটিকে ‘জাতীয় সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ৭ নভেম্বরের সরকারী ছুটির দিন বাতিল করে দেয়।

তথ্যসূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি (মহিউদ্দিন আহমেদ), তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা - লে. কর্ণেল (অব:) এম এ হামিদ এবং বাংলাদেশ রক্তের ঋণ (অ্যান্থনী মাসকারেণহাস)

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৩১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×