বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের নামে কোটি কোটি টাকা গচ্চা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বাংলাদেশ বেতারের ক্ষুদ্র তরঙ্গ অর্থাৎ শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার কেনা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদ এবং সংবাদের প্রতিবাদ ছাপিয়েছে। সঙ্গে প্রতিবাদেরও বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্হাপন করা হয়েছে। উর্দুতে একটি কথা আছে, ‘বাদনাম ভী এক নাম হ্যায়’ এ অর্থে বেতার কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে এ সংবাদে।
দৈনিক জনকন্ঠ গত ২৫ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদে জানায়, বেতার নিয়মনীতি না মেনে শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার কিনছে। প্রয় তিন কোটি টাকা বেশি খরচ করে পছন্দের কোম্পানি থেকে কেনাকাটার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের নামে। ৩০ আগস্ট প্রকল্প পরিচালকের পাঠানো প্রতিবাদলিপি একই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বেশ কৌশলে সাজানো-গোছানো উত্তর দিয়েছেন। যেমনটা সরকারি লোকজন হামেশাই দিয়ে থাকেন। সেই প্রতিবাদের বিপক্ষে প্রতিবেদকের মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পড়ে মনে হয়েছে, প্রতিবেদক বেশ জেনেশুনেই মাঠে নেমেছেন। জানি না পানি কোন দিকে গড়ায়। আশা করা যায়, লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে। আমরা সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। আমাদের প্রশ্ন, শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার দিয়ে বাংলাদেশ বেতার কি করে? কোটি কোটি টাকা খরচ করে ট্রান্সমিটার কেনা, জনবল বয়ে বেড়ানো, বিদ্যুৎ খরচ, শিল্পিদের পেছনে ব্যয়-এক কথায় রাজশ্ব ব্যয় করার পেছনে যুক্তিটা কোথায়? মার্কিন সরকার ভয়েস অব আমেরিকা দিয়ে পৃথিবীতে তার আধিপত্য বজায় রাখার কাজ করে। ডয়েচ ভেলে জার্মান সরকারের মুখপাত্র। এনএইচকে জাপানের কথা বলে। আমরা জানতে চাই শর্টওয়েভ ট্রান্সমিশনের মতর ব্যয়বহুল প্রচারের উদ্দেশ্য কী? আমাদের কোন স্বার্থ সংরক্ষণ বা সম্প্রসারণে এ বেতার তরঙ্গ ব্যবহৃত হচ্ছে?
শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে বাংলাদেশ বেতার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, ভারত, ,ধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় অনুষ্ঠান ও বার্তা প্রচার করে থাকে। ইংরেজী, নেপালি, উর্দু, হিন্দি, আরবি ও বাংলা ভাষায় এসব প্রচার করা হয়। বেতারের অনুষ্ঠান সূচীতেদেখা যায়, প্রচার তালিকায় আছে সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, অর্থনৈতিক পর্যালোচনা, প্রেস কমেন্ট, খেলাধুলা সমীক্ষা, প্যানোরমা, কথিকা, সাক্ষাৎকার, প্যাকেজ, গান, ম্যাগাজিন, ভয়েস অব ইসলাম, উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিয়ে অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এসব অধিবেশনের দৈনিক প্রচার সময় মোট সাড়েপাঁচ ঘন্টা।
বহির্বিশ্ব কার্যক্রম নামে একটি ইউনিট এসব অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্হা করে থাকে। ইউনিটের অর্গানোগ্রামে যেসব কাজের বিবরণ আছে সেগুলো হচ্ছে-
এক. বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা;
দুই. বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্বল করা;
তিন. বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সমাজের সঠিক তথ্য প্রচার করা;
চার. প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য যথাযথ অনুষ্ঠান প্রচার করা।
এ চারটি উদ্দেশ্য পূরণই হচ্ছে বেতারের শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারগুলোর আসল কাজ। যেসব অনুষ্ঠান সূচীতে পাওয়া গেছে সেগুলো কতটা প্রবাসীদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে, তা নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে। মাত্র সাড়ে পাচঁ ঘন্টায় ছয়টি ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানে কতটুকু বাংলা থাকে তা অনুমান করা কঠিন নয়। এতে কতটুক পাবলিসিটি, কতটা প্রোপাগান্ডা বা কতটা প্রবাসীদের কল্যাণ ও বিনোদনের জন্য, তা আলদা করে হিসাব কষে দেখা দরকার। এক্সটার্নাল ব্রডকাস্টং ছেলেখেলা নয়। এখানে পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন থাকতে হবে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় দেশের অর্থনৈতিক, ভৌগলিক, কৌশলগত এবং বানিজ্যিক স্বার্থের সমৱীকরণ থাকতে হবে। এ ছাড়া আছে প্রবাসীদের চাওয়া-পাওয়া হিসাব। এত কিছু কি মাথায় রাখেন বেতার কর্তৃপক্ষ, নাকি কেবল প্রচার সময়ের মধ্যে ‘ফিল-ইন-দি-গ্যাপ’ করে দায়িত্ব শেষ করেন, তা জানা প্রয়োজন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অভিনবত্বহচ্ছে আমাদের কোনো শত্রু নেই। থাকতে পারেনা। কখনোই ছিল না। শত্রু কথাটি অবাঞ্ছিত এখানে। তাই হয়তো ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের ভাষাতেই অনুষ্ঠান প্রচার করছে বেতার। মধ্যপাচ্যওবাদ যাচ্ছে না। ইউরোপ আছে কিন্তু আমেরিকা নেই। এটা অবাক করা ব্যাপার। শত্রু না থাকলেও জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে সম্ভাব্য শত্রু সম্পর্কে একটা ধারনা তৈরী করে থাকেন দেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। সেই শত্রুকে মোকাবিলার একটা নকশাও তৈরী করে গড়ে তোলা হয় প্রতিরক্ষানীতি। এসব কি মাথায় রেখে বহির্বিশ্ব কার্যক্রম অনুষ্ঠান পরিকল্পনা তৈরী করে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্হিতিতে ভয়েস অব আমেরিকা পূর্ব ইউরোপকে টার্গেট করে সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারে রাশ টেনে ধরেছে। এর বদলে বাড়তি নজর দিয়েছে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারে। একই কথা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেতার কি ভাবছে, খুব জানতে ইচ্ছা করে।সে রকম কোনো বিশেষ পরিকল্পনা সেল বেতারে কাজ করে কিনা, তা খোঁজ করে নিরাশ হতে হয়েছে।
বেতারের এক্সটার্নাল সার্ভিস বিশ্বে বাংলাদেশের ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ও জনশক্তি রপ্তানির অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে পারে এ মিডিয়া। ইন্টারএ্যাকটিভ একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারে বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক। দেশে-বিদেশে প্রতিবেদক নিয়োগ করে শ্রোতাদের আপটুডেট রাখতে পারে প্রতিক্ষণ। বাংলাদেশ সরকরের প্রকৃত মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারে এ ইউনিটটি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির যথার্থ তথ্যবাহনে পরিনত হতে পারে বেতারের এক্সটার্নাল সার্ভিস। কিন্তু সে গুড়ে বালি। প্রচলিত রীতি ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করায় বেতার কর্তৃপক্ষের যত উদাসীনতা। একটা জায়গায় শুধু ব্যতিক্রম। ট্রান্সমিটার বা যন্ত্রপাতি কেনার কথা উঠলে দে ছুট।
ট্রান্সমিটার কেনার জন্য প্রকল্প এবং প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু সেই ট্রান্সমিশনের আসল বস্তু প্রচার উপকরন নিয়ে কোনো প্রকল্পের কথা শোনা যায় না কথনোই। নে জন্য ‘ফিল-ইন-দি-গ্যাপ’ তত্ত্ব তো আছেই। চীন সরকারের রেডিওতে নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সেখানে বাংলা ভাষায় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়। জাপান বেতারের জন্য লোক নিয়োগ নেওয়া হয় বাংলাদেশ বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে। জার্মান বেতারেও একই নিয়ম।বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস বা ভয়েস অব আমেরিকাতেও আছে নিজ নিজ ভাষায় কর্মীবাহিনী। শুধু বাংলাদেশ বেতার ব্যতিক্রম। নেপালি, উর্দু, হিন্দি বা আরবি ভাষায় বিশেষজ্ঞ কেউ পাকরি করেন না বেতারে। তার দরকার মনে করে না বেতার কর্তৃপক্ষ।
বিদেশি এসব ভাষায় কী প্রচারিত হচ্ছে, তা বেতার কর্মকর্তারা কতটা বোঝেন জানি না। এরা কেউই ওই ভাষায় দক্ষ ননম এটুকু বাড়িয়ে বলা হয় না। অনুষ্ঠান শিল্পি হিসেবে বিভিন্ন ভাষাভাষী পারফর্মাররা কাজ করেন। তাদের ওপর আস্হা বা বিশ্বাসই হচ্ছে ভরসা। এভাবে একটি সার্ভিস চলছে বছরের পর বছর। এতটা উদাসীন হওয়া বেতারের জন্য কতটা সমীচীন, তা বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা সমাজ বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য খুব দুর্বল। এ ক্ষেত্রে একেক সরকারের সময় একেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুষ্ঠান বা বার্তা প্রচার করে বেতার। বর্হিবিশ্বে দেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এখানেও নিশ্চয়ই হাস্যকর পরিস্হিতি সৃষ্টি হয়। আর প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রোতাদের কথা কতটা এবং কীভাবে ভাবা হয়, তা বলা মুশকিল। কারণ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো শ্রোতা জরিপ হয়েছে বলে জানা যায়নি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সিংহভাগ হচ্ছে শ্রমিক। এবং কিছু আছেন পরিবার পরিজন নিয়ে বিদেশে বসবাসকারী ইমিগ্র্যান্ট। তাদের চাহিদা নিরুপণ না করে কিছু প্রচার হচ্ছে উলুবনে মুক্তা ছড়ানো। বেতার হয়তো ভাবছে, তারা সেরা জিনিসটাই শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার দিয়ে দিচ্ছে আয়নোসফিয়ারে। কিন্তু কে শুনছে বা কেন শুনছে, তা জানার উপায় নেই কোনো। এখানে যন্ত্রপাতির পেছনে ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকার ছিটেফোঁটা খরচ করলে নিশ্চয়ই বেতারের অমঙ্গল হবে না।
তবে দুর্মুখেরা বলতে পছন্দ করেন, বেতারের বহির্বিশ্বে কার্যক্রম তার টার্গেট এলাকায় পৌছে না। হয়তো ইউরোপের জার্মানিতে প্রেরিত বেতার তরঙ্গ আঘাত হানছে মনপুরা দ্বীপে। এ তরঙ্গ মনিটরিংয়ের কোনো কৃৎকৌশল বেতার কর্তৃপক্ষ জানে না বা পরোয়া করে না। কেউ এসব অনুষ্ঠান শুনছে কি না, তা কেউ জানে না। কালেভদ্রে হয়তো কেউ একটা মনিটরিং রিপোর্ট পাঠাল ই-মেইলে বা চিঠির মাধ্যমে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ ব ইউরেকা বলে লাফালাফি। এটুকুর ওপর ভর করে বেতার কোটি কোটি টাকা বাতাসে ওড়াচ্ছে। আর প্রণয়ন করছে আরও কোটি কোটি টাকার প্রকল্প। এতে তিন কোটি টাকা বেশি ভরচ করেছে বলে দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার সংবাদটি আমার কাছে নেহাত বাহুল্য মনে হয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোথ, থলের বেড়ালটি বাইরে টেনে বের করেন। অবাক হবেন, তাজ্জব বনে যাবেন।
মাহবুব হোসেন
এ্যা কালেশন পাবলিকেশন
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন
সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?
আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?
রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন
গরমান্ত দুপুরের আলাপ
মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন