somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুগল কথন - ৪ : ব্রিন আর পেইজের কথা

০৩ রা অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ১০:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ গুগলের প্রতিষ্ঠাতা দুই টগবগে তরুণ। তাঁদের পরিচয় হয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার সময়, আর ঐ সময়েই দুজনে মিলে পেইজর‌্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম লিখেন। পেইজর‌্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিলো ইন্টারনেটের ওয়েবপেইজগুলোর সম্পর্ক বের করা, কোনো পেইজের গুরুত্ব বের করে ঐ অনুযায়ী একটা ক্রম বের করা। ব্যাস, এই পেইজর‌্যাংক অ্যালগরিদমটিই সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের সূচনা করে দেয়। আগের সার্চ ইঞ্জিনগুলো কোন কোন ওয়েবপেইজে অনুসন্ধিত শব্দগুলো আছে, তা বের করতে পারতো, কিন্তু ওয়েবপেইজগুলোর র‌্যাংকিং ভালো ভাবে করতে পারতোনা বলে সার্চের ফলাফল ভালো আসতোনা।

সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের মান অনেক ভালো, এটা বোঝার পরে ব্রিন আর পেইজ গুগলকে একটা স্টার্ট-আপ কোম্পানি হিসাবে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। সিলিকন ভ্যালির অন্য অনেক নামজাদা কোম্পানির মতোই গুগলের যাত্রা শুরু হয় একটা গ্যারেজে, কিছু কম্পিউটার সার্ভার নিয়ে। গুটি কয়েক প্রোগ্রামার নিয়ে শুরু করা সেই গুগল আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে মূল্যায়িত এক মহীরূহে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু, ব্রিন আর পেইজকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। এখনও দুজনে মাটির মানুষ, ভাবভঙ্গীতে সেই পিএইচডি করতে থাকা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রের মতো। গুগলে ইন্টার্নশীপ পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, পুরা গুগলের সবার বস ব্রিন, পেইজ, এবং গুগলের সিইও এরিক স্মিড্‌টকে আদৌ চোখে দেখতে পাবো কি না। বাংলাদেশে অন্য কারো কথা বাদ থাক, বুয়েটের শিক্ষকতা করার সময়েও বুয়েটের ভিসির সাথে দেখা করতে এক দিন ঘন্টা পাঁচেক বসে থাকতে হয়েছিলো। কোম্পানিগুলোর কথা তো বাদই দিলাম ... কোনো কোম্পানিতে সদ্য যোগ দেয়া কেউ কি আশা করতে পারে, কোম্পানির মালিকের সাথে সরাসরি কথা বলা বা বেফাঁস প্রশ্ন করা যাবে?

প্রথম দিনেই ধারণাটা পালটে গেলো, ব্রিন আর পেইজকে দেখে। প্রতি শুক্রবার গুগলে এক বিশাল পার্টি হয়। টিজিআইএফ, অর্থাৎ থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে হলো এই পার্টির নাম। আসলে সোমবার থেকে কাজ শুরু হয়ে শুক্রবার আসতে আসতে মানুষের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, কাজের চাপে মাথা গরম হয়ে থাকে। শুক্রবার আসলে আসন্ন দুই দিনের উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটির আনন্দে শুকরিয়া করে ... তাই থেকেই এই মিটিংটার নাম হয়েছে। যাহোক, এই মিটিং এর মোদ্দা কথা হলো, গুগলের বিশাল ক্যাফেটাতে হাজার কয়েক গুগল ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মী জড়ো হবে, বিশাল একটা খাওয়া দাওয়া চলবে, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিন আর পেইজ গল্প গুজব করবে।

ওখানে হাজির তো অবাক। দেশে থাকতে দেখতাম, কোনো কোম্পানির বড়সাহেব, এমন কি সরকারী কোনো অফিসের জিএম সাহেবের বিশাল ভাব, আর আশে পাশে চামচার দল, অনেক সময় সিকিউরিটির লোকজনের হুমকি ধামকি। সে তুলনায় দুনিয়ার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ২৬ তম স্থানে থাকা ব্রিন ও পেইজকে (প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার করে) দেখে বোঝারই উপায় নেই, ওরাই এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকাংশ শেয়ারের মালিক। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতি শুক্রবার ওরা প্রথমে এই সপ্তাহে কি কি প্রডাক্ট গুগল ছাড়ছে, তার কথা বলে খানিক ক্ষণ। অনেক প্রডাক্ট, যেমন স্ট্রিট ভিউ, মার্কেটে আসার আগেই ভিতরের সবাইকে জানানো হয়। এর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিন ও পেইজের ভাড়ামি চলতে থাকে, অনেকটা "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানের মতো করে দুইজন নানা রকমের রসিকতা করতে থাকে। ব্রিনের জন্ম ও শৈশব কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া সমাজতন্ত্রী শাসনে, সেটা নিয়ে ওকে পেইজ প্রায়ই ঠাট্টা করে। ব্রিনও কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে হাঁসাতে পারে ভালোই।

এর পরেই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে গুগলের কর্মীরা সরাসরি, বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারে ব্রিন, পেইজ, এবং এরিককে। আর এই পুরো ব্যাপারটাই খুব [ইংলিশ]transparent[/ইংলিশ], যে কোনো ধরণের প্রশ্ন যে কেউ নির্ভয়ে বলতে পারে। এমন কি গুগলের কোনো একটা পদক্ষেপ খুব বাজে এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এরকম প্রশ্ন করতেও কোনো বাঁধা নেই। আমি যে কয়দিন এই অনুষ্ঠানে গিয়েছি, দেখেছি গুগলের কর্মীরা প্রত্যেক দিনই এরকম প্রশ্ন করছেন। যেমন, গুগল ভিডিও বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নেয়া হলো, কেনো ইবে কে গুগল খেপিয়ে দিলো, এরকম। অনেক প্রশ্ন এমন, যেন ব্রিন ও পেইজকে রীতিমত জবাবদিহি করতে বলার মতো। ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির মালিকদের এরকম প্রশ্ন করা হচ্ছে, আর প্রশ্ন করছে একেবারে নতুন কর্মীরা? গুগলের চমৎকার পরিবেশে আসলে এটাই খুব স্বাভাবিক।

ব্রিন আর পেইজকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমিও হাতছাড়া করিনি। অনলাইনে যে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা আছে, তাতে শুক্রবার সকাল বেলা প্রশ্ন দিলে বিকাল নাগাদ ভোটাভুটিতে যে প্রশ্ন টিকে যায়, সেটাই করা হয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আমার প্রশ্নটা একদিন প্রথম ১০টি প্রশ্নের মধ্যে আসলো। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের দিকে গুগলের নজর কবে পড়বে, আর গুগল যেসব ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, তাদের মধ্যে ২৫ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা কবে আসবে।

প্রশ্নের জবাব সের্গেই ব্রিন খুব আগ্রহের সাথেই দিলো। বললো, গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা অনেকটা অর্থনীতি ভিত্তিক। বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে, তাই অচিরেই ঐ দিকে গুগল চিন্তা করবে, মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ করবে। আরেকটা ব্যাপার হলো, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেমন, সেটা দেখতে হবে ... বাংলাদেশ থেকে যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের কতজন বাংলায় গুগল সার্চ করেন, ইংরেজি গুগলের বদলে, তাও বিবেচ্য। এসব কিছু বিবেচনা করে অচিরেই গুগল বাংলার উপরে কাজ শুরু করবে।

ব্রিন অবশ্য সিরিয়াস কমই থাকে, আগেই বলেছি। ব্যাগি প্যান্ট আর টি শার্ট পরা ব্রিনকে দেখলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই মাত্র। পেইজকেও তাই। আর গুগলের প্রতিষ্ঠাতা হলেও চামচা বাহিনী নিয়ে ঘুরবে, বা তাঁদের ঘিরে বডিগার্ডের দল থাকবে, তা না। একদিন মজার ব্যাপার হলো, আমি সেদিন গিয়েছি বিল্ডিং ৪৩ এর নো-নেইম ক্যাফেতে। খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো, সামনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম, এটা সের্গেই ব্রিন। মনে হলো, ভলিবল কোর্টে অন্য কর্মীদের সাথে খেলে এসে এখন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য সব সাধারণ গুগল কর্মীদের সাথে।

সিলিকন ভ্যালির সবাই বেশ ইনফর্মাল, তবে গুগলের মতো এতোটা না। ব্রিন আর পেইজের মতো মাটির কাছে থাকা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়, কেনো গুগলের অন্য কর্মীরা এতো উৎসাহের সাথে কাজ করে থাকে। আর এজন্যেই কাজ করার জায়গা হিসাবে ফর্বস ম্যাগাজিনের জরীপে সব কোম্পানিকে পেছনে ফেলে গুগল এখন ১ নাম্বারে।

(ছবিতে বামে সের্গেই ব্রিন, ডানে ল্যারি পেইজ। ছবিটি ২০০৬ সালের গুগল জিও ডেভেলপার ডে তে ডেভিড ম্যাক্লুরের তোলা, এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সে প্রদত্ত্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ১১:০৪
৮০টি মন্তব্য ০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×