তথাকথিত নারীবাদী সমাজের প্রধান সমস্যা হচ্ছে এরা পুরুষদের প্রতিযোগী ভাবে এবং নিজেদের উন্নয়নের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে পুরুষকেই সামনে রাখে। নারী-পুরুষ কখনো প্রতিযোগী না, বরং একে অপরের পরিপূরক এই সহজ ব্যাপারটা তাদের মাথায় ঢুকে না। প্রতিযোগী মনোভাবের কারণে এই অকালতত্ত্বজ্ঞানী নারীবাদী সমাজ কিছু হাস্যকর ধারণা নারীদের মন, মনন এবং মগজে ঢুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন নারী পুরুষ সমান সমান তাই পুরুষ সমাজ যা পারে নারী সমাজও তাই তাই সমানভাবে পারবে। নারী পুরুষের সব কাজ সমানভাবে পারবে এবং পুরুষ নারীর সব কাজ সমানভাবে পারবে এমনটা সত্যি হলে প্রকৃতিতে নারী-পুরুষ দুই প্রজাতির অস্তিত্ব দরকার ছিলো না। প্রাণী সমাজ একলিঙ্গিক হয়ে যেতো। প্রকৃতির উদ্দেশ্য নিশ্চই তা না। নারী তার ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং পুরুষ তার ক্ষেত্র তৈরি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজেদেরকে সেরা এবং পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে তুলে ধরবে প্রকৃতির চাওয়া নিশ্চই এমন। নইলে শুধু পুরুষ কিংবা শুধু নারী পাঠিয়েই মানব সমাজ গঠনের কাজটা খুব হয়ে যেতো!
নারী এবং পুরুষ দুইয়ের অবস্থান সমাজে সমান সমান হওয়া উচিত তা মানি। নূন্যতম বোধ থাকলে সেটা মানতে হয়। তবে সমান সমান হওয়ার প্রচলিত যে মানদণ্ড তাতে আমার আপত্তি আছে। একটা ছেলে বাইরে গেলে, একটা মেয়েকেও বাইরে গিয়ে তার সমান হতে হবে, একটা ছেলে হুন্ডা হাঁকায় চললে তার সমান হতে হলে একটা মেয়েকেও তাই পারতেই হবে এসব বাঁধাধরা মানদণ্ডে কিছু মৌলিক সমস্যা আছে। যদি নারীবাদী সমাজ নারী-পুরুষ সমান সমান বলে ধরে নেয় এবং এই সমান সমান হতে হলে উভয়কেই একই কাজে সমানভাবে পারদর্শী হতে হবে এমন ধারণা নিয়ে বসে থাকে তো তাদের ধারণা আর সমান সমান হওয়ার যে শর্ত তা পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে একটা মেয়ে ছেলেদের মতো সব কাজ সমানভাবে করতে পারলেও একটা ছেলের পক্ষে কখনোই কিছু কাজ করা সম্ভব না। সন্তান ধারণ, লালন পালনের কিছু সাধারণ ব্যাপার সহ অনেক কিছুই একটা ছেলের পক্ষে সম্ভব না। তাহলে সমান সমান হওয়ার শর্তে ছেলেরা কখনোই পেরে উঠে না অর্থাৎ মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে উপরে।
আসলেই কি তাই? আমাদের সমাজে কি এমনটাই সত্য? পুরুষরা নারীদের সব কাজ সমান কিংবা আংশিক না পেরেও যদি নারীর সমান হতে পারে নারীকে কেন পুরুষের মতো সব কাজ পারতেই হবে? সমান হওয়ার এই অদ্ভুত ধারণা কার মাথায় প্রথম আসছে জানি না। আজকে প্রথম আলোয় একটা ছবি দেখলাম, হুন্ডার সামনে মেয়ে, পিছনে ছেলে বসায় নারী উন্নয়নের ধারা বুঝানো হচ্ছে। এখানেও সেই প্রতিযোগীতার মনোভাব। পুরুষের মতো কিছু করতে পারলেই নারী এগিয়ে যাচ্ছে নয়তো না- এই ধারণা মোটেও ঠিক না। এই ধারণা মেয়েদের মনে ঢুকায় দিয়ে একটা কথাই বুঝানো হচ্ছে মেয়ে তুমি ছেলে হও, নয়তো তুমি পিছিয়ে পড়া মানুষ। তুমি হুন্ডা চলাও নয়তো তুমি পিছিয়ে পড়া মানুষ। কেন? হুন্ডা চালাতে পারা, ছেলেদের মতো শারীরিক পরিশ্রম করতে পারা ইত্যাদি একটা মেয়ের গুণ হতে পারে, আপত্তি নাই। কিন্তু এসব না পারলে একটা মেয়েকে পিছিয়ে পড়া মেয়ের তকমা গায়ে দিয়ে দেয়া হবে কেন? আমার মা তো দুই যুগ ধরে সংসারের প্রাণ হয়ে সংসারটা কে নিবিড় যত্নে আগলে রেখে সামনে আগায় নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আর দশটা পরিবারের মা'ও তাই করে যাচ্ছে। হয়তো বাইরে চাকরি করে কিংবা ঘরে মমতার পসরা সাজায়। তাতে আমাদের এই মায়েরা পিছিয়ে পড়া নারী হয়ে গেলো? যে মেয়েটা হুন্ডা হাঁকাচ্ছে সেই শুধু উন্নত নারী, এগিয়ে যাওয়া নারী, আর আয়েশা ফয়েজের মতো রত্নগর্ভা মায়েরা যিনি পুরুষের মতো কিংবা একজন পিতার মতো করে অনেককিছুই করতে পারেন নাই তবে একজন মায়ের মতো করে তার চেয়ে বেশি কিছু করে গেছেন। এরা তো নারীবাদীদের চোখে শুধুই নারী। কারণ এরা পুরুষের মতো করে নিজেদেরকে এগিয়ে নেয় নাই। এগিয়ে নিয়ে গেছে মায়ের মতো, নারীর মতো। মেয়েদেরকে কে বুঝাবে নারী হতে পারা পুরুষ হতে পারা থেকেও অনেক বড় ব্যাপার, অনেক চমৎকার ব্যাপার! তারা নিজেদের নারীত্ব নিয়ে অস্বস্তিবোধ করে, নারীসত্বার মতো শক্তিশালী স্বত্বা আড়াল করে স্বকীয়তা হারায়। নারীবাদী বুলির প্রভাবে নারীসত্বা, মাতৃসত্ত্বাকে নিজেদের দুর্বল সত্ত্বা ভেবে নিয়ে পুরুষের মতো হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে!
নারীদের কি নিজেদের কোন স্বকীয়তা নাই? একজন পুরুষ তো সন্তানধারণে অক্ষমতা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে না। তবে একজন নারী কেন পুরুষের মতো সব কাজ না পারলে হীনমন্যতায় ভুগবে? পুরুষ তার ক্ষেত্রে সেরা, নারী তার ক্ষেত্রে সেরা এমনটা ভাবলে কি খুব ভুল হয়? একজন নারী, পুরুষ যা পারে তা করতে পারলে ভালো, তবে না পারলে সেটা খারাপ, সেই নারী পিছিয়ে পড়া নারী এসব ধারণা বাদ দেয়া উচিত। পুরুষ সমাজ নারী সমাজের অনেক কাজই করতে পারে না, পারবেও না তাতে পুরুষ সমাজের সমান সমান হওয়ায় কোন সমস্যা হয় না শুধু মেয়েদের বেলাতেই সমান সমান হতে হলে ছেলেদের সব কাজ করতে পারার শর্ত চলে আসে! দিস ইজ নট জাস্টিস! নারীরা নারীর মতো অনবদ্য হোক।
নারীবাদী সমাজের জনপ্রিয় বুলি- "নারী থেকে মানুষ হয়ে উঠো" কথাটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীরা বলতে শিখুক- "আমরা নারী, আমরা অনবদ্য। নারীকে মানুষ ভাবতে শেখো"
যেদিন নারীরা সমান সমান হওয়ার খেলায় পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় যাবে না, পুরুষের কাজকে স্ট্যান্ডার্ড মেনে সামনে আগানোর চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেরাই নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে নিয়ে সামনে আগাবে, নারীত্বের গর্ব নিয়ে সেদিনই নারী-মুক্তি ঘটবে। তার আগ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় পুরুষেরাই ঠিক করে দিবে কী করলে নারী এগিয়ে যাবে!