পাঠ: সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৮৯৯ সালে আঁকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অথেনটিক (?) লালন।
সব লোকে কয়
লালন কী জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কী রূপ
দেখলাম না এ নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী লোকের কী হয় বিধান
বামন চিনি পৈতা প্রমাণ
বামনি চিনি কিসে রে।।
কেউ মালা কেউ তসবি গলে
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে
আসা কিংবা যাওয়ার কালে
জাতের চিহ্ন রয় কি রে।।
জগৎ বেড়ে জাতের কথা
গৌরব করি যথাতথা
লালন বলে জাতের ফাতা
বিকাইছি সাধ-বাজারে।
লালনের গানের কথা থিকা লালনরে (১৭৭২-১৮৯০) একটু বোঝনের চেষ্টা করি। লালনের যাপনকারীদের কথা বাদ দিলাম আপাতত। তদুপরি লালনের জাত বা মাহাত্ম্য বাদ দিয়াই শুরু করতেছি। বিকজ, যদি গুরুত্ব আর মহত্ত্বই ধরতে হয় তাইলে তো জাত ধরায়ও সমস্যা নাই। সুতরাং আর আর অ-জাত অ-কুলশীল, অ-মহৎ, অ-বৃহতের লগে যেমন যেমন লালনের লগেও তেমন তেমন, হ্যাঁ?
লালন স্যার কইলেন, “লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।”
তারপরেই উনি জাতের যে যে রূপ নজরে দেখতেছেন তা বলতেছেন: “কেউ মালা কেউ তসবিহ গলে” “সুন্নত দিলে হয় মুসলমান” “বামন চিনি পৈতে প্রমাণ”। লালন এই প্রকারে মোটা গলায় জাতরে আইডেনটিফাই করতেছেন। কিন্তু সুন্নত না দিলে নারীকে “মুসলমান” বলে বুঝতে চাইতেছেন না। বা বলতেছেন, “বামন চিনি পৈতে প্রমাণ বামনি চিনি কী প্রকারে”। পৈতে না থাকলে বামনিকেও আর বামনি বইলা চেনার জো নাই। আদতে কি তাই? বর্গের মধ্যে বসবাসকারীর আরো বহু চিহ্নই তো আছে। তা লালনের নজরে যে পড়ছে তার চিহ্নও লালন তার গানে গানে রাইখা গেছেন।
জাত নয়, জাতের প্রকাশিত চিহ্ন নিয়া এই গান। ধরি, মালা, তসবিহ, পৈতা খুইলা (সুন্নতের কথায় আগাইলাম না, শুনছি ইহুদি জাতের ভাইরা আর আফ্রিকার কোন জাতের বইনরাও নাকি সুন্নত নেন; এনারা সুন্নতের দিক থিকা এক হইয়াও লালনের জাতের সমস্যা মিটাইতে পারেন নাই।) দেখতে শুনতে একান্তই বিনা জাত হওয়া গেল! তাতে কি জাত চইলা যাবে? জাত কি আর কেবল চিহ্নে থাকে নাকি?
তাই লালনের এই গান যতটা না জাত-অজাতের বিরোধ মিটাইতে চায় তার চেয়ে বেশি সকল জাতের প্রতি সেক্যুলার বিরোধিতার জয়গান গায়।
লালন বলতেছেন, “আসা কিংবা যাওয়ার কালে জাতের চিহ্ন রয় কি রে।” বস্তুত, যাওয়া আসার সকল সময়ই জাতের সকল চিহ্নই মানব দেহরে ধারণ করতে হয়। গানের খাতিরে এই সব ব্যাপার অস্বীকার করা যাইতে পারে মনে হয়।
অন্য জাতের ভেদ বা পার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধা বা মাইনা নেওয়ার মধ্যেই জাতের সমস্যার সমাধান আছে। সকল জাতের ভেদ মিটাইয়া চিহ্নহীন কৃষ্টিহীন হওয়ার মধ্যে সেক্যুলার হওয়ার বা আধুনিক খৃষ্টান বা আধুনিক মানুষ হওয়ার বাইরে আর কী কী হওয়ার আছে? বরং “জাতের ফাতা বিকাইছি সাধ-বাজারে” বলার মধ্যে এক ফ্যাসিবাদী নাস্তিকতার দেখা মেলে। সব জাতের চিহ্ন ঘুচাইয়া দেওয়ার আহবানকারী লালনের নিজের লোকরা লালনের মতোই তাদের জাতিচিহ্ন তো ধইরাই আছেন এখনতরি। তাদেরে সাধুবাদ। তারা লালনের গানরে সেক্যুলারদের মতো ইতর বস্তুবাদিতায় পাঠ করেন না হয়তো। নাইলে খিলকা পইরা পরে বামনের পৈতা আর মুসলমানের তসবিহ ছাড়নের কথা বলা যাইতো না।
আমি মনে করি অত্যাচারী হিন্দু আর অত্যাচারী মুসলমানের কবল থিকা বাঁচনের জন্য সেই কালে লালনের এই গানের একটা নিরাপত্তাগত সামাজিক মূল্য আছিল। এই কালে অত্যাচারী খৃষ্টান আর ইহুদিদের হাত থিকা রক্ষা পাইতে হইলে নিপীড়িত মুসলমানের তসবিহ ছাড়াটা কাজের কাজ হবে না। হিন্দুর লগে ইহুদির যেহেতু সামরিক বন্ধুত্ব সাধন হইছেই ওনারা পৈতা আর না পরলেও পারবেন! জয় গুরু।
২৬ নভেম্বর ২০১০
ফেসবুকের একই লেখার লিংক: http://on.fb.me/eqhGuG
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।
ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক
বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন