আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অনেক টাকা এসেছে। তারা এত টাকা পেয়ে পাগল হয়ে গেছে। সেই টাকা দিয়ে ছাগলের মতো কাজ কারবার শুরু করেছে। গাড়ি কিনছে, ফ্ল্যাট কিনছে, বাইক কিনছে, সাত তালা বাড়ি করছে, ইউরোপ ভ্রমনে যাচ্ছে, নামে বেনামে জমি কিনছে। তাদের স্ত্রীরা পাগলের মতো বড় বড় শপিংমল থেকে কেনাকাটা করছে। গত দশ বছরে যত বাড়ি হয়েছে, গাড়ি কেনা হয়েছে, বাইক কেনা হয়েছে, এবং ব্যাংকে যে পরিমান টাকা নামে বেনামে জমা করা হয়েছে এবং যতলোক চিকিৎসার নাম দিয়ে বিনা কারনে বিদেশ ভ্রমন করেছে- এর আগের কোনো সরকারের আমলে এমনটা হয়নি। গত দশ বছরে ধনীলোকের স্ত্রীরা যে পরিমান টাকা পার্লারের পেছনে খরচ করেছে সেই টাকা দিয়ে তিন লক্ষ পরিবার সুন্দরভাবে তিনবেলা খেতে পারতো অন্তত পাঁচ সাত বছর।
গত দশ বছরে দেশে অসংখ্য বড় বড় শপিং মল হয়েছে, অসংখ্য নামী দামী রেস্টুরেন্ট হয়েছে। এসব রেস্টুরেন্টে গেলে মানুষের ভিড়ে পা দেওয়া যায় না। তিনজন মানুষ একবেলা খেয়ে যে পরিমান বিল দেয়, সেই টাকা দিয়ে আমার সংসার একমাস চলে যাবে হেসে খেলে। ইদানিং খুব লক্ষ্য করা যাইতেছে যে, এক শ্রেণির মানুষের হাতে এত টাকা হয়েছে, তারা উন্মাদের মতো টাকা খরচ করছে- দুই হাতে না পঞ্চাশ হাতে খরচ করছে। অফুরান টাকা। বেসুমার টাকা। দশ বছর আগে যে লোক বাজার থেকে ছোট মাছ কিনতো, এখন সেই ব্যাক্তি বাজার থেকে সবচেয়ে বড় মাছ কিনে। যে লোক চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ছুটতো- এখন সে যায় বিদেশ। দশ বছর আগে যে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া বাসায় থাকতো, এখন সে পয়ত্রিশ হাজার টাকা ভাড়া বাসায় থাকে। যে লোকের গ্রামে টিনের ঘর ছিল, এখন সে সেখানে তিনতালা ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছে। দেশ আসলেই উন্নয়নের মহাসড়কে। ভালো ফুটপাত ভেঙ্গে আবার নতুন করে করা হচ্ছে। কাজেই দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে।
আবার গত দশ বছরে এক শ্রেণীর মানুষের কোনো উন্নতি'ই হয়নি। যে রাস্তায় ঘুমাতো- আজও সে রাস্তায় ঘুমায়। যে রিকশা চালাতো আজও সে রিকশা চালায়। দশ বছর আগেও কিছু মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যেত, আজও যায়। দশ বছর আগেও অসংখ্য গ্রামের রাস্তা কাচা ছিল, আজ কাচা। বাশের সাঁকো ছিল, আজও তাই। দশ বছর আগে অসংখ্য প্রাইমারী স্কুল ঘরের অবস্থা খারাপ ছিল, আজও তাই। দশ বছর আগেও গ্রামে গ্রামে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকতো না, আজও তাই। দশ বছর আগে চালের কেজি ছিল পঁচিশ টাকা, আজ ৬৫ টাকা। দশ বছর আগে পাসপোর্ট করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য টাকা দিতে হতো দুই শ', আর এখন দিতে হয় এক হাজার টাকা। সরকারী এমন কোনো প্রতিষ্ঠান কি আছে যেখানে ঘুষ দিতে হয় না? আগে লেখা পড়ার মান ভালো ছিল। এখন লেখা পড়ার মান প্রচন্ড খারাপ। আমার নিজের চোখে দেখা- গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা একটি ছেলে সঠিকভাবে তিন লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না, বলতেও পারে না।
টিভি চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকা দিয়ে ভরে গেছে দেশ। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে এত টাকা হয়েছে, তারা কি করবে ভেবে পায় না। তখন তারা টিভি চ্যানেল দেয়, পত্রিকা বের করে। এবং নিজেদের পত্রিকায় নিজেদের গুনগান করে। বাংলাদেশে যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো কাদের? খোজ নিলে জানা যাবে বাংলাদেশের সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো মন্ত্রী, এমপি অথবা তাদের আত্মীয় স্বজনদের। আর কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে, এগুলোর মালিক রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় থাকা মানুষজনের। বেশ কিছু ছাত্রলীগের পোলাপান আছে তারা এই বয়সেই লক্ষ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। তাদের গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি- কি নেই? তারা স্বপরিবারে বেড়াতে যায় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আর ইন্দোনেশিয়া। আর বিয়ে জন্মদিন বা ঈদের শপিং করতে যায় কোলকাতা। দশ বছর আগে আমার দেখা একলোক তার পরিবার নিয়ে সাত হাজার টাকা ভাড়া বাসায় থাকতো। এখন শুনছি সে গাজীপুর থেকে এমপি ইলেকশন করবে। সে দু কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তার বউ বলে বেড়াচ্ছে, আর কিছুদিন পর আমি হবো এমপি'র বউ।
আমি সারাটি জীবন ঢাকা পার করে দিলাম- আমার তো কোনো পরিবর্তন হলো না। গাড়ি হলো না, বাড়ি হলো না, আধা কাঠা জমিও হলো না। বাজারে গেলে টাকার অভাবে মনের মতো বাজারও করতে পারি না। বিদেশ তো দূরের কথা, সিলেট বা বান্দারবানও যেতে পারি না। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সস্তার হাসপাতাল খুঁজি। কিছু কেনাকাটা করতে হলে, সস্তার মার্কেট খুঁজি। বাজারে গেলে বড় বড় মাছের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস চেপে ছোট মাছ, তেলাপিয়া অথবা পাংগাস মাছ নিয়ে বাসায় ফিরি। মূরগী খাই ফার্মের। গত দশ বছরে একটা দেশী মূরগী কিনতে পারি নাই। জামা কাপড় জুতো সব'ই কমদামী কিনি। জুতো নিয়ে কিছুদিন পরপর ছুটতে হয় মুচির কাছে। কেউ কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেই ভয় পাই। পঞ্চাশ টাকা বাচানোর জন্য এক ঘন্টা হাটি তবু রিকশায় উঠি না। অভাব অনটন আর এক আকাশ দ্রারিদ্রতা নিয়ে জীবন পার করে দিচ্ছি। আর অমানুষের বাচ্চারা চোখের সামনে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে।
গতকালের কথা। শুক্রবার ছিল। বিকেল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। আমার অফিস ছুটি। সুরভি বলল, চলো আজ বাইরে ইফতারি করি। মাসের শেষ হাত খালি। তবু সুরভি'র মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হলাম। পকেটে এক হাজার টাকা নিয়ে বের হলাম। বেইলী রোডের ফখরুদ্দিনে গেলাম। তারা ইফতার মেন্যু দেখালো একজনের, দাম ৪৯৯ টাকা। আমি বললাম একটা দিন। একটাই আমরা দু'জন মিলে খাবো। তারা বললেন, আপনার দু'টা নিতে হবে। দাম পড়বে ৯৯৮ টাকা। ভ্যাট আলাদা। আমি বললাম, একটা দেন। একটাই আমরা দু'জন মিলে খাবো। তারা বললেন, না আমাদের নিয়ম হলো দু'জন দু'টা নিতে হবে। তাদের বুঝিয়ে বললাম, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আর ইফতারীর সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। তারা আমার কোনো কথাই শুনলো না। মাথাটা নিচু করে ফখরুদ্দিন থেকে বের হলাম। তখনও বৃষ্টি সমানতালে পড়েই যাচ্ছে। ওদের ইফতার মেন্যুতে আহামরি কিছু ছিল না। ১টা করে জিলাপী, খেজুর, পিয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, একটা রোস্ট আর হাফ প্লেট কাচ্চি।
শেষে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গেলাম বুমারসে। সেখানে গিয়ে দেখি, ভয়াবহ ভিড়। মানুষজন ছাগলের মতো ইফতার কিনছে। যে খাবার বাইরে থেকে কিনলে আড়াই শ' টাকা লাগতো, সেই খাবার কিনছে সাতশ'/আটশ' টাকা দিয়ে। সাথে ভ্যাট তো আছেই। আচ্ছা, এই ভ্যাটের টাকা কি সরকার পায়? আমি সুরভিকে এক কোনায় কোনো রকমে বসিয়ে, খাবার সংগ্রহ করতে গেলাম। ওদের সেলফ সার্ভিস। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি। মানুষজন পাগলের মতো কিনছে। কিনেই যাচ্ছে। তাদের কত টাকা! আমার মাথাই কাজ করছে না। পকেটে এক হাজার টাকা থেকে আছে নয় শ' পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়েছি। দেখতে দেখতে আযান শুরুর বিশ মিনিট আগেই সব ইফতার শেষ। একজন আমাকে বলল, আপনাকে মিলিয়ে টিলিয়ে কিছু দেই। আমি বললাম, দেন। লোকটা দুই প্লেটে দু'টা চিকেন ফ্রাই, দু'টা জিলাপী, দু'টুকরো নান রুটি, দুই টুকরো শশা দিল। আর দুই বোতল পানি। টাকা দিতে হলো সাত শ' নব্বই (ভ্যাট সহ)। এক গ্লাস জুস নিলাম এক শ' আশি টাকা দিয়ে। খাবারের মান খুব বাজে। আমাদের সাত শ' টাকার খাবার বেশির ভাগ'ই প্লেটেই পড়ে থাকলো। জুসটা আরও বেশি বাজে। নাম দিয়েছে ম্যাংগো। কিন্তু আমের বংশও নেই।
ইফতারী শেষে ভালো করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, যে পরিমান খাবার নষ্ট হয়েছে- সেই খাবার দিয়ে অন্তত তিন শ' ক্ষুধার্ত মানূষ খেতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১:৫৯