অনেকদিন ধরে হিমুর কোনো খোঁজ খবর নাই। তাকে আমার বিশেষ দরকার। তার সন্ধানে পথে নেমেছি। মাজেদা খালার বাসায় গিয়েছি। উনি যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করলেন। নানান বিষয় নিয়ে গল্প করলেন। বেশির ভাগ'ই রান্না নিয়ে গল্প। কিন্তু আমি তার কাছে রান্না বিষয়ক গল্প শুনতে যাইনি। আমি গিয়েছি হিমুর খোঁজে। উনি আমার দেড় ঘন্টা সময় নষ্ট করার পর জানালেন হিমুর কোনো খোঁজ-খবর জানেন না। হিমুর খালু সাহেবের খোঁজে গেলাম ছাদে। উনি বোতল নিয়ে বসে গেছেন। আজ বৃস্পতিবার তার মদ্যপান দিবস। আমি খালু সাহেবকে সালাম দিয়ে বললাম, আমি এসেছি হিমুর খোঁজে। আপনি কি তার ব্যাপারে কিছু জানেন? উনি গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললেন, দুষ্টলোকের আমি কোনো খোঁজ খবর রাখি না। আমি বললাম, খালু সাহেব হিমু মোটেও দুষ্টলোক না। যার মানুষের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা আছে সে মোটেও দুষ্টলোক হতে পারে না। নো, নেভার। খালু সাহেব গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললেন, বিদায় হও। এক্ষুনি বিদায় হও।
এখন যাচ্ছি বাদলের বাসায়। শুনেছি সে এখন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের ফিজিক্স পড়ায়। দেখি সে হিমুর কোনো খোঁজ দিতে পারে কিনা। বেল বাজালাম। বাদলের বাবা আখলাক সাহেব দরজা খুলে বললেন, বাদল বাসায় নেই। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। আমি বললাম, ফুপা আপনি কি হিমুর কোনো খোঁজ জানেন? দীর্ঘদিন যাবত তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমার বিশেষ দরকার হিমুকে। আখলাক সাহেব চোখ মুখ খিচিয়ে বললেন, ও যত দূরে থাকে তত সমাজের মঙ্গল। আমি বললাম, হিমু খারাপটা করেছি কি? আখলাক সাহেব বললেন, আমার একমাত্র সন্তান বাদল তার কারনে অসংখ্যবার বেলাইনে গিয়েছে। আমি আমার সন্তানকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কারো প্ররোচনায় সে ভুল পথে যাক, একজন পিতা হিসেবে আমি তা চাইতে পারি না। আমি আখলাক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে বললাম, আজ যে আপনার ছেলে ইউনিভার্সটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায় তা হিমুর জন্যই সম্ভব হয়েছে। আখলাক সাহেব আমার মুখের উপর ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। যত অপমানই হই হিমুকে আমি খুঁজে বের করবোই। নিজেকে বারবার বলি- 'দেরী হোক, যায়নি সময়।'
রমনা থানায় গিয়ে দেখি হিমুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। আমার ভাগ্য ভালো ডিউটি অফিসার নাজমুল হুদাকে (যদিও তার নেমপ্লেটে লেখা নাজমুল হুদ। দ-এর আকার মুছে গিয়ে হুদা হয়ে গেছে হুদ) পাওয়া গেল। তিনি আমাকে বললেন, আপনি চা খান। দশ মিনিট পর আপনাকে সময় দিচ্ছি। একটু বিজি আছি। যদিও নাজমুল হুদ চায়ের কথা বলেছেন কিন্তু কেউ এখন পর্যন্ত চা দেয়নি। আমি খুব মন দিয়ে থানার কর্মকাণ্ড দেখছি। মনিটরে দেখা যাচ্ছে- হাজতের ভেতর তিনজন আসামী। একজন মনে হয় ডলা খেয়েছে, সে মরার মত ঘুমাচ্ছে। বাকি দুইজন জিম মেরে বসে আছে। অফিসার নাজমুল হুদা কাকে যেন খুব ধমকাচ্ছে মোবাইলে। কাকে ধমকাচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবার মনে হলো তার স্ত্রীকে ধমকাচ্ছে। আবার মনে হলো- কাকে যেন বাজারে পাঠিয়েছে সে কোনো একটা গন্ডগোল করেছে। নাজমুল হুদ প্রায় পনের মিনিট পরে মোবাইল রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, না ভাই আমি হিমুর কোনো খোঁজ জানি না। ব্যাটাকে আমারই দরকার। আমার স্ত্রী আলতা তাকে ছোট ভাই ডেকেছে। আলতা প্রায়ই বলে হিমুকে অনেকদিন দেখি না একদিন নিয়ে আসো। তাকে ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াই।
বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে, সাত মাইল হেঁটে এলাম ময়লা বাবার কাছে। ময়লা বাবা হিমুকে খুব পছন্দ করেন। দেখি উনি কোনো খোঁজ খবর দিতে পারেন কিনা। বাবার একজন মুরিদকে বললাম, ভিতরে গিয়ে বাবাকে বলেন, আমি এসেছি বিশেষ এক দরকারে। আমার ভাগ্য ভালো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাক পড়লো। আজ বাবার মন মর্জি মনে হয় বেশ ভালো। বাবা আমাকে দেখেই বললেন, 'খাবলে খাবলে গু খা।' আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি! বাবা বললেন, কিরে ঘাবড়ে গেছিস? ঘাবড়ানোর কিছু নাই। তোর সাথে মজা করলাম। তুই কেন এসেছিস তা আমি জানি। কিন্তু আমি তোকে কোনো হেল্প করতে পারব না। তুই যেমন হিমুকে খুঁজছিস, আমিও খুঁজছি। হিমুকে আমারও অনেক দরকার। প্রিয় মানুষ গুলোকে কিছু দিন পরপর না দেখলে ভালো লাগে না। আমি বললাম, বাবা আপনার তো অনেক অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে শুনেছি। আপনি একটু ধ্যান করে বলেন দেন না হিমু কোথায় আছে? ময়লা বাবা একটু হেসে বললেন, হিমু যদি সাধারন কেউ হতো তাহলে বলে দিতে পারতাম। হিমু তো সাধারন কেউ না।
আকাশ ভরা মেঘ। ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। দিনের আলো নিভু নিভু করছে। ঠিক এই সময় আমি গেলাম রুপার কাছে। রুপা নিশ্চয়ই জানে হিমু কোথায় আছে। রুপা আজ খুব সুন্দর একটা নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। শাড়িতে ছোট ছোট সাদা ফুল আঁকা। সাদা সাদা ফুল গুলোকে মনে হচ্ছে জীবন্ত। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। রুপা আমাকে চা-নাস্তা দিলো। চায়ের চুমুক দিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। চা টা চমৎকার হয়েছে। ইচ্ছা করছে রুপাকে বলি, আরেক কাপ চা কি পাওয়া যাবে? আমি কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বললাম, আপনি কি হিমুর কোনো খোঁজ জানেন? মুহূর্তের মধ্যে রুপার চোখের কোনায় জল এসে গেল। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, না। আমি রুপার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি সে হিমুকে এক আকশ ভালোবাসে। আমি রুপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম। ঠান্ডা বাতাস বইছে। বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আজ খুব বৃষ্টি হবে। মনে হচ্ছে আজ সারা ঢাকা শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মনে মনে নিজেকে বলছি- হিমুকে আমার খুঁজে পেতে হবে। হবেই।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৮ রাত ১১:১১