সারাদিন অফিস করে শেষে শাহেদ বাসায় না ফিরে চলে গেল পুরান ঢাকায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। কারন আজ বাসায় যাওয়ার জন্য তার কোনো তাড়া নেই। তার স্ত্রী নীলা গেছে বাপের বাড়ি। তিন দিন পর ফিরবে। নীলা বাপের বাড়ি গেলে শাহেদের জন্য রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়। শাহেদ ওভেনে গরম করে খেয়ে নেয়। আজ রাত এগারোটায় বাসায় ফিরলেও কোনো সমস্যা নেই। পুরান ঢাকায় রফিকের কাছে যাওয়া মানে সামান্য হলেও মদ্যপান করতে হবে। তার অনেক টাকা। রফিক বন্ধুদের অভ্যথর্না জানায় মদ দিয়ে। মাঝে মাঝে এক আধদিন খুব মাতাল হতে ইচ্ছা করে। তাই শাহেদ ইচ্ছা মতো মদ খেলো। রফিক কখনও বন্ধুদের দেশী মদ খাওয়ায় না। বিদেশী জিনিস। বোতলের গায়ে লেখা 'ওল্ড স্মাগলার'।
শাহেদ রাত বারোটায় বাসায় ফিরলো। সে পুরো আউট অব কন্টোল। হেলতে দুলতে সে কোনো রকমে ছয় তলায় তার ফ্লাটে এসে সিড়ির লাইট অন করলো। চাবি দিয়ে তালা খুলতে যেতেই দেখে তার স্কুল জীবনের বন্ধু সুলতান সিড়িতে বসে আছে। শাহেদ সুলতানকে দেখে প্রচন্ড খুশি হলো। খুব কাছের বন্ধু। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তাদের সম্পর্ক। শাহেদ ঘরে ডুকলো। তার পেছন পেছন সুলতান হামাগুড়ি দিয়ে বসার রুমে এসে সোফায় বসলো। শাহেদ বলল, দোস্ত আমি খুব খেয়েছি। বসে থাকতে পারছি না। এখন শুয়ে পড়বো। তুই ঘুমিয়ে যা। সকালে কথা হবে। সুলতান মাথা কাত করে শায় দিলো। শাহেদ রুমে এসে জামা কাপড় চেঞ্জ না করেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাত একটা বেজে গেছে। সকালে অফিস আছে।
শাহেদের ঘুম আসছে না। প্রচন্ড মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে। বমি করতে পারলে ভালো লাগতো। হঠাত বসার ঘর থেকে বিকট একটা শব্দ এলো। শাহেদ তার রুম থেকেই বলল, দোস্ত শুয়ে থাক। অনেক রাত হয়েছে। শব্দ করিস না। ঠিক তখন শাহেদের মনে পড়লো- সুলতান মারা গেছে আজ তিন মাস হয়ে গেছে। তাহলে সুলতান তার বসার ঘরে বসে আছে কি করে? শাহেদ দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখতে পায় সুলতান শান্ত ভঙ্গিতে টিভি ছেড়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেল দেখছে। শাহেদ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি করে সম্ভব? মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না। সে মদ খেয়েছে। তাই হেলুসিনেশন হচ্ছে নিশ্চিয়। শাহেদ বেসিনে গিয়ে হরবর করে বমি করছে। সে বমি করে প্রচন্ড ক্লান্ত। বিছানায় শুয়ে পড়লো এবং সাথে সাথে প্রচড গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
ভোরে ঘুম ভাঙল শাহেদের। সে ছাদে গেল ব্যায়াম করলো কিছুক্ষন- এটা তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। রাতের কথা তার কিছুই মনে নেই। ফ্রেশ হয়ে সে চলে গেল অফিসে। অফিসে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। এত'ই ব্যস্ত থাকতে হয় যে, সারাদিনে নীলাকেও ফোন করার সময় পায় না। যদিও নীলা'ই তার জীবনের অনেকখানি দখল করে আছে। আজ অফিস শেষ করে শাহেদ আর পুরান ঢাকায় যায়নি। মদতদ তার খুব পছন্দের জিনিস না। তা-ও ফ্রি পেয়েছে বলেই খেয়েছে। নিজের টাকা দিয়ে কিনে খেতে হলে কখনও খেত না। অফিস থেকে বের হতেই শাহেদের গতকালের ঘটনাটা মনে পড়লো। তার বন্ধু সুলতান এসেছিল। এটা কি বাস্তব না স্বপ্ন? স্বপ্ন তো অবশ্যই। শাহেদের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সুলতান।
আজও শাহেদ বাসায় ফিরে দেখতে পায় সুলতান সিড়িতে বসে আছে। শাহেদ মোটেও তার মৃত বন্ধুকে দেখে ভয় পেল না। বরং তার খুশি খুশি লাগছে। একা থাকতে তার ভালো লাগে না। শাহেদ তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু হামাগুড়ি দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলো সুলতান। দুইজন পাশাপাশি বসলো। শাহেদ বলল, সুলতান এটা কি করে সম্ভব? আমাকে তুই বল। আমার মাথা কাজ করছে না। প্লীজ চুপ করে থাকিস না। সুলতান টিভি দেখছে। তার হাতে রিমোট, সে খুজে খুজে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেল বের করলো। শাহেদ আবার বলল দোস্ত চুপ করে থাকিস না। ঘটনা কি আমাকে খুলে বল? সুলতান শাহেদের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালো। শাহেদের জন্য সে আরামে টিভি দেখতে পারছে না। শাহেদ বলল, চা খাবি? সুলতান কোনো জবাব দিল না।
নীলা বাসায় আসলো। শাহেদের জীবন আবার আগের মতো কাটতে লাগলো। সুলতান নেই। সে আর দেখা দিল না। কিন্তু শাহেদের জীবন থেকে সুলতান চিরতরে বিদায়ও নিলো না। সে প্রায়'ই শাহেদকে দেখা দেয়। কোনোদিন অফিসে সুলতান এসে চুপ করে বসে থাকে। নীলা বাসায় না থাকলে সুলতান আগের মতো আসে। টিভি দেখে। কোনো কথার জবাব দেয় না। শাহেদ এ বিষয়ে কারো সাথে কোনো রকমের আলাপ আলোচনায় যায় না। কারন শাহেদ জানে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার মতো কোনো কথাও না। শাহেদ মনে মনে ভেবে রেখেছে, সুলতান মাঝে মাঝে দেখা দেয়, দিক। সে তো কোনো ক্ষতি করছে না। ভয় দেখাচ্ছে না। এর মধ্যে শাহেদ সুলতানের মা, বোন আর ভাইদের সাথে দেখা করে এসেছে। তার কবর জিয়ারত করেছে।
(সুলতানের মৃত্যু হয় সৌদিতে। মৃত্যুর আগে সে খুব ছটফট করেছে। খুব দাপাদাপি করেছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করে। তার লাশ দেশে আনতে পুরো দুই মাস সময় লেগেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে একজন শ্রমিকের লাশ আনা অনেক দিকদারি। অনেক টাকা খরচ হয়। সুলতান তার এক তিন বছরের ছেলে রেখে গেছে। যে ছেলেকে সে কোনোদিন কোলে নিতে পারে নাই। শুধু ভাইবারে ছবি দেখেছে। সুলতানের দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দেশে ফেরার এক মাস আগে স্ট্রোক করে মারা যায়। বয়স মাত্র পয়ত্রিশ বছর। শাহেদের সাথে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল। সুলতান শাহেদকে বলতো- দোস্ত তুই আমার বন্ধু না। তুই আমার ভাই। শাহেদের অনেক বিপদে সুলতান সবার আগে এসে সহযোগিতা করতো।)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:৩৮