আমার সঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর (আগাচৌ) বিশেষ পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালে। তখন যুদ্ধ চলছে। আমি কলকাতায় কাজ করতাম আওয়ামী
লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘জয় বাংলা’ কাগজে। এর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা। কাগজটা প্রকাশিত হতে পেরেছিল আমাদের মতো কয়েকজনকে নির্ভর করে। পরে এতে এসে যোগ দেন গাফ্ফার সাহেব। প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে বরণ করে নেন। কারণ, তিনি ছিলেন খুবই খ্যাতিমান সাংবাদিক। এই কাগজে কাজ করার মাধ্যমে আগাচৌ’র সঙ্গে বেশকিছুটা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর আজ সে কথাই মনে পড়ছে। তাকে বেশ কাছে থেকে দেখেছিলাম আমি। তার মনে ছিল বিরাট অহঙ্কার। তিনি নিজেকে মনে করতেন ঢাকার শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক। তার এই অহঙ্কারের কারণে ঢাকার আর কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটতে থাকে মনোমালিন্য। সাংবাদিক এমআর আক্তার মুকুলকে একদিন আগাচৌ সম্পর্কে করতে শুনি বিরাট মন্তব্য। আরেক দিন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ অফিসে ঘটতে দেখি তার বচসা। আমার সঙ্গেও একদিন তার দু’কথা হয়। তিনি লিখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের
বিরুদ্ধে। আমি অতটা কড়া ভাষা প্রয়োগের পক্ষে ছিলাম না। আমি বলি, আমাদের কাগজ হলো মুক্তিযুদ্ধের। অহেতুক মার্কিন যুক্তরাদ্ব্রকে আমরা
ঘাঁটতে পারি না। সেটা হবে কৌশলগত ভুল। আমি ছিলাম একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তিনি আমার ওপর চটে যান। কিন্তু আমি আমার মতে দৃঢ়
থাকি। গাফ্ফার সাহেব ‘জয় বাংলা’ কাগজ থেকে বেতন পেতেন। কিন্তু কলকাতা শহরে ওই টাকায় তার সংসার চলত না। তিনি ভাব জমিয়ে ফেলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। কী করে অত অল্প সময়ে তিনি আনন্দবাজার গোষ্ঠীর অত কাছে হতে পারলেন, আমি তা জানি না। যাই হোক, আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমি সংঘাত এড়িয়ে যেতে চাই। কারণ তার অনেক আচরণ আমার কাছে মনে হতো রহস্যময়। যেটা ঢাকা থেকে যাওয়া আর কোনো সাংবাদিক সম্পর্কে আমার মনে হয়নি। যুদ্ধ তখন শেষ হওয়ার পথে। হঠাৎ আমাকে গাফ্ফার সাহেব একদিন প্রশু করেন : আমি বিলেতে যাওয়ার একটি সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু পড়েছি দোটানায়। কারণ আমি ইংরেজি লিখতে পারি না। ইংরেজি ভাষাটি আমার পক্ষে আয়ত্ত করা সহজ হবে? আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, গাফ্ফার সাহেব এত লোক থাকতে আমার কাছে পরামর্শ চাচ্ছেন। আমি তাকে বলি, ইংরেজি ভাষা লিখতে লিখতে আপনার আয়ত্তে আসতে পারে। সেটা নির্ভর করবে সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তি প্রচেষ্টার ওপর। একটা দেশে থাকলে সে দেশের ভাষাটা চলনশীলভাবে আয়ত্ত করে নেয়া কঠিন হয় না। বিলাতে আমি বেশিদিন থাকিনি। ফরাসি দেশে ছিলাম কিছুদিন। ফরাসি ভাষায় কাজ চলা জ্ঞান কিছুটা রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে, গাফ্ফার সাহেব ঢাকার একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। তিনি ঢাকার পাঠ চুকিয়ে লন্ডনমুখী হতে চাচ্ছেন কেন? লন্ডনের খরচ ঢাকার তুলনায় আকাশচুম্বী। অত কি বহন করা তার পক্ষে করা সম্ভব ? নিশ্চয় বিলাতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কোনো চক্র। আর তারা তাকে সেখানে ভালো অর্থই দেবে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। আমি কলকাতা থেকে রাজশাহী ফিরি। যোগ দিই আমার পুরনো চাকরিতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েক বছর পরের কথা, শুনতে পেলাম গাফ্ফার সাহেব বিলাত যাত্রা করেছেন। মাঝে মাঝেই আমি ঢাকায় যেতাম বেড়াতে। একদিন পূর্বদেশ পত্রিকার অফিসে আমার পরিচয় ঘটে একজন তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারি, তিনি গাফ্ফার সাহেবের ভাগ্নে। আপন ভাগ্নে নন। মামাতো বোনের ছেলে। কথায় কথায় আমি বলি, আপনি হয়তো একদিন মামার মতো খ্যাতিধর সাংবাদিক হতে পারবেন। ভেবেছিলাম আমার কথায় তিনি খুশি হবেন। কিন্তু গাফ্ফার সাহেবের ভাগ্নে যা বললেন তার মর্ম হলো, মামা বিখ্যাত সাংবাদিক হলেও আত্মসত্তাবিহীন। অর্থের বিনিময়ে তিনি লিখতে পারেন বহুকিছুই। তিনি আসলে হয়ে পড়েছেন ওই যাকে বলে ভাড়াটে কণ্ঠ। তিনি বলেন, মামাকে কেউ যদি যথেষ্ট টাকা দেয়, তবে মামা যে একটা খারাপ লোক সেটা আমার মামা লিখতে রাজি হবেন। আর লিখবেন খুবই সুন্দর করে। এই হলো আমার মামা।
গাফ্ফার চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে আছেন বিলাতে। জানি না ইংরেজি ভাষা তিনি কতটা আয়ত্ত করতে পেরেছেন। আর বিলাতের সাংবাদিক মহলে তিনি নিজেকে কতটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তবে বাংলা ভাষার সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকে যায়নি। তিনি দেশের কাগজে বিলাত থেকে লেখেন। লেখেন দেশের সমস্যা নিয়েই, যেমন তিনি লিখতেন ঢাকায় সাংবাদিকতা করার সময়। আমার পেশা শিক্ষকতা। অনেক ছাত্রকেই পেশাগত কারণে করতে হয়েছে আমার মূল্যায়ন। স্থাপন করতে হয়েছে আমাকে তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে। গাফ্ফার সাহেবের লেখার মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তার লেখার মান যথেষ্ট উন্নত নয়। তার যুক্তি যোজনে থাকে নানা ত্রুটি। লেখাটা কেবল ভাষার বিষয় নয়, ভাবেরও বিষয়। উন্নতমানের
সাংবাদিকতা নির্ভর করে ভাবের গভীরতারও ওপর। পরিছন্ন চিন্তা ভাষাকে স্বচ্ছতা প্রদান করে। বিলাতের মতো দেশে নামকরা সাংবাদিক হতে গেলে,
যে ধরনের বৈদগ্ধতা থাকা দরকার সেটা তার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। বিডিআর বিদ্রোহ ঘটেছে তার ঢাকায় আসার পর। তিনি ঢাকা এলেন, বিডিআর বিদ্রোহ হলো। কেউ যদি এ থেকে সিদ্ধান্ত করতে চায়, এ বিডিআর বিদ্রোহ ঘটল তার আসার কারণে, তবে নিশ্চয়ই যুক্তিসিদ্ধ হবে না। আসলে কারা আছে বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে, আমরা তা জানি না। এ বিষয়ে কিছু আন্দাজ করাও সম্ভব হচ্ছে না, আপাতত আমাদের মতো মানুষের পক্ষে। তবে আগাচৌকে মন্তব্য করতে শোনা গেল, খালেদা জিয়াকে বন্দি করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তিনি এই সিদ্ধান্তে কী করে আসতে পারলেন সেটা আমরা জানি না। কেবল এটুকু বলতে পারি, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এরকম কিছু করতে যাওয়া হবে খুবই হঠকারী কাজ। আগাচৌ আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার পেয়ে তিনি আবার দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন বিদেশে। গাফ্ফার চৌধুরীকে দেশবাসী কতটা উন্নতমানের সাহিত্যিক বলে মনে করেন আমি তা জানি না। তার সাহিত্যের সঙ্গে আমি পরিচিত নই। একটি কথা আছে, যে সাংবাদিকতা টিকে যায় তাই সাহিত্য। সাহিত্য হলো জীবন নিয়ে সাংবাদিকতা। কিন্তু আগাচৌ আদৌ এরকম কোনো সাংবাদিকতা করতে পেরেছিলেন? অনেক সাংবাদিক সাহিত্য রচনা করে খ্যাতিমান হয়েছেন, যেমন- ষ্টেইন বেগ। ষ্টেইন বেগ সাংবাদিক ছিলেন, কিন্তু আবার লিখেছেন উপন্যাস। পেয়েছেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। একইভাবে নাম করা যায় অ্যার্নিং হেমিংওয়ের। এরা অবশ্য খুবই বড় মাপের লেখক। এদের নাম করছি কেবল এ কারণেই যে, এদের মতো মানুষের জীবিকা ছিল এক সময়ে সাংবাদিকতা। বাংলা ভাষার অনেক পরিচিত সাহিত্যিক তাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে করেছেন সাংবাদিকতা। যেমন কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র। গাফ্ফার সাহেবের মতে বাংলাদেশের বিপদ ঘনিয়ে উঠতে চাচ্ছে ইসলামী জঙ্গিবাদীদের কারণে। তিনি যেভাবে এক্ষেত্রে তার বক্তব্য তুলে ধরতে চাচ্ছেন, সে মিল খাচ্ছে অনেক ভারতীয় পত্র-পত্রিকার সঙ্গে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আসলে কাদের কণ্ঠ। আগাচৌ এখন কাজ করছেন কাদের ভাড়াটে কণ্ঠ হিসেবে?
পৃথিবীর রাজনীতির ধারা পাল্টাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নির্দেশনামায় বলা হচ্ছে, জঙ্গি ইসলাম শব্দটা আর ব্যবহার করা যাবে না। কারণ যে
কোনো ধর্মের মানুষই জঙ্গি হতে পারে। ইসলামের সঙ্গে জঙ্গি বিশেষণটা যোগ করলে অহেতুক মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করা হয়। জঙ্গিরা জঙ্গিই। তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কিন্তু তা বলে এই লড়াইকে কোনো ধর্মবিশেষের সঙ্গে যোগ করা ঠিক হবে না। জঙ্গি ইসলাম বললে অপ্রয়োজনে গোটা মুসলিম বিশ্বকেই ক্ষুব্ধ করা হয়। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন প্রায় একই রকম কথা। তিনি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কথাটা ব্যবহার করতেও হচ্ছেন নারাজ। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসীদের দমন করতে হলে সেটা করতে হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। যুদ্ধ করে সমাধান আসবে না। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরী দেশে এসে জঙ্গি ইসলামের বিপক্ষে যুদ্ধের ডাক দিয়ে গেলেন। আগাচৌ’র লেখায় অনেক হুঙ্কারধ্বনি থাকে। কিন্তু ব্যক্তি আগাচৌ আসলে তেমন সাহসী ব্যক্তি নন। ১৯৭১ সালে একটা খুব ছোট ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। আগাচৌ পত্রিকার অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন তার আস্তানায় ফেরার জন্য । ঘটনাচক্রে ওই দিন আমিও একই সঙ্গে বেরিয়েছিলাম আমার ডেরায় ফেরার লক্ষ্যে। পথে কিছু মাতাল মাতলামি করছিল। আগাচৌ আমাকে অনুরোধ করেন, তার সঙ্গে কিছুদূর একত্রে যেতে। আমি তার অনুরোধ রক্ষা করেছিলাম।
Click This Link