somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেইনা -২: একটি প্রেমের গল্প

১৯ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ৭:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রেইনা (২)
ডঃ রমিত আজাদ
রেইনা - ১ : এই লিংকে পাবেন
Click This Link


ইংরেজীতে একটি শব্দ আছে 'কোইনসিডেন্স'- এর বাংলা অনুবাদ ’ কাকতালীয়’। অর্থাৎ কাক এসে তাল গাছের উপর বসল, আর সাথে সাথে একটি তাল পরে গেল। এর মানে কি এই যে কাক এসে গাছের উপর বসল বলেই তালটা পরে গেল? নাকি তালটা পরবে জেনেই কাকটা এসে বসেছিল? আসলে দুটোর কোনটাই না। কাক কাকের মত এসে বসেছে, তাল তালের মত পরেছে। তবে ঘটনা দু'টো বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটেছে একই সাথে। এ জন্যই এই ভাবে ঘটে যাওয়া দু'টো সমকালীন ঘটনাকে বলা হয় কাকতালীয়।
থিওরী অফ প্রোবাবিলিটির অংক পড়াতে গেলে তাসের কিছু অংক চলে আসে। ক্লাসরূমে ছাত্র যেমন থাকে ছাত্রীরাও থাকে। ছাত্ররা ৫২টি তাসের সাথে পরিচিত। ছাত্রীরা নয়। তাই ছাত্রীদের তাসগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। আমি বললাম, "আপনারা ছাত্রীরা তো তাস খেলতে পারেননা, তাই তাসের সাথে পরিচিতও নয়, আমি আপনাদের তাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি”।" হঠাৎ একজন ছাত্রী বলে উঠল,"আমি তাস খেলতে পারি”।" সাথে সাথে আরো কয়েকজন ছাত্রী তার সাথে সুর মেলালো। আমি অবাক হলাম। যুগ তাহলে পাল্টেছে। এখন অনেক বাঙ্গালী মেয়েও তাস খেলতে পারে।
আমার বহু বছর আগের এশটি মুখচ্ছবি মনে পড়ল, 'রেইনা'’। হ্যাঁ রেইনাও তাস খেলতে পারতো।

আজ থেকে একুশ বছর আগে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের জর্জিয়ায় ল্যাংগুয়েজ কোর্সের ছাত্র ছিলাম, তখন দক্ষিণ আমেরিকার মেয়ে রেইনা ছিল আমার বান্ধবী। দারুন সুন্দরী আর অসম্ভব বুদ্ধিমতি এই মেয়েটি তাস খেলতে পারতো তুখোর। ল্যাংগুয়েজ কোর্সের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শেষে বিশ দিনের মত ছুটি ছিল। ক্লাস যেহেতু নেই তাই কাজের কাজ কিছুই নেই। দিনের বেলায় শহরের পার্কগুলোতে ঘুরতাম। শহরে পার্ক অনেকগুলো। প্রতিটি পার্কই অপূর্ব। শহরটাতে অপরূপ পার্কগুলো সেই সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুনে। এমনিতেই সোভিয়েতদের রুচিবোধ প্রশংসনী। তাছাড়া স্থাপত্যশিল্পে একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো 'রাশান কনস্ট্রাকটিভিজম' ১৯১৩ সালের দিক থেকে এর শুরু। রুশরা প্রতিটি ভবন নির্মাণ করতে শুরু করে এমন এক অদ্ভুদ স্থাপত্য শৈলীতে যে এক একটা ভবন দেখতে হয় এক একটি ভাস্কর্য্যের মত। দিনের বেলায় আমাদের নগরীর এসব সৌন্দর্য্য দেখেই কাটতো। আর রাতে কোন কাজই থাকত না। কোন কোন রুমে চলত জমিয়ে আড্ডা আর কোন কোন রূমে চলত তাসের আসর। রেইনা তাস বেশ ভালো খেরত। তবে আমাদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় স্পেকট্রাম খেলাটি ও জানত না। খুব সম্ভবত: ওদের দেশে খেলাটির প্রচলন নেই। আমি ওকে শিখিয়ে দিলাম। দু' একদিনের মধ্যেই দেখলাম ওর কোন জুড়ি নেই। আসরে বসলে একের পর এক গেম ওই জিতে যাচ্ছে। অনেকে বলত, "তোমর বান্ধবীকে জুয়াড় আসরে বসালে, ও সবাইকে ফতুর করে ছাড়বে”।” "না ভাই জুয়াখেলার মধ্যে নেই আনন্দের জন্য খেলি”, আমি বলতাম। আর রেইনা বলত’ জীবনটিই একটা জুয়া খেলা, ভাগ্য আর বুদ্ধির সমন্বয় সাধনের অবিরাম ক্রিড়া”।

সেমিস্টার ব্রেকের ছুটি শেষ হয় এমন সময়ে ভাবলাম বড় একটা আনন্দানুষ্ঠান করা দরকার। কি করা যায়? কি করা যায়? ঠিক করলাম পিকনিক করব। সিনিয়রদের কানে কথাটা যেতে তারা হা হা করে হাসলেন বললেন, বাংলাদেশে পিকনিক হয় শীতকালে। আর এদেশে হয় গ্রীষ্মকালে। তাওতো ভালো জার্জিয়া, তুহীন শীত নয়। মস্কোতে গিয়ে দেখ মাইনাস দশ / পনের টেমপ্যারেচার। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আর আমরা সবাই ১৮/১৯ বছরের টগবগে তরুন-তরুনী ঐ বয়সের উদ্দামতায় কোন বাঁধাই বাঁধা থাকে না। যেমন ভেবেছি তেমনই করব। পিকনিক করব। ঘটা করে মিটিং করলাম। বাজেট ঠিক করলাম। দশ রুবল করে চাঁদা ঠিক করা হলো। এবার প্রশ্ন উঠল, শুধু কি আমরাই যাব? গেস্ট নেয়া যাবে না? একজন বলল ইন্ডিয়ান বাঙালী মেয়ে শর্মিলাকে নেয়া উচিত, ওতো আমাদেরই একজন। আবার দু’ একজন বলল হোক বাঙালী, ইন্ডিয়ান তো। কিছুক্ষণ বাক-বিতন্ডার পর ঠিক হলো ওকে নেয়া হবে। এরপর বান্ধবী প্রসঙ্গ। সবাই আমার দিকে তাকালো। লিজা বলল, ”বান্ধবী এ্যালাউ করা উচিত”। অনেকেই হেসে উঠল। এরপর ঠিক করা হলো কেউ যদি বান্ধবী নিতে চায়, নেয়া যাবে। আর অনেকে ঠাট্টা করে বলল, "আর তোমরা বাঙালী মেয়েরা যদি বন্ধু নিতে চাও নিতে পারবে”।" বেশ কয়েকদিন যাবৎ পিকনিকের যোগাড়-যন্ত্র হলো। টাকা-পয়সা সংগ্রহ করা, প্লান-প্রোগ্রাম করা। কাকে কি দায়িত্ব দেয়া হবে ঠিক করা হলো। আমার আর রেইনার দায়িত্ব পড়ল টাকা-পয়সা সংগ্রহ ও বাজেট নিয়ন্ত্রন। নাসিমকে দেয়া হলো বাজারের দায়িত্ব। পিকনিকের আগের দিন ওর হাতে একশত রুবল দিয়ে বাজারে পাঠালাম। ওর সাথে আরো তিনজন গেল। শক্ড হলাম ও ফিরে আসার পর। সন্ধ্যার দিকে ওরা ফিরে এলো। চেহারা দেখে মনে হলো বিধ্বস্ত অবস্থা। প্রশ্ন করলাম, "কি হয়েছে?"নাসিম উত্তর দিল, "বাজেট ফেল করেছে।” "সেকি বাজেট ফেল করবে কেন?" এদেশে সবই তো চুলচেড়া হিসেব করা। প্রতিটি জিনিসের দামই তো আজ বহু বছর ধরে ফিক্সড । নাসিম বলল, ” মুরগীর মাংস ও দামী অনেক খাবারের আইটেমই দোকানে পাওয়া যায়নি। আমরা নিরূপায় হয়ে বাজারে যাই। আর সেখানে সব কিছুর দাম দুই থেকে তিনগুন। ” আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এরকম একটা ঘটনা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটতে পারে আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি। আসলে ঐ ছিল সোভিয়েত অর্থনৈতিক সংকটের শুরু।

নির্দিষ্ট দিনে গেলাম পিকনিকে। দিনটি ছিল রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাসীন কমুনিষ্ট পার্টি যদিও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে ধর্মহীনতার বিষবাস্প, কিন্তু ঐ সমাজতন্ত্রের আলখেল্লায় খ্রীষ্ট ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা কিছুটা হলেও ছিল। তাই খ্রীষ্টানদের পবিত্র দিন রবিবারই ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মুসলিম প্রধান রিপাবলিকগুলোকেও ঐ নিয়ম মেনে চলতে হতো।

পিকনিক স্পট আগে থেকে সিলেক্ট করা ছিল। শহরের বাইরে পাহাড়ে ঘেরা একটি ঝকঝকে পাহাড়ী হ্রদ।ক্ষেত্রফলে বিশাল বলে ওরা তার নাম দিয়েছে ”তিবিলিস্কোয়ে মোরে” অর্থাৎ তিবিলিসির সাগর। তিনটি ট্যাক্সি ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম হ্রদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক। তিনি প্রশ্ন করলেন, ” তিবিলিসি সাগর কেন? বেড়াতে যাবে?” উত্তর দিলাম , ”জ্বী”
"এটা কি ওখানে বেড়াতে যাওয়ার সিজন? ওখানে যেতে হয় গ্রীষ্মকালে।"
"আমরা তো আগে কখনো যাইনি। অনেক শুনেছি ঐ হ্রদের সৌন্দর্যের কথা। ছুটি পেলাম যাই ঘুরে আসি।"
আনন্দ করতে পারবে বলে মনে হয় না। বৃদ্ধের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো।
খুব মন খারাপ করছে। হয়তো ভাবছে আহা বেচারারা একটা আনন্দের জায়গায় যাচ্ছে, নিরানন্দ সময়ে।

আমাদের তখন কাঁচা বয়স। অত কিছু কি আর ভাবি। গাড়ী শহর ছাড়িয়ে বাইরে আসতেই অপরূপ প্রকৃতির শোভায় মন ভরে গেল। উচুঁ উচুঁ পর্বত আর তার গায়ে থরে থরে গাছ। রেইনাকে প্রশ্ন করলাম, কেমন দেখছ? ও মৃদু হেসে বলল,
ঃ তোমরা সমতল ভূমির মানুষ তাই তোমাদের জন্য এই দৃশ্য দুর্লভ। আমার কাছে কিন্তু নতুন কিছুই না। আমার বাড়ী আন্ডিজ পর্বতমালার উপর। ককেশাস পবর্তমালার চাইতেও অনেক উচুঁতে। তবে পার্থক্য এই যে, এখানেকার পাহাড়গুলো বন-বনানিতে ছেয়ে সবুজ। আর আমাদের পর্বতগুলো বৃক্ষহীন, কঠিন পাথরের শক্ত ভিতে একেবারেই রুক্ষ।

বৃদ্ধ ট্যাক্সি ড্রাইভার লক্ষ্য করল আমরা রুশ ও ইংরেজী মেশানো ভাষায় লক্ষ্য করছি। প্রশ্ন করল
ঃ তোমার বান্ধবী কি, তোমার দেশী নয়।
ঃ না।
ঃ তুমি কোন দেশের।
ঃ বাংলাদেশ।
ঃ তোমার বান্ধবী?
ঃ বলিভিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা।
ঃ ও আচ্ছা, ’ ইন্ডিয়াংকা।
রশীরা ’ ইন্ডিয়াংকা বলতে নেটিভ অ্যামেরিকানদের বোঝে। আর ভারতীয়দের বলে 'ইন্দুস'’।
কিছুক্ষণ পর 'তিবিলিস্কোয়ে মোরে’ এসে পৌঁছালাম। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে নয়ানাভীরাম হ্রদটির দিকে তাকিয়ে আছি, আর এদিকে বৃদ্ধ ট্যাক্সি ড্রাইভার আক্ষেপ করে বলছে, "দেখতো কান্ড, সবকিছু বন্ধ, একটি জনমানবও নেই। শীতকালে কেউ এখানে আসে?"

আমাদের অন্যান্য বন্ধুরা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। আমাদের দেখে হৈ চৈ করে ছুটে এলো। বৃদ্ধ ট্যাক্সি ড্রাইভার অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, কি অদ্ভুত এই তারুণ্য। শীত হোক শৈত্য হোক তারুণ্যের উম্মত্ততার কাছে কোন বাধাঁই বাঁধা নয়।

যদিও ঠান্ডায় কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। তারপরেও হৈ হুল্লোড়, হাসি- আনন্দের মধ্যে দিয়ে চমৎকার কেটেছিল দিনটি।শুধুই কি চমৎকার? বিশেষণ বোধ হয় কম ব্যবহার করলাম। তারুণ্যের উচ্ছাস, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা, রেইনার মিষ্টি চোখের তীব্র আর্কষণ সবকিছুর সমন্বিত রূপই তো সৃষ্টি করেছিল মনে রাখার মত দিনগুলি।

চেংগিস খান আর তৈমূর লং এর রাজ্য জয়ের নামে রক্তের হোলি খেলা, পিউরিটানিষ্ট প্রোটেষ্টান্টদের সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাস, পলাশীর ট্রাজেডির পরপরই ভয়াবহ দূর্ভিক্ষে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ আফ্রিকার মুক্ত বণভূমি থেকে ধরে নিয়ে এসে আমেরিকার খাচা বন্দি করা শত শত কালো মানুষদের হাহাকার। পৃথিবীর উপর দিয়ে দুঃস্বপ্নের মত বয়ে যাওয়া দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব, এই সবই ভালোবাসাহীনতার কাহিনী। কিন্তু, তার পরেও পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে। গ্রীস ও ট্রয়ের নিষ্ঠুর যুদ্ধে মধ্যেও একিলিস ও ব্রিসেইস এর মধ্যে প্রেম হয়েছিল।

আমার ও রেইনার দু’জনেরই তখন কাঁচা বয়স। ম্যাচুরিটি বলতে যা বোঝায় সেটা তখনও আসেনি। পরবর্তি জীবনে বুঝতে পেরেছিলাম, ম্যাচিউরড্ মানব-মানবীর সম্পর্কের মধ্যে ডোমিনেটিং হয় দেহের তাপ। আর ঐ বয়সে আমাদের দু’জনার সম্পর্কের মধ্যে ছিল হৃদয়ের উত্তাপ।
কিছুদিন পরের কথা। আফসানার জন্মদিন। আমরা আগে থেকেই জানতাম। বিদেশ - বিভূঁয়ে, এই প্রথম ও পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজনহীন জন্মদিন পালন করবে। ওর মনে যেন কোন কষ্ট না হয আমরা সেই চেষ্টাই করব।

আপনজনদের অভাব যেন ও বুঝতে না পারে সেই প্রচেষ্টাই থাকবে আমাদের। শীত গড়িয়ে তখন বসন্ত আসবে আসবে করছে। শীত আর বসন্তের পার্থক্য কতটুকু বাংলাদেশে এটা বোঝা যায় না। ইউরোপে এই ব্যবধান তীব্র। শীতে যেখানে পুরো দেশট বরফে ঢেকে যায়, পাহাড়-নদী, গাছপালা এমনকি মানবকুলও তুহীন শীতে জমাট বেধে যায়। বসন্তে সেখানে বাতাসের উষ্ণতা, কোকিলের কন্ঠের মতই সুমধুর হয়ে ওঠে। পত্র-পল্লবহীন গাছগুলোর নেড়া ডালপালা থেকে একটু একটু করে কিষলয় উঁকি দিতে থাকে। সেই সবুজের মমতার ছোঁয়া মানুষের মনকে যে কতটুকু উৎফুল্ল করে তুলতে পারে, ইউরোপে বসন্ত না কাটালে তা কখনোই হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। আমরা বাংলাদেশীরা ভাগ্যবান চির সবুজ দেশে আমাদের জন্ম। যারা কোনদিনই শৈত্যপ্রবাহের ইউরোপ অথবা রুক্ষ মরুভূমির মধ্রপ্রাচ্য দেখেনি, সবুজের রিক্ততার বেদনা তারা কোনদিনই বুঝতে পারবে না। তাই আমরা গাছের মর্যাদা বুঝিনা। বিনা কষ্টে, বিনা খরচে পাওয়া বৃক্ষরাজির ধ্বংষযজ্ঞে আমাদের উৎসাহের ভাটা পরে না। যাহোক, বসন্তের উৎফুল্লতায় আমরা মহা আনন্দে আফসানার জন্মদিনের উৎসবের যোগার-যন্ত্র শুরু করলাম সকাল থেকেই। কেউ বাজার করল, কেউ রান্না করল, কেউ ঘর সাজালো। সবার এত মমতা দেখে, অভিমানী আফসানাও আনন্দে কেঁদে ফেলল, "তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো!” আসলে বিদেশের মাটিতে আসলে সবাই সবার খুব আপন হয়ে যায়। আমি আফসানাকে বললাম, "কেক কাটার অনুষ্ঠানে রাজকূমারীর মত সেজে হাজির হয়ো”। আফসানা কপট হেসে বলল,
ঃ তোমার বান্ধবী রেইনার মতো সুন্দরীতো আর আমি নই। রাজকূমারী সাজব কি করে?
ঃ আফসানা, যার হৃদয়ে তুমি আছো, তার কাছে তুমি কেবল রাজকূমারীই নও একেবারে মনের রাণী।
ঃ উপহাস করোনা তো। আমি এখনও কারো মনের রাণী নই।
ঃ তুমি তো জান এদেশে বাংলাদেশী ছাত্রী কম। তাই ছাত্রদের সব সময়ই নজর থাকে জুনিয়র ছাত্রীদের দিকে।
ঃ না, থাকে না। তোমরা বাংলাদেশী ছাত্ররা বড় ত্যাঁদোর, তাকাও কেবল বিদেশীনিদের দিকে।

আমি একটু দমে গেলাম। আমি জানি, শুধু বাংলাদেশী না, অন্যান্য দেশের ছাত্রদের মধ্যেও এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছি, দেশী মেয়ে তো দেশেই কত আছে। বিদেশে যতদিন আছি, ততোদিন বিদেশীনিদের সান্নিধ্যই উপভোগ করি। তবে আমি তো সেই দৃষ্টি দিয়ে রেইনার দিকে তাকাইনি। আফসানা কি তা বোঝে না? আফসানা বোধ হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলো।
ঃ থাক থাক মন খারাপ করোনা। আমি তোমাকে মিন্ করছি না। এবার বলতো কি পড়লে আমাকে ভালো লাগবে?
ঃ শাড়ী। বাঙালী মেয়েদের শাড়ীতেই সব চাইতে সুন্দর মানায়।
সন্ধ্যার দিকে বেশ আয়োজন হলে।

হোষ্টেলে ’ ইন্টারক্লুব’ নামে একটা জায়গা আছে এর অর্থ ক্লাব বলা যায়। আমরা বাংলাদেশী বাঙালীরা তো ছিলামই, তাছাড়া কিছু ইন্ডিয়ান এবং আফসানার গ্রুপমেইট অন্যান্য বিদেশীরাও ছিল। ইন্টারক্লুবে কিছু জর্জিয়ান ও রুশ মেয়ে ছিল, তাঁরা ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ছাত্রী। আমাদের ভাষা শিক্ষায় সাহায্য করতেন তাঁরা। তাঁরাও এসেছিলেন আফসানার জন্মদিনে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল এইভাবে। সন্ধ্যার দিকে সবাই উপস্থিত হলাম ইন্টারক্লুবে। একটু পরে যার জন্য এই সব আয়োজন সেই আফসানা প্রবেশ করল ক্লাবের দরজা দিয়ে। ওর সাজ-পোষাক হঠাৎ করেই যেন সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। নীল রঙের উপর নানান কারুকাজ খচিত চমৎকার একটি শাড়ী পড়েছে আফসানা। আফসানাকে আগে আমরা নানা পোষাকে দেখেছি। ইউরোপীয় সমাজের প্রভাব ও আবহাওয়ার কারণে আধুনিক পোষাকেই ওকে দেখেছি বেশী। মাঝে মাঝে সালোয়ার-কামিসেও দেখেছি। কিন্তু শাড়ীতে দেখলাম এই প্রথম। আমার কথাই ঠিক মনে হলো। বাঙালী মেয়েদের শাড়ীতেই সব চাইতে বেশী মানায়।

ঃ চমৎকার তোমাদের এই পোষাকটি!
আমার পাশ থেকে বলে উঠল রেইনা।
ঃ তাই?
ঃ হ্যাঁ। এই পোষাকে একজন নারীকে, নারী বলেই মনে হয়।
ওর দিকে তাকালাম আমি, চমৎকার বলেছো তো। এরকম ভাবে তো কখনো ভাবিনি। তাইতো নারী নারীর মত হবে, পুরুষ পুরুষের মত হবে। নারী পরবে নারীর পোষাক। পুরুষ পরবে পুরুষের পোষাক। নারী যদি পুরুষের পোষাকই ব্যবহার করতে শুরু করে আর পুরুষের মত খাটো করে চুল ছাটে, তবে কি নারীর কমনীয়তা তার মধ্যে থেকে হারিয়ে যাবে না? নারী পুরুষে পার্থক্যই যদি না থাকে তবে নারী পুরুষের আকর্ষনই বা থাকবে কি করে।

রেইনার শিরায় কয়েক হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতার স্রষ্টা ইনকাদের রক্ত আর মুখে স্প্যানিশ ভাষা। বৃটিশ শাসনের ইতিহাস পড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি চাপা ক্রোধ আমার মনে সবসময়ই জ্বলত। রেইনাকে বলতাম, ” সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা তোমাদের মুখে কেন? ওটাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারো না?” রেইনা হেসে বলত, ”মানুষ অপরাধ করে, ভাষা অপরাধ করে না। ভাষার উপর রাগ রাখতে নেই। সব ভাষাতেই রচিত হয়েছে শ্বাশত অনুভূতির কাব্য। ফর ইওর বেটার ইনফরমেশন, আমি কেচুয়া ভাষাও পারি”। কেচুয়া বলিভিয়ার প্রাচীন ভাষা।
আমাদের মধ্যে কথপোকথন হতো বিদেশী ভাষায় কিন্তু আমরা এত বেশী ঘনিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম আর আমাদের আলোচনার গভীরতা এত বেশী হয়ে গিয়েছিল যে মাঝে মাঝে মনে হতো ওর মুখে যেন বাংলা কথাই শুনছি। আফসানার অভিযোগ কতটুকু সত্যি, আমরা দেশিনীদের নিয়ে উচ্ছাস করি না, আর বিদেশিনীদের নিয়ে উন্মত্ত হয়ে যাই। দেশের বাইরে এসে, অর্ধেক পৃথিবীর মানুষের সান্নিধ্যে এসে একটি সত্য আমি উপলদ্ধি করতে পেরেছি - দেশ-বিদেশ আমাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি ও ক্ষমতা লিপ্সার অস্বস্তিকর সৃষ্টি মাত্র। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির সমগ্রটাই আমাদের দেশ। মানব-মানবীর বিশুদ্ধ অনুভূতিগুলো ও হৃদয়- বোধে জাতি-ধর্ম-বর্ণের বাধা পেরিয়ে অভিন্ন ও এক সত্তায় লীন।

বাগেবী স্টুডেন্টস টাউনের ডরমিটরির তিনতলায় ব্যালকনি থেকে ককেশাসের ঢালে ঢালে গড়ে ওঠা তিবিলিসি শহরের অসংখ্য বাতির তীব্র আলোর ঝলমলানি স্বপ্নপূরী রচনা করে। সেই স্বপ্নপূরীর সামনে আমরা একে অপরের হাত ধরে বসে থাকি। রেইনা কবিতা ভালোবাসে, মাঝে মাঝে স্প্যানিশ ভাষায় কিছু কবিতা আমাকে শোনায়। আমি বেশী ভালোবাসি গান, তই আমার গানের কলি মনে পড়ে, কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, রাতের নির্জনে .. .. .। নারীদেহের রূপ লাবণ্য যদি নিখুঁত ও পরিমিত হয়। যে কোন পুরুষই তখন সেই সৌন্দর্য্যরে তপ্ত মাধুর্য অনুভব করতে চায়। মেয়েরা তাদের সহজাত দৃষ্টি - বুদ্ধি দিয়ে সেদিক থেকে সাবধানী থাকে। তবে এ সবই পরিণত বয়সের দাবী। আমাদের দু’জনের কেউই তখনো পরিণত নই। রুশরা প্ল্যাসিড, বড় শান্ত। কিন্তু সাউথ আমেরিকানরা উচ্ছল।

রাত তখন গভীর। ডরমিটরির করিডোরে লাইট্স আউট হয়ে গেছে অনেক আগেই। বেশীরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের আকাশের তারাগুলো সরে সরে নতুন দৃশ্যপট রচনা করছে। ডরমিটরির ব্যালকনির সেই স্বপ্নপূরীর আলো-আঁধারীর রহস্যময়তার মধ্যে মুখোমুখী বসে আছি আমরা দু’জন। রেইনা পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে। সেই দৃষ্টির গভীরে দেখলাম; এতদিনকার বয়ে যাওয়া ঝড় যেন থেমে যাওয়ার আশংকায় আছে। সেই আশংকা তখনো আমাকে ছোঁয়নি। আমি ভাবছি আমার সামনে একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত ম্যাগনোলিয়া অথবা তিবিলিসির পার্ক-পাবেদী (ভিক্টরি পার্ক) তে দেখা নাম না জানা ম্যাজেন্টা রঙের পুস্প।
ঃ তুমি কি উদ্বিগ্ন নও?
রেইনা প্রশ্ন করল।
ঃ কিসের উদ্বেগ?
ঃ বসন্ত গড়িয়ে এখন গ্রীস্মকাল চলে এসেছে।
ঃ ভালো কথা বসন্তের পরে, গ্রীস্ম তো আসবেই।
ঃ তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের ল্যাংগুয়েজ কোর্স শেষ হওয়ার পথে।
আচমকা বজ্রপাত হলো আমার বুকে।

জুন মাসে দ্বিতীয় সেমিস্টারের শেষ।
কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা হয় এই মাসে। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম মনযোগ দিয়ে। রেইনাও খুব খাটাখাটনি করল। পরীক্ষার ফলাফল দু’জনেরই শুভ হলো। দু’জনই এক্সিলেন্ট গ্রেড পেলাম। পরীক্ষার ফলাফল সেলিব্রেট করার জন্য বেশ একটা হৈ চৈ। যাদের ফল ভালো হয়েছে তারা তো অবশ্যই খুশী। যাদের ফল মোটামুটি তারাও দুঃখিত নয়। ল্যাংগুয়েজ কোর্সে পাশ করাটাই বড় কথা। পাশ করতে পারলেই, তুমি সুযোগ পাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কোর্সে পড়ার। যা আমাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। ছোট বেলায়, বড় বোনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। তিনি তখন সেখানকার ছাত্রী ছিলেন। অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হত, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে মাথা নত না করা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাটতাম আর ভাবতাম, কবে ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাটতে পারব?

(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:২৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×