নীরব দুর্ভিক্ষ নয়, হিডেন হাঙ্গার - বাংগালকে আর কতো হাইকোর্ট দেখানো হবে !
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
‘বাবা গো, ভাত খাবো, ভাত খাবো’ ! অভ্যস্ততার বাইরে এমন দ্রুত অস্থির অসহায় চিৎকারে ‘ভাত’ শব্দটির মর্মান্তিক উচ্চারণ ! মোচর দিয়ে উঠলো বুকটা। ভেতরে কোথায় যেন পাড় ভাঙার শব্দ পেলাম !
অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে টং দোকানটাতে নিয়মিত অভ্যাসে চা খেতে নেমেছি। অনেকেই আসেন তখন। থোকায় থোকায় জটলা তৈরি করে ছুটকা ছাটকা আড্ডা মারতে মারতে দাঁড়িয়ে চা খাওয়াটা জমে ওঠে বেশ। এর আমেজটাই আলাদা। তাৎক্ষণিক আড্ডার অনির্ধারিত স্বভাব অনুযায়ী হেন বিষয় থাকে না যা নিয়ে সেখানে যার যার মতো করে বিশেষভাবে কচলানো হয় না। কখনো চটুল, কখনো সিরিয়াস, কখনো বা এলোমেলো। রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য ব্যবসা পেটনীতি পিঠনীতি কী নেই এখানে ! আমাদের একেকজন বিশেষজ্ঞ মতামত দানকারীদের কাছে তখন যেন পৃথিবীটা কেন্দ্রীভূত হয়ে লটকে থাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জরুরি অপেক্ষায় ! ফলে এমন মনোসংযোগকারী আলোচনায় যদি হঠাৎ করে ‘বাবাগো, দুইডা টাকা ভিক্ষা’ বলে ছন্নছাড়া ছুরৎ নিয়ে কেউ হাত ঢুকিয়ে দেয়, জনগুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটির এই অনাহুত ব্যাঘাতে তখন ত্যক্ত বিরক্ত আমাদের ভেতরের মানুষটি যে অজান্তেই আকস্মিক বেরিয়ে আসে কুৎসীৎ চেহারা নিয়ে, সেটাতে ভ্রুক্ষেপেরও সময় থাকে না আমাদের। কেউ হয়তো বললো- ‘না বাবা, মাফ করেন,’ কেউ বলে- ‘অন্য দিকে যাও’। কেউ হয়তো পকেট হাতড়ে খুচরা একটা নোট হাতে ছেড়ে দিলো। আবার কেউ ‘গেলি, ভাগ !’ বলে হাঁক ছেড়ে নিজের উচ্চতর সামাজিক অবস্থানটি প্রকাশ করলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনিতেই ঢাকায় ভিক্ষুকের আধিক্য। বাচ্চা কোলে জবুথবু মহিলা এসে কিছু না বলে অসহায় মুখ করে হাত বাড়িয়ে দিলো সাহায্যের আশায় ; পঙ্গু পুরুষটিকে বেয়ারিং দিয়ে বানানো চাকাঅলা ঠেলাটি ঠেলতে ঠেলতে আরেক কর্কষ মহিলা চলে এলো ; কিশোর বালকটির কাঁধ ছুঁয়ে অন্ধ লোকটি আল্লাহ-রাসুলের গুনগান গাইতে গাইতে ভিক্ষা চাইছে। অশীতিপর দুর্বল বৃদ্ধটি হয়তো লাঠিভর করে চেপাচাপা থালাটা বাড়িয়ে দিলো। কেউ হয়তো নিজের চিকিৎসার অক্ষমতা দেখিয়ে সাহায্য চাইতে এলো। কেউ আবার দূর মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে সর্বস্ব খুইয়ে ফিরে যাবার ভাড়া যোগাড়ের উদ্দেশ্য দেখিয়ে সাহায্য চাইলো। ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বিচিত্র ভিক্ষুকের পর্যায়ক্রমিক ছেকে ধরা অভ্যস্ততায় গা সওয়া হতে হতে এই শহুরে আমাদের মধ্যে যে নিস্পৃহতা জন্ম নিয়েছে, তাতে এখন আর খুব একটা বিব্রত হই না আমারা। তা ছাড়া ঢাকায় নাকি ভিক্ষা-ব্যবসার সিণ্ডিকেটও রয়েছে, যাদের আয় আমাদের মতো ছা পোষা চাকুরেদেরও অনায়াসে হার মানিয়ে দেয়। তাই কৌতূহলি হয়ে মাঝে মাঝে রহস্য বের করার চেষ্টা করি- এটা কি ব্যবসায়ী ভিক্ষুক, পেশাদার ভিক্ষুক, না কি প্রকৃতই অসহায় ভিক্ষুক। যদিও এ রহস্য এখনো রহস্যই। কিন্তু হঠাৎ করে এমন অস্তিত্ব নাড়ানো অসহায় ‘ভাত খাবো ভাত খাবো’ বলে চীৎকারে তো অভ্যস্ত ছিলাম না আমরা ! বাঙালির নাড়ির মধ্যে প্রোথিত ‘ভাত’ শব্দটির এমন নাড়িছেঁড়া তীব্র প্রভাবে চমকে ওঠলাম ! কী মর্মান্তিক অসহায় চীৎকার ! ভাত খাবো ! আহারে ! মাছ নয় ডাল নয়, শুধু ভাত ! এক মুঠো ভাত ! হঠাৎ করেই অসংখ্য হাত এগিয়ে আসছে শুধু এক মুঠো ভাতের জন্য ! কোত্থেকে আসছে এরা !
পত্র পত্রিকায় খাদ্যাভাব নিয়ে যে সব মর্মান্তিক খবরগুলো নিয়ত ছাপা হচ্ছে সচেতন মানুষকে তা নাড়া দেয় বই কী ! দুর্নীতি কমালে যে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের লোটাকম্বলের হিসাব হারিয়ে যায় এটা আমাদের জানা ছিলো না আগে। কি জানি আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, তাই আমাদের মহান উপদেশদাতা কর্তারা নসিহত করে দেন- এখন না খেয়ে বা কম খেয়ে থাকুন, আগামীতে যখন খাদ্যাভাব থাকবে না তখন বেশি খেয়ে তা পুষিয়ে নেবেন। কী নির্লজ্জ উপদেশ বাঙালির এক মুঠো ভাত নিয়ে ! দু’দিন আগেও যিনি চালের সংকট মোকাবেলায় ভাতের বদলে আলু খেয়ে চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন, ক্ষমতা রিনিউ করার দুদিন পর আবার আমাদের মনোবল চাঙা করে দিলেন - দেশে চালের কোন সংকট নেই, অসৎ ব্যবসায়ীরা এই সংকটের জন্য দায়ি।’ আমরা অত্যন্ত কৃতার্থ হলাম , প্রীত হয়ে গেলাম সংকট নাই জেনে ! তবে তাদের উপদেশামৃতের প্রভাবে আলুর বাজার দড়টা দ্বিগুনে উঠে গেলো। শুনে আমরা আরো আস্বস্থ হয়ে ওঠলাম যে, খেতে না পাওয়াটা দুর্ভিক্ষ নয়। মানুষ না খেয়ে মরতে থাকলেই কেবল তাকে দুর্ভিক্ষ বলা যায়। মাশাল্লাহ্ , না খেয়ে থাকলে ক্ষতি নেই, সমস্যা মরলেই ! কার এতো শখ ওঠেছে যে সেধে সেধে মরতে যাবে ! তাই নিন্দুক বাংগালরা যখন নীরব দুভিক্ষ চলছে বলে ফাও চেচামেচি করতে থাকে, এতো এতো কাজের ভীড়েও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যতার সাথে মূর্খ আমাদেরকে শুধরিয়ে দিতে মহান উপদেশকর্তাদের অসীম ধৈর্য্য আর বদান্যতায় একটুও বিলম্ব হয় না- ‘নীরব দুভিক্ষ নয়, হিডেন হাঙ্গার’ ! আহা কী মধুর বচন ! হিডেন হাঙ্গার ! তাইতো ! যা লুকানো আছে তাকে শুধু শুধু প্রকাশ করার মূঢ়তা দেখানো মূর্খ আমরা কী লজ্জাজনক অশ্লীল কাজটাই না করে বসছিলাম ! ভাগ্যিস আমাদের লজ্জাটা রক্ষা পেলো এ যাত্রায় , ওনাদের মহামহীম কল্যাণে। আমরা ধন্য, আমাদের ঘাড়ের উপর এমন জ্ঞানী গুণি রুচিবান উপদেশকর্তাদের ধারণ করতে পেরে !
‘দেখো বাংগাল, হাইকোর্ট দেখো’, বেশি করে দেখো !!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।