somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অদৃশ্য বাতিঘরের খোঁজে...

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৮ বিকাল ৪:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অদৃশ্য বাতিঘরের খোঁজে...


প্রথম দেখাতেই তাকে খুব ভালো লেগে গেল আমার। এই ভালো লাগাই যে আসলে আমার অব্যক্ত ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ ছিল, তা বুঝে উঠতে পারিনি। এমন অনির্বচনীয় উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতা আমার এটাই প্রথম।
তার সঙ্গে দেখাটাই ছিল নাটকীয়। তখন আমি কেমিস্ট্রিতে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছুটিছাটায় বাড়িতে খুব একটা আসা হতো না। সেবার কি একটা ছুটিতে যেন বাড়িতে আসি। আর বাড়িতে এলেই ষোলঘর থেকে বিকেলের সোনা রোদে সেকালের ছায়াসবুজ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে উকিলপাড়া হয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে এসে ঢু মারা আমার নিয়মিত অভ্যাস। দিনের পত্রিকাগুলো উল্টেপাল্টে শেষে থরে থরে সাজানো বইয়ের আলমিরাগুলো চষে বেড়ানো প্রিয় বইটির খোঁজে। তারপর সন্ধ্যা জমে এলে যথানিয়মে নিবন্ধন করিয়ে বইটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়া। এদিক সেদিক বন্ধু-বান্ধবের ঠিকানায় ছোট্ট একটু আড্ডা মেরে রাত করে বাসায় ফেরা। একান্ত দুর্বিপাক না হলে এ অভ্যাসের অন্যথা খুব একটা হতো না।
সেদিনও এমনি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে হলো আজ একটু অন্য পথেই যাই। কালীবাড়ি রোডের পুরনো সহপাঠিনী শিপ্রার সঙ্গে দেখা করে হাছননগর হয়ে ফিরবো। বহু দিন পরে যাচ্ছি। শিপ্রাদের বাসার কাছে এসেও লোডশেডিংয়ের কারণে ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। তবু ধারণা করে গেট ঠেলে ঢুকে পড়লাম এবং বিপত্তিটা বাঁধলো তখনি।
সুনামগঞ্জ শহরের এদিকটায় তখনকার সময়ে এমনিতেই খুব নিরিবিলি থাকতো। লোডশেডিং গাছগাছালি আর ভরা পূর্ণিমার আলো-আঁধারিতে বাড়ি ভর্তি এতো মানুষের নীরব সমাগমে থমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হলাম আরো বেশি। ঘোর কাটিয়ে লক্ষ্য করতেই বুঝে গেলাম, সম্পন্ন হয়ে যাওয়া একটা অনুষ্ঠানের মধ্যে অনাহুত ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই এসে পড়েছি আমি। মুহূর্তের ইতস্ততা কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি...; কাকে চাই ? বুঝলাম আমাকেই বলা হচ্ছে। আবছা আলোতে একজন বর্ষীয়ান ব্যক্তি 'আপনি কে' বলে হয়তোবা চেনার উদ্দেশ্যে যেভাবে ঘাড় থেকে গলাসুদ্ধ মুখটা আমার দিকে ঝুঁকে দিয়েছেন, তাতে বুঝা গেল তিনি দর্শন ও শ্রবণজনিত অতি ক্ষীণতায় ভুগছেন।
অতি সঙ্কোচে আমতা আমতা করে শুধু বলতে পারলাম, আমি...।
মুহূর্তেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠলো চারদিক। সারা বাড়ি জুড়ে সাজিয়ে দেয়া বর্ণিল বাতিগুলো মোহনীয় করে তুলেছে আশপাশ। এবং অভাবিতভাবেই সবচেয়ে উজ্জ্বল ঝলমলে চৌদ্দ-পনেরো বছরের প্রাণবন্ত মেয়েটি দেব-দূতির মতো পুরো সৌন্দর্য নিয়ে যেন আমাকে উদ্ধার করতে সামনে এসে দাঁড়ালো। না না, যাবেন না বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো ঘরের মধ্যে। ফিরতিযাত্রার নতুন কনের সাজে সখি পরিবেষ্টিত শিপ্রার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সামনে অপ্রস্তুত আমার এই প্রথম খেয়াল হলো যে, অত্যন্ত সাধারণ লুঙ্গি-শার্ট আর জাম্পার পরা আমি এতোসব অভ্যাগতের মাঝে বড় বেমানানভাবে জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেই ডানাকাটা লাল পরীটার সাগ্রহ সকৌতুক দৃষ্টির আড়ালে একাধারে লজ্জিত ও ততোধিক আলোড়িত হচ্ছি। জানলাম তার নাম রূপা। শিপ্রার সেজ বোন ! এ বাসায় আমি একেবারে অপরিচিত নই। কিন্তু আমার কাছে তখন পৃথিবীর সুন্দরতম মেয়েটির উপস্থিতি কেন আগে চোখে পড়েনি, সেটাই অনির্ণিত প্রশ্ন হয়ে বাজতে লাগলো।
সেদিনের পর থেকে আমার বুকের গভীর বিশ্বে নিউটনের সূত্রগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সুরমার পানি উল্টো বইতে শুরু করেছে তখন এবং হৃদপিণ্ডের আকর্ষণ বলের মধ্যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বটাই যুক্তিহীনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো। লেখাপড়ায় অতি মনোযোগী যে ছেলেটি হল-হুস্টেল ছেড়ে মা-বাবার শত অনুরোধেও বাড়ির নাম নিতে ভুলে যেতো, সেই কি না বাড়ি আসার জন্য ঘন ঘন ছুটি পেতে লাগলো। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা ছিল, এই তো একটা জরুরি কাজে বাড়িতে এসেছি, কালই চলে যাবো; ভাবলাম একবার তোমরা কেমন আছো দেখে যাই- আমার এ জাতীয় উক্তিগুলোর যথার্থতায় সেও সাগ্রহে প্রশ্রয় দিতে লাগলো। এই প্রশ্রয়ই প্রকারান্তরে আমাকে আরো সাহসী এবং তার মনটাকে ছুঁয়ে দেখার নেশাগ্রস্ততার ঘোরে আটকে দিল।
আমি বুঝতে শুরু করলাম, আমি তাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসি। কিন্তু প্রকাশে অক্ষমতা, দ্বিধা অতিক্রম করতে পারি না। পাশাপাশি সে কি আমাকে ভালোবাসে ? এই অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা ভেতরে ভেতরে নীল করে দিচ্ছিল আমাকে। তবে বাইরে আমার হাসি-খুশি কৌতুকপ্রিয়তা ঠিকই বজায় থাকলো। ব্যাকগ্রাউণ্ডে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ নই, ব্যায়ামপূর্ণ শারীরিক সুস্থতায় ফেলনা নই, কিংবা ছবি আঁকা,গান গাওয়া, হালে কবিতা লেখা ইত্যাদির কিঞ্চিৎ সমাহারও রয়েছে। তদুপরি স্বেচ্ছাশ্রমী টিউটর হিসেবে মন্দ নই প্রমাণিত হওয়ায় এবং সর্বোপরি স্বভাব-চরিত্রে কুপ্রভাব দৃষ্ট না হওয়ায় তাদের গোটা পরিবারের কাছেই আমার বিশ্বস্ততা বা গ্রহণযোগ্যতা কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। তাই হয়তো সুরমার আরো অনেক পানি গড়িয়ে যেদিন সে ঘরের নির্জনতায় তার মনোজগৎটাকে আমার হতবিহ্বল দৃষ্টির সামনে অক্লেশে উন্মুক্ত করে দিল, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফ্যাকাসে রুগ্ন এক অস্বস্তি নিয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম ! এমন আকস্মিকতায় প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
ধর্মীয় বিশ্বাসে ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন এক বেয়াড়া জেদি একরোখা তরুণ মেয়েটির কিশোরীবেলায় জোর করে তার বিশ্বস্ত ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে ! নইলে যে, ছেলেটি তার সামনেই নিশ্চিত আত্মঘাতী হতো ! মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ তরুণটি শুধু তার শিক্ষাগত ঘাটতিটুকু অন্য এক বিকল্প দিয়ে পূরণ করতেই এখন জাপান প্রবাসী হয়েছে। ছেলেটির নিশ্চিত ফিরে আসার দুঃসহ অপেক্ষকালীন সময়টায় আমার হঠাৎ এই সরব ও যোগ্য উপস্থিতি তাকে ইদানিং সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়েছে।
কেন আর ক’টা বছর আগে আমার সঙ্গে তার দেখা হলো না ! এখন কাকে ফিরিয়ে দেবে সে ! এই অক্ষমতায় তার যে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নেই ! চোখে বাধভাঙা পানির ধারা, অস্তিত্ব জুড়ে একটা ভয়ানক নিঃশব্দ ভাঙন প্রত্যক্ষ করে আমার বুকের ভেতরেও শেকড় ছেঁড়া প্রচণ্ড পাড়ভাঙার শব্দ শুনতে পেলাম। আশ্বস্ত করার কোনো ভাষা আমার জানা নেই। শুধু ওর ডানহাতটা টেনে নিয়ে সাদা মসৃণ কলমের মতো আঙুলগুলোয় আড়ষ্ট ঠোঁট ছুঁয়ে আমার শুভেচ্ছা এঁকে দিলাম। তারপর নিজেকে তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে চালাতে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।
প্রচণ্ড আশাবাদী একজন ব্যক্তিমানুষকে সে ঘরে টেনেছিল। বেরিয়ে এলো, ভাঙনের শব্দকাতর এক কবি ! পেছনে তার এক অদৃশ্য বাতিঘর। কেবল জ্বলছে-নিভছে...! # Click This Link


[যায়যায়দিন-এর বিশেষ ভালোবাসা সংখ্যা বৃহষ্পতিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এ প্রকাশিত]
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড্রাকুলা

লিখেছেন সুদীপ কুমার, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১২

কোন একদিন তাদের মুখোশ খুলে যায়
বেরিয়ে আসে দানবীয় কপোট মুখায়ব।

অতীতে তারা ছিল আমাদের স্বপ্ন পুরুষ
তাদের দেশ ছিল স্বপ্নের দেশ।
তাদেরকে দেখলেই আমরা ভক্তিতে নুয়ে পড়তাম
ঠিক যেন তাদের চাকর,
অবশ্য আমাদের মেরুদন্ড তখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×