somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

[ছোটদের গল্প...| অর্ক’র চোখ |

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

...

ঘটনার শুরু কিন্তু গতকাল পঞ্চম শ্রেণীর অংকের ক্লাস থেকে। একেবারে ভিন্নভাবে। সব ছাত্রের মনোযোগ যখন অংক স্যারের দিকে, অর্ক’র দৃষ্টিটা বারবার মাথার উপরে ভন্ভন্ করে ঘুরতে থাকা ফ্যানটাতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। অংক স্যারও এই অমনোযোগী ছাত্রের ব্যাপারটা খেয়াল করেই ডাক দিলেন- এই ছেলে, দাঁড়াও !
থতমত খেয়ে দাঁড়ালো সে।
তোমার কী সমস্যা বলো তো ? ওখানে কী দেখছো ?
একটু ইতস্তত করে বললো- স্যার, সাপ।
সাপ ! কোথায় ?- স্যারের কণ্ঠে বিস্ময়।
অর্ক তর্জনীটা ফ্যানের দিকে তাক করে ধরলো- ওইখানে।

ভন্ভন্ করে এতো জোরে ঘুরছে যে ফ্যানের ব্লেডগুলোও দেখা যাচ্ছে না, শুধু অস্পষ্ট একটা ছায়াবৃত্ত ছাড়া। ওখানে সাপ কোথায় ! কেউ দেখতে পেলো না। তবু হুড়মুড় করে ক্লাসের ভেতরে মুহূর্তের মধ্যেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ‘সাপ সাপ’ বলে সবাই ফ্যানটার কাছ থেকে দূরে সরতে গিয়ে হাউকাউ চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো। হট্টগোল শুনে পাশের ক্লাসরুম থেকে বাংলা স্যারও চলে এসেছেন। ততক্ষণে অংক স্যার একটা একটা সুইচ অফ-অন করে করে সুনির্দিষ্ট সুইচটা অফ করতেই ফ্যানের গতি কমে এলো। একটু পরেই ব্লেডের সাথে প্যাঁচানো চিকন কালো রশির মতো সাপটাকে দেখা যেতে লাগলো। এবং ফ্যানটা স্থির হতেই ওটা ঝুপ করে পড়লো নিচে বেঞ্চের উপর। ততক্ষণে অর্কও ওটা থেকে কিছুট দূরে সরে এসেছে। আর ‘সাপ এলোরে সাপ এলোরে’ বলে আবারো একটা হুড়াহুড়ি এবার ক্লাসরুম থেকে একেবারে বারান্দায় গিয়ে পৌঁছলো।

কোত্থেকে একটা বাঁশের লম্বা লাঠি নিয়ে অল্প বয়েসী পিয়ন ছেলেটা সোজা সাপটার কাছে চলে এলো। বেশ সাহসী ছেলে বলা যায়। লাঠিটা তাক করে আঘাত করার আগে তীক্ষ্ণভাবে কী যেন পর্যবেক্ষণ করেই চেঁচিয়ে ওঠলো সে- স্যার, এইটা তো পিলাস্টিকের সাপ !
ভালো করে দেখো- বলে সতর্ক করলেন বাংলা স্যার।
সে যে একটুও মিথ্যে কথা বলেনি তা প্রমাণ করতে এবার লাঠির আগায় খোঁচা দিয়ে সাপটাকে মাটিতে ফেলে দিলো। পড়েই চিৎ হয়ে গেলো ওটা। একটার পর একটা বক্সের মতো প্লাস্টিক কারখানার তৈরি খাঁজগুলো নজরে আসতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই। শঙ্কিত ভাবটা কেটে যেতেই ক্লাস জুড়ে ছেলেদের হাসির তুবড়িতে খলবল করে ওঠলো রুমটা। কিন্তু অংক স্যারের রাগটা এবার ঠিকই চড়ে উঠেছে- ফাজিল ছেলে কোথাকার ! কই সে ?

ভয়ে ভয়ে স্যারের সামনে এগিয়ে এলো অর্ক। স্যারের স্বরকম্পন আরো বেড়ে গেছে তখন- তুমি যা করেছো তাতে তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা উচিত ! বেয়াদব ছেলে কোথাকার !
অর্ক কাঁদো কাঁদো গলায় মিনতি করলো- আমি তো কিছু করিনি স্যার !
করিনি মানে !- স্যারের গলা তখন চরমে।
এরই মধ্যে হেডস্যারও চলে এসেছেন। নিয়ম কানুনে অত্যন্ত কড়া এই হেডস্যারকে ইস্কুলে সবাই সমীহ করে চলে। তিনি আসতেই সবাই যার যার সীটে গিয়ে বসে পড়লো। কেবল অর্ক দাঁড়িয়ে রইলো। ক্লাসের সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে অর্ককে সাথে করে তাঁর রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। পেছন পেছন অংক স্যারও গেলেন।

সাধারণত জরুরি কোন প্রয়োজন ছাড়া হেডস্যারের রুমে ছাত্রদের খুব একটা যাওয়া হয় না। গুরুতর কোন ব্যাপার হলেই কেবল ওখানে ডাক পড়ে কারো। তাই হেডস্যারের রুমে ঢুকে অর্ক’র খুব ভয় হতে লাগলো। হেডস্যার তাঁর চেয়ারে বসেই সোজা অর্ক’র দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন- তুমি যে অপরাধ করেছো এটাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ বলে। এর সাজা কী জানো ? স্কুল থেকে বের করে দেয়া।
আমি স্যার কিছু করিনি- খুব সন্ত্রস্ত কণ্ঠে জবাব দিলো সে।
তাহলে কে করেছে ?
আমি জানিনা স্যার !
হঠাৎ হেডস্যারের কঠিন কণ্ঠ গমগম করে ওঠলো- তুমি কি মিথ্যা বলার পরিণাম জানো ?
ভয়ে অর্ক’র গলা দিয়ে তখন আর শব্দ বেরুচ্ছে না। তবু মরিয়া হয়ে সে বললো- জী স্যার, আমি মিথ্যা কথা বলি না।
কিন্তু স্যার যে তাঁর কথা বিশ্বাস করেছেন তা কী করে বুঝবে সে ?
তোমার বাবার ফোন নম্বর আছে ?
জী স্যার !

ফোন নম্বরটা রেখে হেডস্যার তাকে ক্লাসে ফেরৎ পাঠালেন। খুব বিমর্ষ মনে অর্ক ফিরে এলো ক্লাসে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সে যে ফ্যানের মধ্যে কোন প্লাস্টিকের সাপ ছুঁড়েনি বা এ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না, এটা কেউ বিশ্বাস করছে না ! লজ্জায় অপমানে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইস্কুল ছুটি হয়ে গেলো। বিমর্ষ অর্ক মাঠ পেরিয়ে গেটের দিকে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে টের পেলো, কে যেন তাকে কী বলছে।

সহপাঠী লাবিব। ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই সে বললো- হেডস্যার তোকে মেরেছে রে ?
না তো !
তোকে জিজ্ঞেস করেনি এটা কে করেছে ?
হাঁ, করেছে !
তুই কী বলেছিস ?
আমি তো জানি না ওটা কে করেছে !
ও আচ্ছা...। বেশ আশ্বস্ত হয়েই চলে গেলো সে।
...

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই আব্বু জানতে চাইলেন- কী রে বাবু, আজ স্কুলে কী হয়েছে রে ?
অর্ক’র কাছে সবিস্তারে সব শুনে ‘ও তাই ! ঠিকাছে’ বলে আব্বু তাঁর কম্পিউটার নিয়ে বসে গেলেন। কিন্তু অর্ক’র বুক জুড়ে অনেক অভিমান দানা বেঁধে ওঠেছে তখন। এতগুলো ঘটনা ঘটে গেলো ! অথচ আব্বুর ‘ও তাই, ঠিকাছে’ বলেই শেষ ! আরো বেশি ভারি হয়ে ওঠা মনটাকে বুকে চেপে পড়ার টেবিলে মাথা গুঁজে বসে রইলো সে। হঠাৎ মাথায় আদরের স্পর্শে বুকটা চনমন করে ওঠলো। মুখ না তুলেই বুঝে গেছে, এই ঘ্রাণ আম্মুর। ‘ঔষধটা খেয়ে নাও বাবা !’
মুখ চোখ কুঁচকে এলো অর্ক’র। এ-বেলা এইটা ও-বেলা ওইটা করে করে অতিষ্ঠ করে তোলা ঔষধগুলোর উপর রীতিমতো বিরক্ত সে। কিন্তু কিছুই করার নেই।
...

গত ছুটিতে আব্বু-আম্মুর সাথে মামারবাড়ি চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে তাঁর প্রিয় ভ্রমণ- ট্রেনের জানালায় বসে গাছপালা মাঠ ঘাট নদী বন কে কতো জোরে পেছনে ছুটতে পারে- সে খেলাটাই দেখছিল খুব কৌতুক নিয়ে। দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে মাথাটা জানালায় ঠেশ দিয়ে রেখেছিল। হয়তো জানালা দিয়ে মাথাটা বাইরের দিকে কিছুটা বেরিয়েও ছিল। আচমকা কী যেন একটা ভয়ঙ্কর কিছু এসে কপালের ঠিক মাঝখানটায় প্রচণ্ড বাড়ি খেলো ! তারপর আর কিছু বলতে পারে না অর্ক। যখন জ্ঞান ফিরলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। চারদিকের শোরগোলের মধ্যেও অভ্যস্ত নাকে আম্মুর শরীরের ঘ্রাণটা পেয়ে গেছে ঠিকই।
এতো অন্ধকার কেন আম্মু ?
ওহ্, জেগেছিস তুই ! মাথায় চোখে ব্যান্ডেজ করা যে বাবা !

ক’দিন পর ব্যান্ডেজ খোলা হলে যেদিন থেকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে শুরু করলো, সেদিনই খুব আশ্চর্য ও মজার ঘটনাটা খেয়াল করলো সে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে ঠিক নাকের উপর ছাদে ঝুলানো ভন্ভন্ করে ঘুরন্ত ফ্যানটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণভাবে তাকাতেই ফ্যানের গতিটা কেমোন মন্থর হয়ে গেলো ! দৃষ্টি স্বাভাবিক করতেই ফ্যানটা আবার আগের মতো দ্রুত ঘুরছে। আবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো, গতি মন্থর হয়ে যাচ্ছে। ফ্যানের গায়ে উদ্ভট অর্থহীন লেখাটা দিব্যি পড়তে পেরেছে সে ! পড়ে আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না - চমেকহাফ্যা৫৭৮ ! নিয়মিত ডিউটিতে পরিদর্শনে এলে ডাক্তার আঙ্কেলকে বলতেই তিনি চুলগুলো নেড়েচেড়ে আদর বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন- খুব মজা বুঝি ? তারপরেও ওটা একটা ক্ষতিকর রোগ বাবা। আমি যে ঔষধগুলো লিখে দেবো তা নিয়মিত খাবে কিন্তু ! কেমন ? আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

সেই থেকে অর্ক’র স্বাস্থ্যটাও দিনে দিনে ভেঙে পড়তে লাগলো। আব্বু আম্মু আরো কতো যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন তাকে ! ডাক্তার আঙ্কেল বলেছেন, চোখের অসুখটা সেরে গেলেই স্বাস্থ্য আবার ভালো হয়ে উঠবে। যত তাড়াতাড়ি সেরে যায় ততই মঙ্গল। তাই যতো বিরক্তই লাগুক ঔষধ খেতে এখন কোন আপত্তি করে না সে।
...

পরদিন ইস্কুলে যেতেই কিছুক্ষণের মধ্যে হেড স্যারের ডাক এলো। উঠে দাঁড়াতেই লাবিবের সাথে চোখাচোখি। ওর ভয়ার্ত চোখে একটু ম্লান হাসি বিনিময় করে হেড স্যারের রুমের দিকে বেরিয়ে গেলো অর্ক। বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো। কিন্তু রুমে ঢুকেই আজ হতবাক সে। গতদিনের ঠিক উল্টো পরিবেশ। হেডস্যার চেয়ার থেকে উঠে এসে অর্ক’র মাথায় মুখে আদর বুলিয়ে বললেন- আমি তোমার আব্বুর কাছে সব শুনেছি বাবা। গতকালকে তোমাকে অনেক বকেছি, তাইনা ! তুমি আসলে খুব ভালো ছেলে। এখন থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে, আর ডাক্তার সাহেব যা বলেন তা মেনে চলবে। স্কুলে তোমার কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে, কেমন ? যাও।
হেড স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখে কোত্থেকে যেন পানি চলে এলো। মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ক্লাসরুমে যখন ঢুকলো তখন তার মন ভালোলাগায় টম্বুর হয়ে আছে।

লেজার পিরিয়ডে ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাসের মধ্যে রেইনট্রি গাছটার ছায়ায় লাবিবসহ অন্য অনেকের সাথে বসলো সে। উপরের ক্লাসের বড় ভাইয়ারা সুযোগে কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলে নিচ্ছে। কিন্তু খেলা দেখে অর্ক’র কেবল হাসিই পেতে লাগলো। তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করছে সে, বলটা যাচ্ছে বামে আর ব্যাট হাঁকাচ্ছে ডানে। আবার কখনো বলটা বাউন্স করে উপরে উঠে যাচ্ছে, অথচ ব্যাট পেতে দিচ্ছে গড়ানো বল আটকানোর মতো করে। এই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দেখে হিহি করে হাসছে আর চেঁচিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্ক ভুলেই গেছে অথবা জানে না যে, তার অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে যেগুলোকে অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে, আসলে ওগুলোই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্তব্য সে করেই যাচ্ছে- হি হি হি, এই দেখছিস লাবিব, বল কোথায় আর ব্যাট করছে কোথায় ! এক্কেবারে কার্টুনের মতো লাগছে না ! হি হি হি হি...!

‘এই ছেলে !’ একটা আদেশঝরানো কণ্ঠে চমকে ওঠলো অর্ক। পাশেই দাঁড়ানো শক্তসমর্থ গড়নের লম্বাচওড়া ছেলেটি। পরনের ইস্কুলড্রেস বলে দিচ্ছে এ ইস্কুলেরই উপরের ক্লাসের ছাত্র। কে যেন তাকে রণিভাই বলে ডাকলো। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না করেই কণ্ঠে সেই আদেশের সুর- ‘তুমি কোন্ ক্লাসে পড়ো ?’
ক্লাস ফাইভ।
প্রাইমারী ক্লাসের ছাত্র হয়ে বড় ভাইদের সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করতে তোমার লজ্জা হয় না ! স্যরি বলো !
আশেপাশে নানান ক্লাসের নানান ভঙ্গির ছাত্ররা, সবার মনোযোগ তখন এদিকে। এরই মধ্যে কিছু কিছু ছাত্রের জটলাও তৈরি হয়ে গেলো এখানে। অর্ক বুঝতে পারছে, হয়তো সে ভুল করেছে, শুধু একটা ‘স্যরি’ বললেই সবকিছু মিটে যাবে। কিন্তু এতোসব কৌতূহলী চোখের সামনে নিজেকে সে খুব অপমানকর অবস্থায় আবিষ্কার করলো। তাই উত্তরের মধ্যে সেই জেদ প্রকাশ পেলো- ‘স্যরি। কিন্তু আমি যা দেখেছি তাই বলেছি !’
যা দেখেছি মানে !
রণি’র কণ্ঠে বিস্ময়। এই দুর্বিনীত ছেলে বলে কী ! ক্রিকেটের ক্রিজে দাঁড়ানো যে কী জিনিস, এটা বুঝাতে ওকে তো তাহলে একটু শিক্ষা দিতে হয় ! তাই কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বললো- তুমি কি পারবে এরকম এক ওভার বল ঠেকাতে ? হয় স্যরি বলো, না হয় ক্রিজে গিয়ে দাঁড়াও !
সতীর্থ কেউ কেউ রণিকে শান্ত করতে এগিয়ে এলো- বাদ দে তো, বাচ্চা ছেলে এসবের বুঝে কী ! ফাইভের ক্লাস-টিচার স্যারকে একটা কমপ্লেন জানিয়ে রাখলে হবে...।
ওদের কথা শেষ হবার আগেই অর্ক’র স্পষ্ট ঘোষণা- আমি ক্রিজে যাবো !
...

অর্ক’র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এ মুহূর্তে তীব্রবেগে ছুটে আসা ক্রিকেট বলটার উপর। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। ওপাশ থেকে রণি’র ছুঁড়ে দেয়া বলটা মাঝামাঝি দূরত্ব পার হয়ে এসে মাটিতে আছাড় খেলো। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ওটা। তারপর আবার লাফ দিয়ে উঠে স্ট্যাম্প আগলে রাখা ব্যাট হাতে প্রস্তুত অর্ক’র দিকে আসতে লাগলো। তবে অর্ক নিশ্চিত হয়ে গেছে বলটা যে এখন আর স্ট্যাম্প বরাবর আসবে না। বলটা যেখানে আছাড় খেয়েছিলো সেখানের মাটি যে সমতল নয়, বরং একটু উঁচু নিচু ছিলো, কিংবা ছোটখাটো পাথরের কণায় হোঁচট খেয়েছে তা তো পরিষ্কার। কারণ সে দেখতে পাচ্ছে বলের গতিমুখ কিছুটা বেঁকে গেছে। অর্থাৎ অফ-সাইড বা পেছন দিক দিয়ে রেরিয়ে যাবে বলটা। তার হাতের মুঠো ব্যাটের হাতলটাকে আরো ভালোভাবে চেপে ধরেছে। বাঁ পা’টা এক স্টেপ এগিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। কেননা ইতোমধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, বলটাকে ইস্কুলের বাউন্ডারির ওপারে পাঠাবে।

দর্শকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। এতোবড়ো ব্যাটটাকে তুলতে পারবে কি না এটাই যেখানে সন্দেহ, সেই পিচ্চি ছেলেটাই কিনা আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ান বোলার রণি’র মারাত্মক পেস বলটাকে সোজা শূন্য দিয়ে বাউন্ডারীর বাইরে পাঠিয়ে দিলো ! রীতিমতো উল্লাস চলছে জুনিয়র শিবিরে, সিনিয়রদের মুখ থমথমে, চোখে অবিশ্বাস !

দ্বিতীয় বল করতে প্রস্তুত রণি। মুখ চোখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে আছে। প্রেস্টিজ ইস্যু। এমন স্নায়ুচাপে কখনো পড়েনি সে। বাংলাদেশ ক্রিড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি’তে তাকে নেয়ার আলোচনা চলছে। একদিন জাতীয় দলে খেলবে এবং দেশের সেরা পেস-বোলার হবে, এই টইটম্বুর আত্মবিশ্বাসে টোকা লাগায় এবার সত্যি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে সে। ঘুরেই বল হাতে দৌঁড়াতে শুরু করলো। হাত ও কাঁধের শিরা-উপশিরা পেশীগুলো সাপের ফণার মতো তড়পাচ্ছে যেন।

ব্যাট হাতে প্রস্তুত অর্ক তীক্ষ্ণ চোখে রণি’র হাতের বলটাতে দৃষ্টি আটকে রেখেছে। সবকিছু স্লো-মোশন ছবির মতো ধীরলয়ে চলছে এখন। ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো কী বিকট মুখ চোখ করে রণি ভাইয়াটা হাতটাকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে উপর থেকে মুঠোয় ধরা বলটাকে সর্বশক্তিতে ঠেলা দিয়ে ছেড়ে দিলো। ছুটে আসা বলটাকে ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। মাঝামাঝি দূরত্ব পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে ওটা মাটিতে ধাক্কা খেয়ে ফের লাফ দিলো এবং সোজা তার পেট বরাবর আসতে লাগলো। ঝাঁকি দিয়েই শক্ত মুঠোয় ধরা ব্যাটটাকে উপরে তুলে বলটার ঠিক মুখোমুখি মেলে ধরবে সে। কী আশ্চর্য ! যেভাবে ভাবছে, হাত দুটো সেই দ্রুততায় ব্যাটটাকে তুলতে পারছে না ! বলটা উঠে আসা ব্যাটের হাতলের কানায় ঠক করে বাড়ি খেয়ে চকিতেই কোণাকুণি উপরের দিকে উঠে যেতে লাগলো।...

খুব অস্বাভাবিক হলেও অর্ক তার তীক্ষ্ণ চোখের বিশেষ দৃষ্টিশক্তি দিয়ে রণি’র দ্বিতীয় বল করার দৃশ্যটাকে যেভাবে ধীর গতিতে প্রত্যক্ষ করছিলো, দর্শকদের চোখে এই ঘটনাই কিন্তু ধরা পড়লো স্বাভাকিক দ্রুততায়। তারা দেখতে পেলো আহত চিতার মতো সবেগে ছুটে এসে রণি তীব্রগতিতে ছুঁড়ে দিলো বলটাকে। চোখের পলকে ওপাশে অর্কের বাড়িয়ে দেয়া ব্যাটের সাথে সংঘর্ষ হতেই সোজা উপরের দিকে শূন্যে উঠে গেলো বলটা। এবং হতবাক হয়ে সবাই দেখলো ক্রিজের মধ্যে চিৎ হয়ে নিঃসাড় পড়ে আছে অর্ক নামের ছেলেটা ! আচমকা স্তব্ধতা কেটে যেতেই হৈ হৈ করে সবাই ছুটে গেলো মাঠের দিকে। খবর পেয়ে স্যারেরাও ছুটে এলেন। সাথে সাথে খোঁজ পড়লো এম্বুলেন্সের।
...

কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে অর্ক’র। সিস্টার এসে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়ে গেছে। বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে এবং ক্রমেই সুস্থ হয়ে ওঠছে সে। কিন্তু আজ তার মন খারাপ। খুব ভালোভাবে খেয়াল করে দেখেছে, তীক্ষ্ণভাবে তাকালেও ফ্যানের গতিটা এখন একটুও কমছে না আর। আম্মুকে বলতেই কপালের ব্যান্ডেজটাতে হাত বুলাতে বুলাতে কী খুশি আম্মু ! কিন্তু অর্ক’র যে মশা-মাছি-পোকা-মাকড়ের ওড়াউড়ি, প্রজাপতির পাখা চালনা, কাকের দুষ্টুমি বা গুলতির পাথরটা কিভাবে আমের বোঁটায় গিয়ে আঘাত করে, ধীর গতিতে সেসব দৃশ্যের কিছুই আর মজা করে দেখা হবে না ! যদিও ডাক্তার আঙ্কেলের কথামতো তার স্বাস্থ্য আবার ভালো হয়ে ওঠবে। তাহলে আবার অনেক খেলাধূলা করতে পারবে সে। সহজে ক্লান্ত হবে না কিংবা জ্ঞানও হারাবে না। কিন্তু রণি ভাইয়ের মতো এমন চমৎকার ক্রিকেট কি খেলতে পারবে সে ? ইশ্, যদি পারতো ! ভাবতে না ভাবতেই কেবিনের দরজায় রণি’র মুখটা ভেসে ওঠলো। সাথে সাথে অর্ক’র চেহারাটাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো। এখন থেকে সে রণি ভাই’র কাছে খেলা শিখবে।

শিয়রের কাছে আসতে না আসতেই অর্ক তার ডান হাত দিয়ে রণি'র হাতটা ধরে বললো- রণি ভাইয়া, আমি খুব স্যরি ! প্লীজ আমাকে...
তার আগেই রণি তার অন্য হাত দিয়ে অর্ক’র মুখটা আলতো করে চেপে ধরে স্মিত হেসে মাথাটাকে এপাশ-ওপাশ নাড়াতে লাগলো। দুজনের কেউ টের পায়নি, অর্ক’র আম্মুর সাথে কুশল বিনিময় সেরে হেডস্যার কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
(২০-০৭-২০০৯)
...
[প্রকাশিত: শিশু কিশোর পত্রিকা মাসিক ‘টইটম্বুর’, অক্টোবর ২০০৯, বিশ্ব শিশু দিবস সংখ্যা]
...
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×