জাহিলিয়াতের পরিচয়
অনেকের মনে কঠিন প্রশ্নের উদ্রেক করবে- জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির এই চরম উৎকর্ষের যুগকে, বস্তুগত উন্নতি-অগ্রগতির বিস্ময়কর সময়কে ‘জাহিলিয়াত’ আখ্যায়িত করা ধৃষ্টতা নয় কি? অনেকের ধারণা- জাহিলিয়াত বলতে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর আগমনের পূর্বে আরবের তৎকালীন অবস্থাকে বুঝায়। যা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পুনরায় তা প্রত্যাবর্তন করতে পারে না। উত্তরে বলব, ‘জাহিলিয়াত’ শব্দটিকে প্রচলিত অর্থের উপর নির্ভর করা হয়নি। বরং জাহিলিয়াতকে একটি পরিভাষা হিসাবে ব্যাবহার করা হয়েছে।
জাহিলিয়াত মানেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি বিরোধী নয়। কুরআনুল কারীম কখনোই বলেনি যে, আরবরা জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল এইজন্য যে, তারা জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা জানত না। অথবা তারা বস্তুগত উৎপাদনে পশ্চাদপদ রয়ে গিয়েছিল। বরং ইতিহাস অন্বেষণ করলে দেখা যায়, তদানিন্তন আরবরা জাহিল বা মূর্খ ছিলনা, তারা নানা তত্ত্ব ও তথ্যের ধারক-বাহক ছিল। তারা পশ্চাদপদ বা প্রগতিবিরোধী ছিল না। বরং তারাও সভ্যতা সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল, ছিল মুল্যবোধসম্পন্ন। তারা নানা গুণে গুনান্বিত ছিল- মহানুভবতা, সাহসিকতা, নীর্ভিকতা, মর্যাদাবোধ এবং ভাল কাজের জন্য সাড়া জীবন দান করার মত মহৎ গুণ তাদের মধ্যে ছিল। অথচ আল্লাহ তায়ালা সে যুগকে জাহিলিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত জাহিলিয়াত হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট ভাবধারা-সারনির্যাস। তা বিভিন্ন রুপ ধারণ করতে পারে। তা নির্দিষ্ট সময় ও ভূখন্ডের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না। তা নির্ধারিত হয়ে থাকে পরিবেশ-পরিস্থিতি, সময়কাল ও স্থানের অবস্থার প্রেক্ষিতে। কুরআনুল কারীমের ভাষায় জাহিলিয়াত হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা, যা আল্লাহর দেয়া হেদায়েতকে পুরোপুরি অস্বীকার করে। যা আল্লাহর দেয়া বিধানানুযায়ী বিচার-ফায়সালা করতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তা কথিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা সংস্কৃতি ও বিপুল বস্তুগত উৎপাদনের বিপরীত কিছু নয়। যেহেতু বর্তমান যুগ আল্লাহর নাযিল করা বিধানানুযায়ী মানব জীবনের পুনর্বিন্যাস করতে, বিচার-ফায়সালা করতে অস্বীকার করছে, সেহেতু এ যুগকে ‘জাহিলিয়াত’ আখ্যায়িত করা বাস্তবসম্মত ও অধিক যুক্তিযুক্ত।
ইতিহাসের পাতায় জাহিলিয়াত
প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) এর যুগ থেকেই ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ চলে আসছে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রত্যেক যুগেই মানব সভ্যতা দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এ দুটি ধারার বাইরে তৃতীয় কোন ধারায় মানব সভ্যতা পরিচালিত হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আর তা হচ্ছে- ইসলাম ও জাহিলিয়াত। কোন সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হবে- হয়তো ইসলাম অনুযায়ী অথবা জাহিলিয়াত অনুযায়ী। মানুষের চিন্তাধারা হয়তো হেদায়েত হবে অথবা গুমরাহী হবে। প্রত্যেক নবী রাসুলগণের (আ.) সময়েও মানুষ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। একপক্ষ নবীগণের তাওহীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলামে প্রবেশ করেছে। বাকীরা তাওহীদকে অস্বীকার করে জাহিলিয়াতের ধারক ও বাহক হয়েছে।
ইসলামের মৌলিক আকিদা অপরিবর্তনীয়। আর তা হচ্ছে- আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, তিনিই মাবুদ, দাসত্ব করতে হবে কেবল তারই। তবে শরিয়ত বা বাস্তব জীবনের কর্মবিধান মানুষের প্রবৃদ্ধি ও বিবর্তনের সাথে সাথে তৎকালীন প্রেক্ষাপট ও চাহিদানুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) পর্যন্ত এসে ইসলামী শরিয়ত পরিপুর্ণতা ও স্থিতি লাভ করেছে। মানব সভ্যতার সর্বশেষ বিবর্তন পর্যন্ত এ শরিয়ত বলবৎ থাকবে। জীবনের সুক্ষ্ম ও খুটিঁনাটি বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ইসলামী শরিয়তে। মানব সভ্যতার সকল বিবর্তন ও সকল ভূ-খন্ডের জন্য তা পুর্ণ সামঞ্জস্যশীল ও চাহিদা পূরণে সক্ষম।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইউরোপ, আমেরিকা তথা পশ্চিমা সভ্যতার একক আধিপত্য রয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও তাদের প্রচারিত ভাবধারা, চিন্তাধারা, সংস্কৃতি, আকিদা-বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সারা পৃথিবীতে বিজয়ী ও সর্বধিক প্রভাবশালী হয়ে আছে। ইউরোপ-আমেরিকার পুরো ইতিহাসই জাহিলিয়াতের ইতিহাস। ইউরোপের পূর্বে ছিল গ্রীক জাহিলিয়াত এবং তারপরই রোমান জাহিলিয়াত। তারপর ছিল মধ্যেযুগীয় বিকৃত ধারণা সম্বলিত জাহিলিয়াত। বস্তুত গ্রীক জাহিলিয়াত ও রোমান জাহিলিয়াতই হচ্ছে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতির মুল উৎস ও ভিত্তি। তবে একথাও বাস্তব সত্য যে, আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার নবজাগরণের মূলে রয়েছে ইসলামী সভ্যতার বিরাট অবদান। একথা স্বয়ং ইউরোপীয় সভ্যতার উৎসমূহ অকপটে স্বীকার করেছে। ইসলাম থেকে ধার করা সভ্যতা ইসলামের স্বতন্ত্র তাওহীদি ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাহিলিয়াত হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এবং তা গ্রীক ও রোমান সভ্যতার প্রাথমিককালীন পৌত্তলিকতার দিকে ফিরে গিয়েছে। আচ্ছন্ন করে নিয়েছে খ্রিস্টীয় ভাবধারা।
মূল গ্রন্থঃ বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত, সাইয়েদ মুহাম্মাদ কুতুব, অনুবাদঃ মাওলানা মু. আব্দুর রহীম (রহঃ)
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




