২০০০ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেছিল, 'নায়াগ্রা ফলস ন্যাশনাল পার্ক এরিয়া' -তে । ষ্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকা গেছি দুই - তিন মাস হবে । ওকলাহোমা সিটি ইউনিভার্সিটিতে ৬ সপ্তাহের সামার ওয়ান সেমিষ্টার ( শর্ট সেমিষ্টার ) শেষ করে নিউইয়র্ক গিয়েছি বাংগালী দোকানে কাজের খোজে । জনতা গ্রোসারীর মালিক সেলিম ভাই, (এখনও জনতা গ্রোসারী আছে কি না জানি না, বেচারা খুবই ভাল মানুষ ছিলেন ) দারুল কাবাব নামে একটা রেষ্টুরেন্ট চালাতেন। সেখানেই কাজ । অমায়িক লোক, খুবই ভাল ব্যবহার ছিল ওনার।
চার পাচ সপ্তাহ কাজ করার পর ওকলাহোমা ফিরার কিছুদিন বাকী, মনে খায়েশ জাগল নায়াগ্রা ফলস দেখব । নায়াগ্রা ফলস নিউইয়র্ক শহর থেকে কয়েকশ মাইল দূরে বাফেলো শহরের কাছে । যাবার সহজ পথ গরীবের বন্ধু গ্রে হাউন্ড বাস । আট ঘন্টার রাস্তা । দূর সম্পর্কের আত্মীয় অপু ভাই তখন বাফেলো শহরে ডাক্তার । ঠিকানা ফোন নাম্বার যোগার করে , যোগাযোগ করে একদিন হাজির হলাম বাফেলো শহরে ! বিকেলের দিকে আমি যখন হাজির হলাম অপু ভাইএর অফিস তখনও শেষ হয়নি, তাই দু এক ঘন্টার মত পার করতে হবে। এরপর অপু ভাই আমাকে এসে বাসায় নিয়ে যাবে।
ভবঘুরের মত বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেরাবার একটা অভ্যাস / নেশা ছিল সে সময় । এখন অবশ্য নেই, এখন খুব সুনির্দিষ্ট লক্ষ নিয়ে পাহাড়ে ট্রেকিং - এর নেশা চেপেছে । যাই হোক নতুন কোন শহরে আমি টাউন সার্ভিসের কোন বাসে চড়ে বসতাম, যেদিকেই যায় ! সেদেশে টাউন সার্ভিস বাসগুলোকে বলে মেট্রো সার্ভিস । পথ ঘাট না চিনে নতুন শহরে ঘুরার পদ্ধতি হচ্ছে যে কোন একটা বাসে চড়ে বসবেন । বাসটা হয় হয় গুলিস্তান (নগর কেন্দ্রে যাবে ) না হয় কোন এক রুটে শহরের শেষ প্রান্তে যাবে ! সেদেশে বলে ডাউন টাউন আর আপ টাউন । ডাউন শুনে আগে নীচু কিছু মনে করতাম, সেদেশে দেখি ডাউন মানেই নগর কেন্দ্র, মানে মতিঝিল-দিলকুশা বড় বড় দালান কোঠা ! আর আপ টাউন কিছুটা গ্রাম - গ্রাম! আপনি যদি কোন রুটের শেষ সীমায় গিয়ে হাজির হন তবে ফিরতি বাসে আবার নগর কেন্দের দিকে চলে আসুন, একটা যায়গায় এসে তাবৎ রুরুটের বাস গুলো এক হয়, একেবারে আমাদের দেশের গুলিস্তানের মত, তবে বিশৃংখল ভাবে না ! সেখান থেকে আবার যেকোন আরেকটা রুটের একটা বাসে উঠে পড়েন, নিয়ে যাবে একেবারে শহরের শেষ প্রান্তে, আবার ফিরতি বাসে চলে আসুন ! সারা দিনের টিকেট পাওয়া যায়, একটা নিয়ে নিলে খরচ কম পরে। এভাবে দু তিন দিকে শহরে ঘুরে বেড়ালে অল্প সময়েই শহর সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা পাওয়া যায় । বাফেলো শহরে অবশ্য এতটা সময় হাতে ছিল না, কিছু সময় পার করার দরকার ছিল, একটা বাসে চড়ে বসলাম।
বাস দেখি একটা বিরাট লেকের পার দিয়ে যাচ্ছে, পছন্দ হওয়ায় নেমে পড়লাম। এটা ছিল ইরি লেক, ওরা বলে লেইক - ইরি । ইরি আর অন্টেরিও লেকের মাঝেই নায়াগ্রা ফলস, বাফেলো শহর থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে । বিকালের দিকে আসরের নামাজের সময় হয়েছিল, নামাজ তো যেকোন জায়গায় , পার্কে- রাস্তায় পড়া যায়, কিন্তু অযু করব কোথায় ? লেকের পানি রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা নীচে, পার বাধানো। সেটা দিয়ে বেয়ে নেমে গেলাম, অযু করে নামাজ শেষ করলাম। কিছু সময় পরে অপু ভাই এসে বাসায় নিয়ে গেলেন ।
রাতে ঘাড়ি করে নিয়ে গেলেন নায়াগ্রা ফলস ন্যাশনাল পার্ক । ঘুরে ঘুরে দেখালেন মুল জলপ্রপাত হর্স-শু ফল, ঘোড়ার খুড়ের আকৃতি । পাশেই আমেরিকান ফলস। এটা মুল জল্পড়পাতের ছার ভাগের একভাগ হবে । এরও প্রায় ১০ ভাগের একভাগ হবে খোট খাটো একটা ধরা বয়ে চলেছে এগুলোর সমান্তরালে । হর্স-শু ফলের বিপরীত দিকে কানাডা । রাতে রং বেরংএর আলোর ঝলকানি পানিতে সৃষ্ট করছে মোহনীয় রং আর রূপের খেলা । অভিভুত হওয়ার কথা ছিল, হয়ত। কিন্তু অভিভুত হতে পারিনি । যে প্রচন্ড প্রমত্ত নায়াগ্রাকে টিভিতে দেখি, বাস্তবে সেটা তো সেরকমই । বরং খানিকটা বেশী নিরীহই মনে হচ্ছিল । মোট কথা যা দেখছি, তা তো টিভিতেই দেখেছি , আগেই দেখেছি! পানির ছোয়া না পেলে, স্রোতের প্রচন্ডতা অনুভব করতে না পারলে এতদূর এসে লাভ কি হল ?
অপু ভাই বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন, এখানে কত ঘনফুট পানি মিনিটে প্রবাহিত হয়, কত চওড়া ইত্যাদী । আর মনে মনে হিসেব কষছিলাম এত ঘনফুট পানি এত চও্যা জায়গা দিয়ে পড়লে এক ফুট জায়গা দিয়ে পানি পড়ে কতটুকু । আর সেখানে পানির গতি হবে কত এসব । সব হিসেব কষে মনে হল এখনে কোন না কোন জায়গায় নামা যাবে । নামা মাত্রই টেনে নিয়ে চলে যাবে না !
জানতে চাইলাম এখানে মানুষ জন পানিতে লাফ দেয় না ? অপু ভাই বললেন অনেক টিউব-টিউব বেধে পানিতে লাফ দেয়, এদের কেউ কেউ আবার বেচেও যায় । এদের পরে জেলে দেয় , দু মাসে জেল । দু মাসে জেল ! আমি ভাবলাম তেমন বড় কিছু তো আর না । সেদিন ভাল মানুষের মত ফিরে গেলাম অপু ভাইরের সাথে ওনার বাসায়, পরিকল্পনা করলাম পরডিন আবার আসব ..
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৯:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




