১২ বছর ধরে আমি এ লেখাটি নিয়মিত পড়ছি। যখনই হতাশা আসে, সাফল্যকে অনেক দুরের কিছু মনে হয় তখনই পড়ি। একেবারে সত্য ঘটনা যা ‘রুটস’ খ্যাত লেখক আলেক্স হেলি নিজের জীবন সম্পর্কে লিখেছেন।অনুবাদ করে বেশ ভাল লেগেছে নিজের কাছে। আশা করি পড়তে আপনাদেরও ভাল লাগবে।
The Shadowland of Dreams
By Alex Haley
অনুবাদঃ রাজিব আহমেদ
মূল ইংরেজি লেখা এখানেঃ Click This Link
অনেক তরুন আমাকে বলে যে তারা লেখক হতে চায়। এ ধরনের লোকদের আমি সবসময় উৎসাহিত করি কিন্তু একই সঙ্গে তাদের এও ব্যাখা করি যে, একজন লেখক হতে চাওয়া ও লেখার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এ ধরনের বেশিরভাগ তরুন সপ্ন দেখে সফল লেখক হয়ে অনেক টাকা ও খ্যাতি অর্জনের- প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একা টাইপরাইটারের পাশে বসে থাকার স্বপ্ন তারা দেখেনা। আমি তাদের বলি, লেখক হবার ইচ্ছা নয় বরং লেখার জোরালো ইচ্ছা থাকতে হবে তোমাদের মধ্যে।
বাস্তবতা হচ্ছে লেখালেখি হচ্ছে নিঃসঙ্গ ও একাকি একটি জীবিকা যাতে টাকা আয়ের সম্ভাবনা খুবই সামান্য। হাজার হাজার লেখকের মধ্যে হয়তো মাত্র ১/২ জন সাফল্যের মুখ দেখে এবং তারা ভাগ্যবান। কিন্তু এর বিপরীতে কয়েক হাজার লেখক সারা জীবন চেষ্টাই করে যায় কিন্তু তাদের সপ্ন পূরণ হয়না। এমনকি যারা খুব সফল হয় তাদের অনেককেই লম্বা সময় ব্যর্থতা ও দারিদ্র্যের মধ্যে পার হতে হয়- আমার নিজের জীবনেই এমনটি হয়েছে।
কোস্ট গার্ডে ২০ বছর পার করার পর যখন এ চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ফ্রিল্যান্স লেখক হবার সিদ্ধান্ত নেই তখন আমার সামনে কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ছিল না। শুধু ছেলেবেলার এক বন্ধু ছিল যার সঙ্গে আমি টেনেসি অঙ্গরাজ্যের হেনিং নামক স্থানে একসঙ্গে বড় হয়েছি। সেই বন্ধু জর্জ আমাকে থাকার জন্য বিনাপয়সায় একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয় একটি এপারমেন্ট বিল্ডিং (গ্রিনউইচ ভিলেজ এপার্টমেন্ট) এর গুদাম ঘরে। জর্জ সেখানে সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে চাকরি করতো। ঘরটা ছিল বেশ ঠাণ্ডা এবং কোন বাথরুম পর্যন্ত ছিল না আমার জন্য। অবশ্য এতে আমি কিছু মনে করিনি বা করবার মত অবস্থা আমার ছিল না। আমি সাথে সাথে একটি ব্যবহৃত (হাতে চালিত) টাইপ রাইটার কিনে ফেলি এবং তখন মনে হচ্ছিল যে এতদিনে আমি একজন আসল লেখক হয়েছি।
একবছর বা তার একটু বেশি সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু আমি বলার মত কোন সাফল্যের মুখ দেখলাম না। তখন নিজের উপর সন্দেহ জাগল। গল্প বিক্রি করা অনেক কঠিন ছিল সেসময় এবং যাও দুএকটি বিক্রি করতে পারতাম তা দিয়ে এত অল্প আয় হতো যে খাবারের টাকা নিয়মিত জোগাড় করাই কঠিন ছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে লিখতে চাই- মন প্রাণ দিয়েই চাই। অনেক বছর ধরে লেখার স্বপ্ন দেখেছি। আমি তেমন ধরনের মানুষ হয়ে মরতে চাইনা যার মরনের সময় আফসোস জাগবে, যদি আমি এটা করতাম? আমি আমার স্বপ্নকে সব পরিক্ষার মধ্য দিয়ে পার করতে চাই যত অভাব অনটন আসুক বা যত অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাকে কাটাতে হোক না কেন, ব্যর্থতার যত আশংকাই আসুক না কেন। এটি আশার ছায়াভুমি এবং যার মধ্যে সত্যিকারের স্বপ্ন আছে তাকে অবশ্যই এ ভুমিতে টিকে থাকতে শিখতে হবে।
হটাত একদিন একটা ফোন আসল যা আমার জীবনকে বদলে দেয়। না আমার এজেন্ট বা কোন বড় পত্রিকার সম্পাদক বড় অফার নিয়ে আমাকে সেদিন ফোন দেয়নি। বরং বিপরীত ধরনের একজন আমাকে ফোন দিয়েছিল। লেখা ছেড়ে দেবার লোভ জাগতে পারে এমন একটি প্রস্তাব পাই। কোস্ট গার্ড চাকরিতে পূর্ব পরিচিত একজন ফোন দেয়। সে এখন সান ফ্রান্সিসকোতে কাজ করছে। এক সময় আমাকে কয়েক ডলার ধার দিয়েছিল এবং সে টাকার জন্য মাঝে মধ্যে মজা করে আমাকে খোঁচাত। “আমার ১৫ ডলার কবে ফেরত পাব, আলেক্স?”
“যখন আমি একটা লেখা বিক্রি করতে পারবো তখন।“
“আমার মাথায় এর থেকেও ভাল একটা আইডিয়া রয়েছে। আমাদের একজন পাবলিক-ইনফরমেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট দরকার, বেতন বছরে ৬,০০০ ডলার। তুমি যদি চাও তবে এ চাকরি তোমার।“
বছরে ছয় হাজার ডলার! ১৯৬০ সালে এটি যথেষ্ট ভাল মানের আয় ছিল। এ বেতন দিয়ে আমি একটা সুন্দর এপার্টমেন্ট ভাড়া করতে পারতাম, একটু পুরনো গাড়ি, আমার ধার শোধ করেও একটু একটু করে প্রতি মাসে কিছু টাকা জমাতে পারতাম। আর অবসর সময়ে টুকটাক লিখতে পারতাম।
যখন ছয় হাজার ডলারের স্বপ্ন আমার মাথার মধ্যে নৃত্য করছিল, অন্য কিছু একটা আমার অনুভুতিকে একদম পরিষ্কার করে দেয়। আমার মনের মধ্যে একটি প্রতিজ্ঞার কথা দৃঢ়ভাবে জেগে উঠে। আমি একজন লেখক হবার স্বপ্ন দেখেছি- সত্যিকারের একজন ফুল টাইম লেখক এবং সেটাই আমি হবার চেষ্টা করে যাবো। ধন্যবাদ, কিন্তু না- এ কথা আমি নিজেকে বলি। আমি লেখক হবার চেষ্টা নিয়ে লেগে থাকবো এবং লিখে চলবো।
এ ফোন কলটির পর আমি আমার ঘরের চারদিকে পায়চারী করতে থাকলাম। নিজেকে বোকা ও ব্যর্থ মনে হল। কাবার্ড খুলতেই আমার সমস্ত সম্পদ দেখতে পেলাম ও যা ছিল তা বের করলাম। সেখানে যা ছিলঃ দুই ক্যান সারদিন (মাছ)। তারপর আমার পকেটে যা ছিল বের করলাম এবং সেখানে ছিল মাত্র ১৮ সেন্ট। আমি একটা কাগজের ব্যাগে সারদিনের ক্যান ও ১৮ সেন্ট এর পয়সাগুলো রাখলাম। আমি নিজেকে শুধালাম, “এলেক্স, লেখালেখি করে এ পর্যন্ত এটুকু সম্পদই তুমি অর্জন করতে পেরেছে।“ এর আগে কখনো এত হতাশ লেগেছে কিনা নিজের কাছে আমি জানি না।
বলতে পারলে খুশি হতাম যে এরপর আমার অবস্থা অনেক ভাল হতে শুরু করে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ঈশ্বরের দয়া যে জর্জ ছিল এবং খুব খারাপ সময়ে টুকটাক সাহায্য করে আমাকে চালিয়ে নিত।
জর্জ এর মাধ্যমে আমি ঐ এলাকার অন্যান্য সংগ্রামী শিল্পীদের দেখা পাই। জো দেলানে ছিলেন টেনেসির নক্সভিল থেকে আগত একজন চিত্রশিল্পী। প্রায়ই দেখা যেত জো এর কোন খাবার নেই। তখন সে চলে যেত এক কসাইয়ের দোকানে। কসাই তাকে বড় বড় হাড় দিত যেগুলোর গায়ে অল্প সল্প মাংস লেগে থাকতো। তারপর যেত এক মুদির দোকানদারের কাছে যে প্রায় পচে যাওয়া সব্জি দান করতো। জো এই দুই মিলে সুপ বানিয়ে খেত।
ঐ গ্রামে আমার আরেকজন প্রতিবেশী ছিল হ্যারী বেলফন্টে নামক সুদর্শন এক গায়ক যে একটি রেস্টুরেন্ট চালাত। তার ব্যাবসার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে গুজব প্রচলিত ছিল যে যদি কোন একজন কাস্টমার মাংসের স্টেক অর্ডার দিত তাহলে হ্যারী দৌড়ে রাস্তার ঐ পারের সুপারমার্কেট থেকে একটি স্টেক কিনে নিয়ে আসত।
দেলানে এবং বেলফন্টের এর মত শিল্পীরা আমার কাছে রোল মডেল হয়ে উঠল। তাদের দেখে আমি শিখলাম নিজের স্বপ্ন পুরনের জন্য জীবনে অনেক আত্বত্যাগ করতে হয়। এবং এটাই ছায়ারাজ্যে বাস করার আসল দিক।
একদিকে যখন এ ধরনের আত্বত্যাগ করায় অভ্যস্ত হচ্ছিলাম তখন অন্য দিকে আস্তে আস্তে আমার লেখা বিক্রি হতে শুরু হল। আমি তখনকার সমাজের যেসব বিষয় নিয়ে অনেক মানুষ চিন্তা করছিল সেগুলো নিয়ে লিখতাম- নাগরিক অধিকার, আমেরিকার কালো মানুষ এবং আফ্রিকা। একসময় নিজের ছোট বেলার কথা মনে হতে থাকলো। আমার ঘরের নিস্তব্ধতায় আমি আমার মাতামহী, কাজিন জর্জিয়া, প্লাস খালা, লিজ খালা এবং টিল খালার আমার ছোটবেলায় আমাদের পরিবার ও দাস প্রথা নিয়ে বলা গল্প গুলো যেন আবার শুনতে পেতাম।
এ ধরনের গল্প সে সময়ের কালো মানুষেরা এড়িয়ে চলত এবং এজন্য এসব আমি নিজের মধ্যে রেখেছিলাম। কিন্তু এক দিন রিডার্স ডাইজেস্ট এর সম্পাদকদের সঙ্গে দুপুরের খাবারের সময় আমি এসব গল্পের কথা তাদের জানিয়ে বললাম যে আমার স্বপ্ন আফ্রিকা থেকে আমার পরিবার কিভাবে আমেরিকাতে এল সে গল্প ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার। সেদিন আমি এমন একটা চুক্তিতে সই করতে পারলাম যার ফলে পরের ৯ বছর ধরে গবেষণা ও লেখালেখি করতে টাকা নিয়ে আর দুশিন্তা করতে হল না।
অনেক লম্বা সময় ধরে আমার লেগে থাকতো হল। ধীরে ধীরে উন্নতি আসল। কোস্ট গার্ড এর চাকরি ছাড়ার ১৭ বছর পর ১৯৭৬ সালে আমার সফল উপন্যাস ‘রুটস” প্রকাশিত হয়। এরপর রাতারাতি আমি এত বেশি সাফল্য ও খ্যাতির মুখ দেখলাম যা খুব কম লেখকই তাদের জীবদ্দশায় উপভোগ করতে পারে। আমি আর অন্ধকার ছায়ার রাজ্যে বাস করিনা এবং আমার সামনে তখন চোখ ধাঁধানো খ্যাতির উজ্জল আলো।
জীবনে প্রথমবারের মত আমার অনেক টাকা এবং আমার জন্য সব দরজা খুলে গেল। ফোন প্রতিনিয়ত বাজত এবং তাতে নতুন বন্ধুত্ব এবং বিভিন্ন ধরনের কাজের চুক্তি পেতাম। সব গুছিয়ে লস এঞ্জেলসে চলে গেলাম যাতে করে টেলিভিশনের জন্য ‘রুটস’ অবলম্বনে যে মিনি সিরিজ বানানো হবে তাতে সাহায্য করতে পারি। এটা আমার জন্য এক হতভম্ব হয়ে যাবার মত সময় এবং সত্যি বলতে কি খ্যাতি ও সাফল্য আমাকে অন্ধ করে দেয়।
তারপ হটাত একদিন আমি যখন জিনিসপত্র গুছাচ্ছিলাম তখন একটা বাক্স খুঁজে পাই যার ভেতর সেই গ্রামে থাকাকালীন সময়ের জিনিসপত্র ছিল। ঐ বাক্সের ভেতর ছিল একটি বাদামি রঙের কাগজের ব্যাগ।
আমি কাগজের ব্যাগটি খুললাম এবং তার ভেতর ছিল দুইটি সারদিন মাছের ক্যান, ১০ সেন্টের একটি, পাঁচ সেন্টের একটি এবং ১ সেন্টের তিনটি পয়সা। সাথে সাথেই অতীতের স্মৃতি ফিরে এল আমার মনে। নিজের চোখেই যেন আবার দেখতে পাচ্ছি সেই আমাকে- একটা ঠাণ্ডা ঘরে টাইপরাইটার নিয়ে কষ্ট করে যাচ্ছি দিন রাত ধরে। আমি নিজেকে বললাম, “এই মাছের ক্যান আর পয়সা এরাও আমার শেকড়ের (রুটস) এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোন দিনই আমি তা ভুলতে পারবো না।“
এরপর এগুলোকে ফ্রেমে বাধাই করাই এবং একটি সচ্ছ প্লাস্টিক কেইসে এমনভাবে রাখি যাতে করে আমি প্রতিদিন দেখতে পাই। এখন আমি এটি নক্সভিলে অবস্থিত আমার অফিসের ডেস্কের উপর পুলিটজার পুরস্কার, রুটস মিনি সিরিজের জন্য পাওয়া ৯ টি এমি এ্যাওয়ার্ড এর ছবি এবং NAACP এর সর্বোচ্চ পুরস্কার স্পিঙ্গার্ন মেডেলের সঙ্গে রেখেছি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মুল্যবান কোনটি তা বলতে হয়তো আমার অনেক চিন্তা করতে হবে। তবে এগুলোর মধ্যে শুধু একটি স্মারকই আমার অতিতের ছায়ার রাজ্যে বসবাসের সময়ের জীবনের সাহস এবং অধ্যাবসায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
যে কারো মধ্যে আমার মত স্বপ্ন থাকলে এই সাদামাটা বিষয়টি শিখতে হবে।