পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা বৈদেশিক আগ্রাসনের ফলে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি সব হারিয়ে অন্যের ভাষা, সংস্কৃতির উপর ভর করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। ঔপনিবেশিক যুগে যখন ইউরোপিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে শাসন, শোষণ আর আগ্রাসন চালিয়েছিল তখন অনেক জাতি নিজেদের ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সব ভুলে পুরোদস্তুর দাসে পরিণত হয়েছিল। সামরিক আগ্রাসনের ফলে জাতি বিলুপ্তির ঘটনাও আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই।
কিন্তু যারা একবার জীবন দেওয়া শিখেছে তাদেরকে আর পদানত করে রাখা যায়নি। আমরা সেই গর্বিত জাতি যারা ভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য, সংস্কৃতির জন্য জীবন দেওয়া শিখেছিলাম। এ কারণেই আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্বাধীনতা কেউ চিরতরে কেড়ে নিতে পারেনি। পৃথিবীতে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার গৌরবোজ্জল ইতিহাস একমাত্র বাঙালি জাতিরই রয়েছে। এদেশের সূর্যসন্তানেরা সেদিন যদি ভাষার জন্য জীবন না দিতেন তবে আমরাও হয়ত আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের মাতৃভাষার সেই গৌরবকে পূর্ণরূপে ধরে রাখতে পেরেছি নাকি কেবল দিবসের মধ্যে ভাষাশহীদদের সম্মানকে, বাংলা ভাষার গৌরবকে আবদ্ধ করে রেখেছি?
নিজ বাসভূমে সেই ভাষা এখন পরবাসী, তার অঙ্গে এখন বহুবিধ লজ্জার স্পর্শ। আমরা অধিকাংশই শুদ্ধরূপে বাংলা বলতে ও লিখতে পারি না কিন্তু সেটা সেখার জন্য ন্যুনতম চেষ্টাও করি না অথচ ইংরেজিতে এক লাইন শুদ্ধ বলতে পারাকে খুব গর্বের মনে করি। বাংলা বলার মধ্যেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহারকে আধুনিকতা মনে করি। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি একথা বলার চেষ্টা করেছিল যে বাংলা সাহিত্যের ভাষা, কিন্তু কাজের ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষার বাহন নয়-সে কথাই আজ স্বাধীন দেশে যেন কার্যত সত্যে প্রমাণিত হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষার জন্য মায়া কান্না অঝোরে ঝরতে থাকে, কিন্তু এই দিবসেই কেবল আমরা ভাষার কথা স্মরণ করি, সারা বছর পড়ি ইংরেজি মাধ্যমে। উচ্চশিক্ষা, অফিস-আদালত, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারি এক কথায় উচ্চপর্যায়ের প্রায় সব অঙ্গনেই এখন রাজত্ব করছে বিদেশি ভাষা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৮