সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালোবাসার কবি ছিলেন। ভালোবাসেত জানতেন। তাঁর `হঠাৎ নীরার জন্যে', `শাদাপৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে', `সেই মুহূর্তে নীরা', `কায়দাটা শিখে নেবে', `ভোরবেলার উপহার' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ বাংলা ভাষার তরুণ-তরুণির হৃদয়ে চিরকাল তারুন্য ছড়াবে। সুনীলের কাকাবাবু সিরিজ শিশু-যুবক-বুড়ো সবারই খুব প্রিয়। বিশেষ করে কাকাবাবু সিরিজের `সবুজ দ্বীপের রাজা', `কাকাবাবু ও সিন্দুকরহস্য', `কাকাবাবু ও বর্জ্রলামা', `সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায়', `জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল', `ভয়ংকর সুন্দর', `সন্তু ও একটুকরো চাঁদ', `কাকাবাবু হারিয়ে গেলেন?', `কলকাতার জঙ্গলে', `ভূপাল রহস্য', `পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক', `খালি জাহাজের রহস্য', `আগুন পাখির রহস্য', `কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারী', `সাধুবাবার হাত', `উল্কা রহস্য', `কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী', `এবার কাকাবাবুর প্রতিশোধ', `মিশর রহস্য', `কাকাবাবু ও আশ্চার্য দ্বীপ', `আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে', `কাকাবাবু ও জলদস্যু' বিজয় নগরের হিরে' ইত্যাদি বইগুলো খুব পাঠকের হৃদয় জয় করেছে।
এছাড়া সুনীলের বহুল পঠিত বইগুলো হল `শ্রেষ্ঠ গল্প', `নীললোহিত সমগ্র', `সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা', `স্বৃতিরা সাহারা', `কবিতা সমগ্র', `সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে', `আমার স্বপ্ন' প্রভৃতি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিভিন্ন ছদ্মনামেও লিখতেন। নীললোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপধ্যায় ছিল সুনীলের ছদ্মনাম। তিনি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, শিশুতোষ ইত্যাদি। তাঁর লিখিত বইয়রে সংথ্যা ২০০-এর উপরে। অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায় সুনীলের উপন্যাস `অরন্যের দিনরাত্রী' ও `প্রতিদ্বন্দ্বী' কে চলচ্চিত্রে রূপায়ন করেছেন। আর বিশিষ্ট পরিচালক গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রায়ন করেছেন সুনীলের লালনকে নিয়ে লেখা উপন্যাস `মনের মানুষ'। সুনীলের `স্বৃতির শহর' কবিতাটি অপর্না সেন তাঁর `ইতি মৃনালিনী' (২০১১) ছবিতে গান হিসেবে ব্যবহার করেন।
সুনীল তাঁর লেখনির জন্যে ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুইবার আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৮২ সালে সুনীল পান বঙ্কিম পুরস্কার। আর ১৯৮৫ সালে পান সাহিত্য আকাদমি পুরস্কার। ২০০২ সালে সুনীল `কলকাতার সেরিফ' উপাধী পান। ২০০৪ সালে লাভ করেন `স্বরস্বতী সম্মাননা'। ২০১১ সালে পান হিন্দু সাহিত্য পুরস্কার। ২০১২ সালে সুনীল অর্জন করেন স্টার আনন্দ প্রদত্ত সেরা বাঙালি লাইফ টাইম এচিভমেন্ট পদক। এছাড়া মাত্র কয়েক দিন আগে সর্বশেষ সুনীল পান `সুরমা চৌধুরী স্মৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার'।
আমেরিকার বিখ্যাত কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ ভারত সফরের সময় থেকে সুনীলের খুব ভালো বন্ধু। তাঁর বাংলাদেশ নিয়ে বিখ্যাত কবিতা `September on Jessore Road'-এ এ্যালেন সুনীলের নাম উচ্চারণ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে সুনীল বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে জন্মস্থানের মানুষের পক্ষে কলম যুদ্ধ করেছেন।
১৯৬৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সুনীল বিয়ে করেন স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁদের একমাত্র পুত্র সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ২০ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে। ২০০৬ সালের ৪ নভেম্বর সুনীল দাদুভাই হওয়ার গৌরব লাভ করেন।
সুনীল ছিলেন `কৃত্তিবাস' সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু হওয়া সাহিত্যের এই কাগজটি দীর্গদিন নতুন প্রজন্মের সাহিত্য চর্চায় অগ্রনি ভূমিকা পালন করেছে। পরে সুনীল কলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপের বিভিন্ন প্রকাশনায় নিয়মিত লিখতে থকেন। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্ট্যোপাধ্যায়ের পর কোনো দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের সাহিত্য আকাদমির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিশুকিশোর আকাদমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫১ সালে সুনীলের প্রথম কবিতা `একটি চিঠি' প্রকাশিত হয় দেশ ম্যাগাজিনে। একই বছরে সুনীল `আগামী সাহিত্য'-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। রমাপদ চট্ট্যোপাধ্যায় সম্পাদিত `ইদানিং' সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় সুনীলের প্রথম গল্প `বাছা'। ১৯৫৩ সালে `কবিতা' ম্যাগাজিনে সুনীলের চতুর্থ কবিতা `তুমি' ছাপা হওয়ার পর সাহিত্যাঙ্গনে সুনীলের নাম সবার মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করলো। অর্থনীতিতে স্নাতক পাশ করার পর ১৯৫৪ সালে সুনীল ইউনেস্কোর এ্যাডাল্ট এডুকেশান স্কিমে যোগদান করেন। কিন্তু তিন মাস পরেই চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর যোগ দেন নিউ ইন্ডিয়া এ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে একজন ট্রেইনি অফিসার হিসেবে। কিন্তু কিছুদিন না যেতে ওটিও ছেড়ে দেন। তারপর শুরু করেন টিউশানি। ১৯৭০ সালে সুনীল আনন্দবাজার পত্রিকায় একজন সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুনীল দেশ ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৭৭ সাল থেকে সুনীল দক্ষিণ কলকাতার ২৪ মান্দেভেইল গার্ডেনের পারিজাত ফ্লাটে বসবাস শুরু করেন। আর সেই পারিজাত ভবনেই গতকাল রাত ২টায় (২৩ অক্টোবর ২০১২) ঘুমের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি লেখা শুরু করেছিলেন `ছোটোদের মহাভারত'। এই বইটি তিনি অর্ধেকের মতো লিখেছেন। বাকী অর্ধেক শেষ করার আগেই সুনীল ছবির দেশে কবিতার মানুষ হয়ে গেলেন। কিন্তু যতোদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, যতোদিন সারাবিশ্বে বাংলাভাষার মানুষ থাকবে, ততোদিন সুনীলের অন্তঃত তিনটি সেরা বই `সেই সময়', `প্রথম আলো' আর `পূর্ব-পশ্চিম' টিকে থাকেব, এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সুনীলের বাবা কালিপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ইশকুল মাস্টার। আর মা মীরা গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন গৃহিনী।
.... ভালোবাসারই মতোন, কবিতা নেয় অনেক বেশি, দেয় খুব কম। শুষে নেয় জীবনীশক্তি, ফিরিয়ে দেয় শুধু এক সম্ভাবনার ঝলক...- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:৩৯