somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।। আমার হাইস্কুল।। পর্ব-১ ।।

২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস। ক্লাশ ফাইভের দুটো পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। প্রথমটা স্কলারশিপ। দ্বিতীয়টা সেন্টার পরীক্ষা। আমাদের নাজিরপুর থানা থেকে ক্লাশ ফাইভে মোট ১৩ জন বৃত্তি পেল। মাত্র দুইজন ট্যালেন্টপুলে। সেই দুইজনের একজন আমি। আরেকজন আমার বন্ধু শিমুল। শিমুলের সঙ্গে তখনো আমার পরিচয় নেই। শিমুল শাঁখারীকাঠি স্কুলের ছাত্র। আর আমি চর বানিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। একই বছর আমার বড় ভাই বিয়ে করলেন শাঁখারীকাঠি মল্লিক বাড়িতে। শিমুল সম্পর্কে আমার বড় ভাবী'র চাচা। সেই সূত্রে পরে শিমুলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরু। শিমুল আমারে ডাকে মামু। আর আমি শিমুলকে ডাকি তালোই-মামু। সেই সম্পর্ক এখনো অটুট।
তো কয়েক দিন পরে সেন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। বরইবুনিয়া সেন্টারে আমাদের মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের সবগুলো প্রাইমারি স্কুলের ক্লাশ ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছিল একসঙ্গে। সেই পরীক্ষায় আমি সেন্টার ফার্স্ট হলাম। সেই বয়সে সারা গ্রামেই আমি বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলাম। এরপর ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হলাম দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১ লা ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সালে দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাশ সিক্সের প্রথম ক্লাশ। আমরা ক্লাশে তখন প্রায় ১৩৩ জন। ক্লাশ নিতে আসলেন দুই'জন স্যার। হেডস্যার বাবু মনীন্দ্র নাথ মজুমদার। আর বাংলার স্যার বাবু নির্মল কান্তি মিস্ত্রী। হেডস্যার সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। নিজেকে এবং নির্মল স্যারকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে স্কলারশিপ পেয়েছো কে কে? তারা দাঁড়াও?
গোটা ক্লাশে ১৩৩ জন। তার মধ্যে স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্রছাত্রী দাঁড়ালো ৬ জন। ছেলেদের এপাশে একেবারে সামনের বেঞ্চ থেকে তাপস কুমার মল্লিক। সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে বাবুলাল মিস্ত্রী। থার্ড বেঞ্চ থেকে স্বপন কৃমার করাতী। একেবারে পেছনের দিকের একটা বেঞ্চ থেকে আমিও দাঁড়ালাম। মেয়েদের পাশের রো থেকে দাঁড়ালো সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে শাহনাজ খাতুন। আর পেছনের দিকের একটা বেঞ্চ থেকে দাঁড়ালো ঝর্না রানী ঢালী। কারো সঙ্গেই তখনো পরিচয় হয়নি। কেবল আমাদের স্কুল থেকে যারা ভর্তি হয়েছি তারা ছাড়া। আমাদের স্কুল থেকে তখন এসেছিলাম আমি, প্রকাশ কুমার মণ্ডল, জীবন কৃষ্ণ ঘরামী, সুনীল কুমার মণ্ডল, সুবোধ চন্দ্র মণ্ডল, শেখ মোঃ কামরুজ্জামান, কেরামত আলী শেখ, সুভাষিনী পাইক ও পারুল রানী ঘরামী। আমরা এই নয় জন ক্লাশ ওয়ান থেকে একই স্কুলে ছিলাম। আমরা পরম্পর পরিচিত। নতুন কারোর সঙ্গে তখনো পরিচয় হয়নি। হেডস্যার সবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আর একটা ছোট্ট কাগজে আমাদের ৬ জনের নাম টুকে নিলেন। মনে মনে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। হেডস্যার চলে যাবার পর নির্মল স্যার বললেন, হেডস্যার যাদের নাম লিখে নিলেন, তাদের জন্য একটা বিপদের খবর আছে! মুহূর্তে ভয়টা আরো বেড়ে গেল। আজকে বাড়িতে গিয়ে তোমাদের যিনি গার্ডিয়ান তাকে স্কুলে আসতে বলবা। বলবা, হেডস্যার যেতে বলেছেন। না আসলে পরে সেই বিপদের কথা বলবো। এটা এখন একটু রহস্য হয়েই থাকুক। কি বলো তোমরা? ক্লাশের বাকি ১২৭ জন সমস্বরে 'জি স্যার' বলে উঠলো। আর আমরা ৬ জন তখন বুক দুরুদুরু নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে।
পরবর্তীতে নির্মল স্যার আমাদের ক্লাশ টেন পর্যন্ত টানা বাংলা পড়াতেন। পরে বুঝেছিলাম নির্মল স্যার আসলে বাংলা'র স্যার। আর রহস্য নিয়ে কথা বলতেই তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। আমাদের স্কুলের আকারটি ছিল ঠিক এল সেভের। দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত সব ক্লাশরুম। এরমধ্যে একেবারে দক্ষিণের রুমটি ছাত্রাবাস। সেখানে ক্লাশ টেনের যারা পরীক্ষার্থী তারা তিন-চারজন একসঙ্গে থাকতেন। পরের কক্ষটি জীবেস স্যারে বাসা। তারপরেই আমাদের ক্লাশরুম। তারপর যথাক্রমে ক্লাশ সেভেন, ক্লাশ এইট, ক্লাশ নাইন ও ক্লাশ টেন পর পর। একেবারে উত্তর মাথার শেষ ক্লাশরুম হল ক্লাশ টেনের। এটা পুরোটা পূর্বমুখী। সামনে লম্বা বারান্দা। যেখানে আমরা ক্লাশ শুরুর আগে লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত করতাম। তারপর একটু ফাঁকা। ডানদিকে ঘুরে লাইব্রেরি ও স্যারদের বসার রুম আর সায়েন্স ল্যাবরেটরি। তারপর একই লাইনে একটু ফাঁকা রেখেই দীঘিরজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। লাইব্রেরি ও প্রাইমারি স্কুল দক্ষিণমুখী। স্কুলের সামনে একটু ফাঁকা লম্বা মাঠের মতো। তারপরেই বিশাল দিঘী। স্কুলের দিঘীর একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব কোনে একটি তালগাছ। তালগাছের পাশে দাঁড়ালে গোটা স্কুল একসঙ্গে চোখে পড়বে। তালগাছ রেখেই বিশাল খেলার মাঠ। লাইব্রেরি ও প্রাইমারি স্কুলের পেছনে দীঘিরজান বাজারের স্থায়ী দোকানগুলো। আর মাঠের একেবারে উত্তর প্রান্তেও স্থায়ী দোকান। মাঠ ছাড়িয়ে একেবারে পূর্ব পার্শ্বে মরা বলেশ্বর নদী। নদীর সাথে পার ঘেঁষে ডিস্ট্রিক বোর্ডের বিশাল রাস্তা। প্রায় সাড়ে তিন একর জমির উপর আমাদের স্কুল অবস্থিত। এর মধ্যে শনিবার আর মঙ্গলবার খেলার মাঠে দীঘিরজানের হাট বসে।
আমাদের স্কুলে মোট ১১ জন স্যার। কোনো ম্যাডাম ছিল না। একজন দপ্তরি আর একজন ঘণ্টাবাদক। নারায়ন চন্দ্র রায় হল আমাদের স্কুলের দপ্তরি। ক্লাশে বেত চালান দেওয়া আর খাতাপত্র এগিয়ে দেঔযার পাশাপাশি কোনো নোটিশ থাকলে তা নিয়ে এসে ক্লাশ টিচারের হাতে দিতেন। আর সবার প্রিয় তালেব আলী নানা হল আমাদের ছুটির ঘণ্টার বাদক। স্কুলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। আমরা সবাই ডাকতাম নানা। এগারোজন স্যার হলেন, অনন্ত কুমার মজুমদার, শুকলাল হাওলাদার, ধীরেন্দ্র নাথ হালদার, সাহাদাত হোসেন, বেলায়েত হোসেন, স্বপন গোলাদার, নিত্যানন্দ গাইন, নির্মল কান্তি মিস্ত্রী, জীবেস চন্দ্র সমদ্দার, নরেন্দ্র নাথ হালদার ও মনীন্দ্র নাথ মজুমদার। মনীন্দ্র স্যার ছিলেন আমাদের হেডস্যার। নরেন স্যার ছিলেন এসিট্যান্ট হেডমাস্টার ও ইংরেজি'র শিক্ষক। জীবেস স্যার ছিলেন ইংরেজি ও একাউন্টিং শিক্ষক। নির্মল স্যার ছিলেন বাংলার শিক্ষক। মাঝে মাঝে ধর্মও পড়াতেন। নিতাই স্যার ছিলেন অংক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক। স্বপন স্যার ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। ক্লাশ নাইনে আমরা স্বপন স্যারকে প্রথম পাই। বেলায়েত স্যার ছিলেন ভূগোল ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। সাহাদাত স্যার ছিলেন অংক, বিজ্ঞান, ইসলাম ধর্ম ও আরবী'র শিক্ষক। ধীরেন স্যার ঠিলেন ইংরেজি ও ইতিহাসের শিক্ষক। শুকলাল স্যার হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃত পড়াতেন। এছাড়া স্কুলের দাপ্তরিক কাজ করতেন শুকলাল স্যার। আর অনন্ত স্যার বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন।
আর কোনো ক্লাশে স্যারদের সংকট থাকলে তখন হেডস্যার প্রক্সি ক্লাশ নিতেন। হেডস্যার ছিলেন বাংলা সাহিত্যে এমএ ও এমএবিএড। ভাষা বিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সরাসরি ছাত্র। হেডস্যার ক্লাশে প্রায়ই আমাদের স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ নিয়ে খুব ঝামেলায় ফেলতেন। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন ট্রানস্লেশানও দিতেন। আবার হুট করে কখনো ভূগোল বা চলতি বিশ্ব থেকে জিজ্ঞাসা করতেন। আমার বাংলায় সত্যিকারের কুশলী হাতেখড়ি হয়েছিল নির্মল স্যারে কাছে। আর অংকে নিতাই স্যারের কাছে। এছাড়া ইংরেজি যা শেখার তার প্রায় সবটুকু অবদান জীবেস স্যারের। মাঝে মাঝে নরেন স্যারের কাছেও ইংরেজি'র অনেক নারী নক্ষত্রের শিক্ষা পেয়েছিলাম। বিশেষ করে ভয়েস চেইঞ্জ ও ন্যারেসান, ট্রানস্লেশান ও প‌্যারাগ্রাফ রাইটিংয়ে। আর সাহাদাত স্যারের কড়াকড়ি ইসলাম ধর্ম ও আরবী থেকে বাঁচতে আমি হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃত নিয়েছিলাম। পরে ক্লাশ টেনের ফাইনালের সময় ধর্মের বদলে একাউনিং নিয়ে এসএসসি দিয়েছিলাম।
হাইস্কুল লাইফের সেই সব হাজার হাজার ঘটনা থেকে এখানে কিছু কিছু মজার স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। একবার নির্মল স্যারের খুব প্রিয় ছাত্র হয়ে গেলাম কোনো এক ভাব-সম্প্রসারণে ভিন্ন স্বাদ দিয়ে। ক্লাশের প্রায় সবাই লিখেছিল- কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবার সমান রাঙা। আর আমি লিখেছিলাম, নানান রঙের গাভীরে ভাই, একই রঙের দুধ। আর একটা মজার বিষয়ে কোথায় যেনো উদাহরণ দিয়েছিলাম- আগে কুটিয়াল, পরে অন্য। সেই হাইস্কুল জীবন মোর পুষ্পে ফলে ধন্য। গোটা হাইস্কুলে টানা ফার্স্টবয় হয়ে বলতে গেলে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলাম। সে কথা পরের পর্বে বলবো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:৫৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×