somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হ্যারিকে খুব মিস করি !!!

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩১শে মে থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে। ওটি ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ১৭তম আসর। তাছাড়া ওটা ছিল প্রথমবারের মতো দুইটি দেশে এক সাথে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার কোনো প্রথম আয়োজন। পাশাপাশি সেবারের বিশ্বকাপ ছিল প্রথম কোনো বিশ্বকাপ, যা ইউরোপ বা আমেরিকা মহাদেশের বাইরে এশিয়া মহাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপের ফাইনালে অবশ্য জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে ব্রাজিল ৫ম বারের মত বিশ্বকাপ জয় করেছিল। সেকথা এখন ইতিহাস। কিন্তু ২০০২ সালের কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপের একটি খেলার কথা হয়তো বন্ধুদের এখনও মনে থাকার কথা। কারণ সেদিন মনে রাখার মত দুইটি ঘটনা ঘটেছিল। একটা হল আমাদের বসনিয়ান বন্ধু হ্যারি সেদিন বাংলাদেশ থেকে জাপানে যাচ্ছিল। আর অন্যটি হল, সেদিন বিশ্বকাপের এফ গ্রুপ থেকে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল।

সেদিন ছিল ২০০২ সালের ৭ জুন, শুক্রবার। গ্রিনিচমিন টাইম রাত বারোটায় ছিল সেই খেলা। বাংলাদেশ সময় সকাল ছয়টায়। আমরা হ্যারিকে বিদায় দিয়ে সকাল নয়টার দিকেই চলে গেলাম শুক্রাবাদ। ভারী বৃষ্টিমুখর দিন ছিল সেদিন। সাকরিনের সাইবার ক্যাফেতে কম্পিউটার খালি পাওয়া গেল মাত্র দুইটা। নাহিদ আর রিয়াজ বসে গেল কম্পিউটারে। পবন, পুলক, নাছিম আর আমি গেলাম এ্যারামে। আমরা তখন বসে বসে শীতলক্ষ্যার জল খাচ্ছিলাম আর সকালে হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনার খেলার পুনপ্রচার এ্যারামের রঙিন টেলিভিশনে দেখছিলাম। খেলার রেজাল্ট আমাদের সবারই তখন জানাছিল। তবুও পবনের মন খারাপের অযুহাতে আমরা আবার এ্যারামে বসে সেই খেলা দেখছিলাম।

ওই সময় আমরা থাকতাম কাঁঠালবাগানের ঐতিহাসিক আমিন নিলয়ের দোতলায় । আমিন নিলয়ের সেই ব্যাচেলর কোয়ার্টার ঐতিহাসিক হবার পেছনে অনেক কারণ আছে। মুকুল, পবন, অজয়, নাছিম, রিয়াজ, পুলক, মনিদা, হ্যারি আর আমি তখন আমিন নিলয়ের দোতলার ব্যাচেলর কোয়ার্টারের বাসিন্দা। তখন মুকুল এশিয়াটিকে, রিয়াজ অটবিতে, পবন মিশু অ্যাডভারটাইজিংয়ে আর মণিদা জেনারেল ফার্মায় চাকরি করত। এরমধ্যে মণিদা মাসে মাত্র চার-পাঁচদিন থাকত ঢাকায়। মাসের বাকি সময়টা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অফিসিয়াল ট্যুরে করত মণিদা। বাজারে আসা হারপিকের বিকল্প একটা নতুন টয়লেট ক্লিনারের ডিলারশিপ নিয়েছিল তখন নাছিম। সারাদিন বিভিন্ন মুদি দোকানে হেঁটে হেঁটে সেই বোতল সাপ্লাই করতো নাছিম। অজয় তখন একটা কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করত। পুলক তখন বান্দরবনের কনট্রাকটরি ছেড়ে ঢাকায় এসে আমিন নিলয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমি তখন বাংলাবাজারের কাজল ব্রাদার্সের জন্য ক্লাস নাইন-টেনের অর্থনীতি গাইড লেখার একটা টেম্পরারি কাজ পেলাম। মিস্টার ননী গোপাল প্রতি শনিবার আমিন নিলয়ে এসে পুরো সপ্তাহের লেখা নিয়ে যেতেন আর কিছু টাকা দিয়ে যেতেন। আর আমাদের বসনিয়ান বন্ধু হ্যারি তখন ফুলটাইম সাইবারম্যান। মাদোকা নামে এক জাপানি মেয়ের সঙ্গে তখন চলছিল হ্যারির একেবারে টাইট অনলাইন প্রেম।

পবন আর্জেন্টিনা দলের একজন অন্ধ সমর্থক। পবনের দল আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিবে কিনা এমন একটি সংশয় তৈরি হলো তখন। সেই কষ্ট ভুলতে আমরা পবনের নেতৃত্বে এ্যারামে হাজির হলাম। জাপানের উত্তরাঞ্চলের সাপ্পারো ডোমে অনুষ্ঠিত সেই খেলায় আর্জেন্টিনা ছিল বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট দল। কিন্তু খেলায় আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরে গেল। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ১৯৮২ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ৭৪ দিন ব্যাপি ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনার যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ইংল্যান্ড জয়ী হয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যে কোনো খেলা পড়লে সেই খেলাটিও উভয় দলের সমর্থকদের মধ্যে তখন যুদ্ধের মত উক্তেজনা ছড়াত।

আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ায় পবনের তখন ভীষণ মন খারাপ। সকালে হ্যারি জাপান চলে যাওয়ায় আমাদের সবারও তখন কিছুটা মন খারাপ। আমরা এ্যারামের আলো-আঁধারিতে বসে বসে সেই খেলার পুনপ্রচার দেখছিলাম আর গলায় শীতলক্ষ্যা ঢালছিলাম। খেলার প্রথমার্ধের ৪৪ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার ডি-বক্সের ভেতরে ইংল্যান্ডের মাইকেল ওয়েনকে ফাউল করেছিল আর্জেন্টিনার ৪ নাম্বার জার্সিধারী খেলোয়াড় মাউরিসিও পোসেত্তিনি। ইতালিয়ান রেফারি পিয়ারলুইগি কোল্লিনা বিতর্কিত ওই ফাউলের কারণে ইংল্যান্ডকে পেনাল্টি দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ও গেমমেকার ডেভিড ব্যাকহাম পেনাল্টি থেকে গোল করে প্রথমার্ধেই দলকে ১-০ গোলের লিড এনে দিয়েছিলেন। সেই লিডই খেলার শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছিল ইংল্যান্ড। গ্রুপের অপর ম্যাচে সুইডেন নাইজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপের শীর্ষে উঠে গিয়েছিল।

এর আগে ২ জুন এফ গ্রুপের প্রথম খেলায় আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। আর এফ গ্রুপের অপর ম্যাচে সুইডেন বনাম ইংল্যান্ডের খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। সে বছর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড একই গ্রুপে পড়ায় ৭ জুনের খেলাটি বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে নতুন উক্তেজনা ছড়িয়েছিল। পরের সপ্তাহে ১২ জুন গ্রুপের শেষ খেলায় আর্জেন্টিনা বনাম সুইডেনের খেলাটি ১-১ গোলে এবং ইংল্যান্ড বনাম নাইজেরিয়ার খেলাটি গোল শূন্য ড্র হলে এফ গ্রুপ থেকে আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ডেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর গোল ব্যবধানে এফ গ্রুপ থেকে সুইডেন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও ইংল্যান্ড গ্রুপ রানারআপ হিসাবে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এফ গ্রুপ থেকে সে বছর আর্জন্টিনা ও নাইজেরিয়া প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছিল।

কাঁঠালবাগানের আমিন নিলয়ের দোতলায় সেটা ছিল এক বিরল কিসিমের বাসা। ওটা ঠিক দোতলাও নয়। হাফ সিঁড়ি পর্যন্ত সোজা উঠে তারপর পশ্চিম দিকে তিন সিঁড়ি উঠলেই আমাদের ব্যাচেলর কোয়ার্টার। ঘরে ঢুকেই প্রথম যে রুম, সেখানে একটা তিনপায়া চৌকি ছিল। সাধারণত বাইরে যাবার সময় ওই চৌকিতে বসে আমরা কেটস বা জুতা পড়তাম। একেবারে সামনের রুমটা ছিল আমাদের থাকা ও আড্ডার রুম। যার সঙ্গে ঠিক দক্ষিণ পাশে ছিল একটা ছোট্ট বেলকুনি। বেশি রাতে গেট বন্ধ থাকলে দোতলার সেই বেলকুনি দিয়ে আমরা অনায়াসে বাসায় ঢুকতাম বা বের হতাম। আর একেবারে পেছনে কিচেন ও একমাত্র বাথরুমের সঙ্গে একটা ছোট্ট রুম ছিল। সেখানে একটা খাট ছিল। কারো এমার্জেন্সি ঘুমের দরকার হলে সেখানে ঘুমাত।

আমিন নিলয়ের ব্যাচেলর বাসায় তখন বলতে গেলে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই চলত আমাদের ননস্টপ আড্ডা। কারো এমার্জেন্সি ঘুমানোর দরকার হলে পেছনের রুমে গিয়ে ঘুমাত। মাঝে মধ্যে মাঝের রুমের সেই তিনপায়া চৌকিতে হ্যারি ঘুমাত। সকালে অফিসে যাবার সময় প্রায়ই পবন আর হ্যারির মধ্যে একটা তুখোর যুদ্ধ লাগত। পবন জুতা পড়ার সময় চৌকিতে বসত। হ্যারি চোখ পিটপিট করে দেখত- কে বসেছে! পবন ইচ্ছে করেই তখন চৌকি দোলা দিত। আর হ্যারির ঘুম যেত ছুটে। হ্যারি উঠে পবনের সাথে এই নিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিত। হ্যারি দাবি করত- শালা, তুমি নাড়াইছো? জবাবে পবন বলত, আমি তো জুতা পড়ছি, দ্যাখো না শালা, নাড়ালাম কোই?

দোকানে দোকানে নাছিম যে টয়লেট ক্লিনারের বোতল সাপ্লাই দিত, বিক্রি হওয়া খালি বোতল গুলো নাছিম নিজ দায়িত্বে আবার সংগ্রহ করত। বাসায় ফিরে নাছিম সেই তিনপায়া চৌকির নিচে রাখা ইনট্যাক্ট বোতল খুলে একটা অপারেশন চালাত। প্রায় সময় নাছিমের সেই অপারেশনের সাক্ষি হতো হ্যারি। তিন-চারটা ইনট্যাক্ট বোতল খুলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা খালি বোতলে একটু একটু করে লিকুইড ঢেলে আর পানি মিশিয়ে নতুন আরেকটা ইনট্যাক্ট বোতল বানাত নাছিম। হ্যারি এই দৃশ্য দেখে কইত- শালা দুই নাম্বারি মারাও। জবাবে নাছিম বলত- হ্যারি, তুমি কী জানো? জানো, আমি তিন মাসের একটা সার্টিফিকেট কোর্স করেছি? এই লিকুইডের সঙ্গে কত পার্সেন্ট পানি মেশাতে হবে, এটা আমি জানি। তুমি শালা না জেনেই আমারে দুই নাম্বার কও? হ্যারি পাল্টা জবাবে বলত- আমাদের দেশে কেমিস্ট হতে দশ বারো বছর লাগে। আর তোমাদের দেশে শালা তুমি তিন মাসে কেমিস্ট হইছো? শালা... দুই নাম্বার...

এই নিয়ে হ্যারি আর নাছিমের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লাগত। একবার রাত একটার দিকে যথারীতি পবন বা নাছিমের সাথে যুদ্ধ করে হ্যারি খুব বিরক্ত। হ্যারি সিদ্ধান্ত নিল তখনই উত্তরা যাবে। উত্তরা নাকি হ্যারির এক ফুফুর বাসা আছে! তো হ্যারি তখন চোখ পিটপিট করছিল আর রাগে ক্ষোভে একটা একটা করে জামা গায়ে দিচ্ছিল। একেবারে উপরে একটা কালো পাঞ্জাবি পড়ল হ্যারি। রিয়াজ আর পুলক জানতে চাইল, এত রাতে তুমি উত্তরা যাইবা ক্যামনে? জবাবে হ্যারি পকেট থেকে একটা টুপিও বের করে মাথায় দিয়ে বলল- এইবার আল্লাহ-বিল্লাহ করতে করতে হেঁটে হেঁটে চলে যাব। পরে অবশ্য হ্যারির আর উত্তরা যাওয়া হয়নি। আমরা মুকুলের নেতৃত্বে তখন সেই শীতের রাতে দোতলার বেলকুনি টপকে নিচে গিয়ে বুড়ির দোকানে চা খেয়েছিলাম।

হ্যারি খুব ভালো খোল বাজাতে পারত। সুযোগ পেলে প্রায়ই পবনের ক্যাসেট প্লেয়ারে মান্না দে'র গান ছেড়ে দিয়ে হ্যারি তবলা প্রাকটিস করত। সেই প্রাকটিসের কোনো টাইম লাইন ছিল না। দুপুর হোক আর রাত-দুপুর হোক, হ্যারির ইচ্ছা হলেই সেই তবলা প্রাকটিস চলত। পবনের পাল্টা-আক্রমন ছাড়া যা কখনো বন্ধ হতো না। হ্যারি কখনো রান্না করা ভাত খেত না। রান্না করা ভাত হ্যারি আবার কড়াইতে তেলে ভাজত। তারপর সেই ভাত-ভাজা খেত। সঙ্গে কখনো একটু ডিম বা মাংস নিত। ঢাকার রাস্তায় তখন যত পুলিশ ডিউটি করত, প্রায় সবাই হ্যারিকে দেখলেই চিনত। আমরা কোথাও যাওয়ার সময় হ্যারি বসত রিক্সার মাঝখানে একেবারে উপরে। অনেক মানুষই হ্যারিকে চিনত। এপাশ ওপাশ দিয়ে তখন 'হাই হ্যারি' বলে অনেকেই হ্যারির সঙ্গে কুশল বিনিময় করত।

একবার বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে কোহেলদের একটা নাটকের শো'র আগে দুপুরে সেট করার সময় সময় পবন বলল, এই হারমোনিয়ামে শো করা যাবে না। পুরাই ডিসটিউন ছিল ওটা। তখন একটাই উপায়, আমিন নিলয় থেকে কেউ এসে পবনের হারমোনিয়াম আবার নিতে হবে। হ্যারি বলল, কেউ আমার সাইবার ক্যাফের চ্যাটিংয়ের জন্য একশো টাকা স্পন্সর করলে কাঁঠালবাগান থেকে আমি হারমোনিয়াম এনে দেব। পবন একশো টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। হ্যারি সেই ঠা ঠা দুপুরে বেইলি রোড থেকে পায়ে হেঁটে কাঁঠালবাগানের আমিন নিলয় থেকে হারমোনিয়াম মাথায় করে আবার পায়ে হেঁটে বেইলি রোডে পৌঁছাল। পরে পবন হ্যারিকে একশো টাকা দিতে বাধ্য হয়েছিল। হ্যারি সেদিন শো না দেখে একশো টাকা নিয়েই তখন শুক্রাবাদের সাইবার ক্যাফেতে ছুটেছিল মাদোকার সঙ্গে প্রেম করতে।

ধানমন্ডির শুক্রাবাদ বাস স্টপিজের পাশে ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি। ওই ইউনিভার্সিটির পাশেই একটি ভাবনের দোতলায় ছিল সাকরিন-তুহিন ভাইদের সাইবার ক্যাফে। ওটা তখন আমাদের আরেকটা আড্ডার জায়গা। ওই একই বিল্ডিংয়ের চার তলায় ছিল অপু'দার আরেকটা সাইবার ক্যাফে। আসলে অপু'দা-ফাহমিদা আপারা প্রথম ওই বিল্ডিংয়ে সাইবার ক্যাফে খুলেছিলেন। ওটা ছিল এসি আর সাকরিনদেরটা ছিল নন-এসি। হ্যারি আমাদের বন্ধু হওয়ার কারণে ওই দুটো সাইবার ক্যাফেতেই হ্যারি বাকিতে বসতে পারত। পরে আমরা বন্ধুরা গিয়ে হ্যারির বকেয়া পরিশোধ করতাম।

একবার অপুদা পুরানো বকেয়ার জন্য সারাদিন হ্যারিকে আটকে রেখেছিলেন। সন্ধ্যায় আমরা শুক্রাবাদ যাবার পর হ্যারি আমাদের কাছে নালিশ করল। নাছিম সেদিন অপুদার বকেয়া পরিশোধ করেছিল। সেদিন অপুদার সঙ্গে নাছিম আচ্ছামত ঝগড়াও করেছিল, কেন হ্যারিকে তিনি সারাদিন আটকে রাখলেন সেজন্য। পরে অনেকদিন পর্যন্ত অপুদার সাইবার ক্যাফে আমরা এড়িয়ে চললাম। হ্যারিকেও আমরা ওখানে যাবার জন্য নিষেধ করেছিলাম। পরে অবশ্য বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলায় হঠাৎ অপুদার সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়ায়, সেদিনের সেই ঘটনায় তিনি সরি বলেছিলেন। পরে অপুদার সাইবারে আমরা আবার যাওয়া শুরু করেছিলাম।

আমিন নিলয়ে তখন আমাদের নিয়মিত আড্ডায় আসতো বন্ধুদের মধ্যে নয়নমণি চৌধুরী, জায়েদউদ্দীন, কবি জাফর আহমদ রাশেদ, গল্পকার খোকন কায়সার, গল্পকার রাজীব নূর, বড়ভাই ওস্তাদ শামীম আহমেদ, নাসরুল্লাহ মোহাম্মদ নাহিদ, রিজভি আহমেদ জনি, আলমগীর বিপ্লব, শিবলী প্রমুখ। এছাড়া মাঝেমাঝে চট্টগ্রাম থেকে আসতো মোসলেমউদ্দীন চৌধুরী লিটন, কোহেল, স্বপন আর বাপ্পী।

আমিন নিলয়ের বাসাতেই মূলত আমাদের নাটকের দল পালাকারের তখন জন্ম পর্বের শুরু। ওই সময়ে মুকুলের নেতৃত্বে ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ ১৪০৯ সালে সিদ্বেশ্বরীর মাঠের পাশের দোতলা ফাঁকা বাড়িতে পালাকার নাট্যদলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পালাকারের তখন আনুষ্ঠানিক পোস্ট ছিল মাত্র দুইটি। দলপ্রধান বা অধিকার বাবু হলো মুকুল। আর দলের হিসাব নিকাশ সামলানোর জন্য ম্যানেজার বাবু হলো নয়নমণি চৌধুরী। পালাকারের শ্লোগান ঠিক করা হলো কবি জীবনানন্দ দাশের 'সুচেতনা' কবিতার শেষ চরণ 'শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়' দিয়ে। পালাকারের উদ্ভোধনী সঙ্গীত লিখলেন কবি জাফর আহমদ রাশেদ। উদ্ভোধনী সঙ্গীতের সুর করল সুদ্ত্ত চক্রবর্তী পবন। হঠাৎ করে মণিদার জেনারেল ফার্মাসিটিক্যালে চাকরি নিয়ে তখন অজয় চলে গেল কক্সবাজার। ফলে অজয়ের বদলে তখন পবনের সঙ্গে ধামাক্কা-ধাক উল্টাপাল্টা ঢোল বাজাতাম আমি। ওটা ঠিক ঢোল ছিল না, আসলে ওটা ছিল তবলার বায়া। কারণ আমি তখন তবলা বাজাতে পারতাম না। যে কারণে পালাকারের উদ্ভোধনী সঙ্গীতে পবনের করা সুরে তখন তবলার বায়া বাজিয়ে আমি যে বেতাল দিয়েছিলাম, ওটাই হয়ে গিয়েছিল পালাকারের উদ্ভোধনী সঙ্গীতের তাল। পরে অবশ্য অজয় সেই তালকে একটা ফরম্যাটে ফেলেছিল। উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে গানের তালে তালে বাবুদা একটা সুন্দর কোরোরিওগ্রাফি করেছিলেন।

বন্ধু হ্যারির পুরো নাম হ্যারি এলরিজ। মনে পড়ে পালাকারের শুভ যাত্রার দিনে হ্যারিও পারফর্ম করেছিল। মূল অনুষ্ঠান শেষে সিদ্ধেশ্বরীর পালাকারের অস্থায়ী কার্যালয়ের ছাদে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মেরেছিলাম। 'আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়া রে করো তোমার মনে যাহা লয়...' গানটি হ্যারি খুব ভালো গাইত। হ্যারি হূমায়ূন আহমেদের নাটকেও এই গানটি গেয়েছিল। পালাকারের জন্য সিদ্ধেশ্বরীর ওই বাসাটা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের জাহেদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তখন। জাহেদ সেই ভূমিকা না রাখলে আসলে ওই বাসাটা তখন পাওয়া যেত না। পালাকার গঠনের সময় মোট পনেরো জন ফাউন্ডার মেম্বার ছিল। পালাকারের সেই পনেরো জন ফাউন্ডার মেম্বাররা হল- ১. আমিনুর রহমান মুকুল, ২. অনিকেত পাল বাবু, ৩. রেজাউল কবীর নাছিম, ৪. নয়ন মনি চৌধুরী, ৫. সুদত্ত চক্রবর্তী পবন, ৬. খোকন কায়সার, ৭. আলমগীর বিপ্লব, ৮. রিয়াজুল হক শিকদার, ৯. রেজা ঘটক, ১০. অজয় দাস, ১১. জাফর আহমেদ রাশেদ, ১২. রাজীব নূর, ১৩. শাহরিয়ার খান রিন্টু, ১৪. জাহেদ উদ্দিন ও ১৫. আলী আহমেদ মুকুল (ছোটো মুকুল)। অবশ্য হ্যারিকেও ফাউন্ডার মেম্বার করা উচিত ছিল। হ্যারি এখন জাপানে আছে। তবে মাদোকার সঙ্গে হ্যারির বিয়ে হয়নি। সেই গল্প পরে কোথাও করব। হ্যারির বউয়ের নাম আইয়ানো এলরিজ। আইয়ানো জাপানি মেয়ে। বন্ধুরা চল সবাই মিলে এখন কবি জাফর আহমদ রাশেদের লেখা পালাকারের সেই গানটি আমরা করি। আহা কত মধুর সেই গানটি। পবনের করা সুরটি এখনো দিব্যি মনে আছে। গানটি এরকম-

'আজ, কৃষ্ণচূড়ার পাতায় পায়ে আগুন লেগেছে,
কাল, ঝড়া পাতার রোদন ছিল
প্রসূতি মা'র বোধন হল,
আজ, কণ্ঠ থেকে আদিমতার কান্না জেগেছে
...হো হো হো... হো হো হো... হো হো হো হো হো... হো...

কাল, দিন থাকতে সূর্য গেছে নেমে,
সাথে অন্ধ পথে চন্দ্র গেছে থেমে,
আজ মেঘনা পারে ডাকবে পাখি বংশি বেজেছে
....হো হো হো... হো হো হো... হো হো হো হো হো... হো...

আজ, দিন ফুরাবে অনেক কাজের শেষে,
সব হাওয়ায় হাওয়ায় সহজে অক্লেশে,
ঠিক খুলে দেবে অভিমন্যুর পথ,
তাই দিক-বিদিকে ছুটছে রঙিন রথ,
আজ, হাতে সবার পাখির পালক, ফড়িং সেজেছে...
....হো হো হো... হো হো হো... হো হো হো হো হো... হো...
......................................
২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ঢাকা

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:২১
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×