প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের লাগাতার এক অহিংস আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতির জবাবে শেষ পর্যন্ত সরকার বাহাদুরের সুমতি হয়েছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির উপর চলতি বছরের বাজেটে আরোপিত ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন আলোচনা থেকে ভ্যাট প্রসঙ্গটি এখনো যায়নি বরং ভ্যাট নিয়ে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানান কিসিমের ভ্যাট আদায় পদ্ধতির গল্প। সাধারণ মানুষ থেকে নানান প্রতারণার মাধ্যমে নানান পদ্ধতির ভ্যাট আদায়ের ঘটনা। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের উপর বিভিন্ন মাত্রার ভ্যাট থাকায় এবং ভ্যাট আদায়কারী ব্যবসায়ী/প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় প্রতিদিন ভ্যাট নিয়ে প্রায়শ ভুল হিসাবে/হিসাবের গরমিলে ভোক্তার পকেট কাঁটা যাচ্ছে। অথচ এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ মন্ত্রণালয় বা কনজুমারর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএবি) বা সরকার বাহাদুর কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই বা ভ্যাট সম্পর্কে দেশের কোথাও কোনো মাধ্যমে তেমন কোনো জনসচেতনা মূলক কর্মসূচিও নেই। অথচ ভ্যাটের খপ্পরে দেশের নিরিহ সাধারণ মানুষ প্রতিদিন নানান কিসিমের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার বড় বড় শপিংমলে (যেমন মিনাবাজার, আগোরা, বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, পিক অ্যান্ড পে) ভ্যাট আদায় পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। একই ভাবে বড় বড় আবাসিক হোটেল, খাবার রেস্ট্রুরেন্ট, রেস্তোরাঁয় ভ্যাট আদায় পদ্ধতির মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। এমন কী ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা বা ঢাকায় বা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত বিভিন্ন ধরনের মেলার সময় সেখানকার খাবার হোটেল গুলোতে নানান কিসিমের ভৌতিক পদ্ধতির ভ্যাট আদায়ের ঘটনায় নগরবাসী বা দেশবাসীকে নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। অথচ ভ্যাট কিভাবে হিসাব করা হবে, সেই সহজ বিষয়টি জনসাধারণকে এখনো জাতীয় ভাবে সচেতন করা হয়নি। বা ভ্যাট সম্পর্কে জন সাধারণকে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রতি বছর দেশের ১৬ কোটি মানুষ ভোক্তা হিসাবে নানান পদ্ধতির ভ্যাটের খপ্পরের মুখোমুখী। যাকে এখন সত্যি সত্যিই একটি রাষ্ট্রীয় অনাচার বলঅ যায়। ভ্যাট আদায় নিয়ে নানা মহলের নানান কিসিমের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল একেবারে নিরব। ভ্যাট বিষয়ে এসব গল্প বা ঘটনার খবর জেনেও না জানার ভান করে কেবল মানুষের বিড়ম্বনাকেই নিরবে দেখে যাচ্ছে সরকার বাহাদুর।
বাংলাদেশে সরকারি রেডিও, টেলিভিশন ও সরকারি প্রজ্ঞাপনের পাশাপাশি অসংখ্য প্রাইভেট এফএম রেডিও, প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল, দৈনিক সংবাদপত্র থাকার পরেও ভ্যাট বিষয়ে দেশের মানুষ এখনো এক অন্ধকার জগতে বসবাস করছে। অথচ কিছু কেনার জন্য ঘর থেকে বাইরে আসলেই সাধারণ মানুষকে কিন্তু নানান বাহানায় নানান কিসিমের ভ্যাট প্রদান করতে হচ্ছে। আর এ থেকে এক শ্রেণীর অসৎ ব্যবসায়ী প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে প্রতিদিন ভোক্তাকে ঠকাচ্ছে। যা দেখার যেন বাংলাদেশে কেউ নেই। তাহলে ভ্যাট নামক এমন একটি রাষ্ট্রীয় অনাচারকে কেন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ নিত্যদিন মোকাবেলা করবে বা সহ্য করবে?
সাধারণ মানুষের পক্ষে ভ্যাট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাবার জন্য প্রতিটি ঘটনায় প্রতিবার ভ্যাট বিশেষজ্ঞ'র স্মরণাপন্ন হবার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু যে সকল প্রতিষ্ঠান সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছে, তারা কিন্তু ভ্যাট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে সরকারকে কতোটা ভ্যাটে ফাঁকি দেওয়া যায়, সেই টেকসই ব্যবস্থা নিয়েই ভ্যাট মোকাবেলা করছে। একদিকে এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার (না জানার) সুযোগ নিয়ে তাদের থেকে বেশি ভ্যাট আদায় করছে। অন্যদিকে এরাই আবার জনগণ/ভোক্তা থেকে আদায় করা ভ্যাট সরকারকে দেবার সময় নানান বাহানা করে, ট্যাক্স উপদেষ্টা নিয়োগ করে, ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছে। ফলে একদিকে সাধারণ মানুষের অহরহ পকেট কাঁটা যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও বিপুল পরিমাণ ন্যায্য ভ্যাট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাঝখান থেকে ভ্যাটের কারণে মুনাফা লুটছে অসৎ ব্যবসায়ী চক্র।
তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে দেশের সাধারণ মানুষকে ভ্যাট সম্পর্কে একটি ধোয়াশার মধ্যে রেখে এই অস্বচ্ছ ভ্যাট পদ্ধতি বাংলাদেশের মত একটি দেশে কতোটা বাস্তবসম্মত? যেখানে মাত্র শতকরা ৬২ ভাগ মানুষ সাক্ষরতা জ্ঞান সম্পন্ন। কিন্তু মানুষের টাকা কিভাবে মারতে হবে এ-বিষয়ে পণ্ডিত/বিশেষজ্ঞ প্রায় এসব অসৎ ব্যবসায়ী চক্রের সবাই। অর্থ্যাৎ একটি অসৎ ব্যবসায়ী চক্রকে প্রতিদিন ভ্যাটের নামে বাংলাদেশের মানুষ মোকাবেলা করছে, হারাচ্ছে পকেটের নগদ অর্থ। মাছ, মাংস, চাল, ডাল থেকে শুরু করে ফার্নিচার, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ফ্রিজ যা-ই কেনা হোক না কেন, ভ্যাটের বিষয়ে জনগণ কিন্তু ওইসব প্রতিষ্ঠান যা কেঁটে নিচ্ছে, তাই নিরবে মেনে নিচ্ছে বা দিয়ে দিচ্ছে। মেনে নিচ্ছে নিজেদের ভ্যাট সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। কিন্তু এভাবে দেশের গোটা মানুষকে অজ্ঞতার মধ্যে রেখে একটি রাষ্ট্রে ভ্যাটের মত এমন একটি ভৌতিক পদ্ধতি চালু রাখা যৌক্তিক কিনা? এমন একটি ভৌতিক সিস্টেমে ভ্যাট আদায় করাটা সত্যি সত্যিই এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। যেখানে সাধারণ মানুষ এর নিরন্তর শিকার।
দেশে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সেই অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচারের জন্য একটি সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আছে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন আছে। এছাড়া দেশে বর্তমানে অসংখ্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক বা সেলুলয়েড প্রচার মাধ্যম রয়েছে। মোবাইল ফোনে সরকার নানান ইস্যুতে নানান সময় নানান কিসিমের তথ্য প্রচার করে সরাসরি দেশের মানুষকে অবহিত করছে। এমন যে কোনো মাধ্যমে সরকার বাহাদুর ইচ্ছে করলেই জনগণকে ভ্যাট সম্পর্কে প্রতিদিনই সচেতন করতে পারে। কিন্তু এতসব সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান স্বত্ত্বেও ভ্যাট নিয়ে সরকার কেন জনসাধারণকে সচেতন করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না? তাহলে কী দেশের মানুষকে কৌশলে একটা অজ্ঞতার মধ্যে রেখে স্বয়ং সরকার বাহাদুর অশুভ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ করে দিচ্ছে? নানান কিসিমের ভৌতিক ভ্যাট আদায়ের বিদ্যমান প্রক্রিয়াকে কী তাহলে স্বয়ং সরকার বাহাদুর সমর্থন করেন?
আমরা চাই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি দপ্তর ভ্যাট বিষয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে যথাযথ ভাবে প্রশিক্ষিত করুক। কনজুমারর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএবি) ভ্যাট বিষয়ে জনসচেতসা বাড়াতে নানান কিসিমের কর্মসূচি গ্রহন করতে পারে। প্রতিটি পণ্যের ভ্যাট কত আর তা কিভাবে বের করা হবে, কোন পদ্ধতিতে ভোক্তা ভ্যাট পরিশোধ করবে, ইনক্লুসিভ না এক্সক্লুসিভ পদ্ধতিতে ভ্যাট আদায় করা হবে, সে বিষয়ে এসব মহল থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। গোটা ভ্যাট সিস্টেমকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যতক্ষণ চালু করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ দেশের মানুষ কিন্তু এই বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই প্রথম ভ্যাট বিষয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে একটা প্রতিরোধ আসায় সরকার ভ্যাট নিয়ে প্রকাশ্যে বিড়ম্বনায় পড়ল। কিন্তু দেশের ১৬ কোটি মানুষ কিন্তু নিরবে রোজ এই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। যা প্রতিরোধে কারো কোনো মাথা ব্যথা নাই। না সরকারের না দেশের জনগণের। বাংলাদেশে ভ্যাট বিষয়ে পাবলিকের দশা ফকির আলমগীরের সেই গানটির মত- 'মর শালা পাবলিক ধুকে ধুকে মর....'। আর কতকাল দেশের মানুষ এই ভ্যাট নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাবে? আর কত টাইপের ভ্যাট আমরা রোজ নিরবে অজ্ঞতার কারণে কেবল পকেট থেকে দেব? আর কত জনগণের পকেট কাঁটা হবে? কবে দেশে স্বচ্ছ একটি ভ্যাট আদায় পদ্ধতি চালু হবে?
..............................
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১৫