গত ৮ জুন ২০১৫ সালে ইতালির কোরিয়ারে ডেল্লা সেরা পত্রিকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সাংবাদিক লুসিয়ানো ফোনতানা'র নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে সম্প্রতি অনুবাদ করেছেন জুলিয়া গ্যাব্রিয়েলে বার্নেস। কারণ পুতিন সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটি বিশ্বমানচিত্র অংকন করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে যেখানে সেনা মোতায়েন রয়েছে, তা চিন্থিত করুন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার পার্থক্য স্পষ্ট বুঝতে পারবেন! পুতিনের সেই সাক্ষাৎকারটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে এখনো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিন পর্বে সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি এবার বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। এবার যাচ্ছে প্রথম পর্ব।
লুসিয়ানো ফোনতানা: ইতালি ও রাশিয়ার সম্পর্ক দিয়েই আমি প্রশ্নের সূত্রপাত করতে চাই। ইতালি'র সঙ্গে বর্তমানে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর এবং সোহার্দপূর্ণ। কিন্তু ইউক্রেনে অভিযানের পর সেই সম্পর্কে কী কোনো ফাটল ধরেছে? কয়েকদিন আগে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি রাশিয়া সফর করলেন, যার বিপরীতে আপনি শীঘ্রই মিলান সফর করবেন। দুই নেতার এই সফর কী দুই দেশের সম্পর্কের সেই ক্ষত সেলাই করার প্রচেষ্টা? যদি তাই হয়, তাহলে সেটাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ভ্লাদিমির পুতিন: প্রথমত আমি মনে করি, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় উইনিয়নের সম্পর্কের টানাপোড়নের জন্য রাশিয়া মোটেও দায়ী নয়। এটা আমাদের কোনো পছন্দ নয়, আমাদের শরিকরাই এটা আমাদের জন্য ধার্য করেছে। আমরা মোটেও বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিনি। বরং আমরাই এই নিষেধাজ্ঞার এখন ভিকটিম, আর আমরা এটা যৌক্তিকভাবেই প্রতিরোধের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
কিন্তু রাশিয়া ও ইতালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখনো শক্তিশালী এবং সোহার্দপূর্ণ। বরং সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আগের চেয়ে অন্তত ৪.২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। যা এখন প্রায় ৪৮ বা ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাশিয়ায় প্রায় ৪০০ ইতালীয় কোম্পানি কাজ করে। সবচেয়ে বেশি আমাদের সহোযগিতা এনার্জি সেক্টরে। ইতালি আমাদের এনার্জি সেক্টরের তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা। এছাড়া আমাদের অনেক যৌথ টেকনোলজি প্রজেক্ট রয়েছে। যার মধ্যে স্পেস ও এয়ারক্রাফট সেক্টর প্রধান। ইতালির সঙ্গে আমরা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি। রাশিয়ার এক মিলিয়ন টুরিস্টদের মধ্যে অন্তত ৯ লাখ টুরিস্ট ইতালি ভ্রমণ করছে। সেখানে তারা প্রায় এক বিলিয়ন ইউরো খরচ করছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আমরা পরস্পর বিশ্বস্ত বন্ধু। সিলভিও বারলুসকেনি যখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী তখন ইতালির উদ্যোগে ও আগ্রহেই রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো কাউন্সিলের একটি সম্পর্ক গঠিত হয়েছে। এই উপদেষ্টা পর্ষদ নিশ্চয়ই ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান ফ্যাক্টর। আমাদের সাংস্কৃতিক ও মানবিক সহায়তা উল্লেখ না করেও বলা যায়, ইতালি রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এবং ন্যাটোর সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রধান মিত্রের কাজ করছে।
এসব বিবেচনায় আমরা উভয় দেশই একটি বন্ধত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক ধরে রেখেছি। আর রাশিয়া সফরের সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রীও সেই সুসস্পর্ক ধরে রাখার কথা ও উভয় দেশের মধ্যে আরো শক্তিশালী সম্পর্ক গঠনের কথা জোর দিয়ে বলেছেন। আর রাশিয়ার সরকার বা জনগণ ইতালির সঙ্গে সেই সম্পর্ক ধরে রাখবে এটাই স্বাভাবিক। আর অবশ্যই আমরা ইতালির সঙ্গে এই সম্পর্ক আরো জোরালো করে যতদিন সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করব। আমি মনে করি, আমার মিলান সফরের সময় এটা আরো জোরদার হবে।
লুসিয়ানো ফোনতানা: ইতালির মন্ত্রী পর্ষদের চেয়ারম্যানদের অনেককেই আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। রোমানো প্রোদি, সিলভিও বারলুসকোনি, মাস্সিমো ডে'আলেমা, গুইলিয়ানো আমাতো, এনরিকো লেত্তা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি। এদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো? ব্যক্তি পর্যায়ের এই সম্পর্ক বা মতামত আপনার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কতোটা প্রভাবে ফেলে বলে আপনি মনে করেন? যেমনটা আমরা দেখেছি সিলভিও বারলুসকোনি আর আপনার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে?
ভ্লাদিমির পুতিন: আমরা কি কাজ করি বা কে কী পদবি বহন করি, সেটা মোটেও কোনো ঘটনা নয়, আমরা এখনো মানুষ আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আস্থা যে কোনো কাজে, তা রাষ্ট্রীয় হলেও তো কিছু প্রভাব রাখবেই। আপনি যাঁদের নাম বললেন, তাঁদের মধ্যে কেউ একজন একবার আমাকে বলেছিলেন, আপনি-ই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে বারলুসকোনি আর প্রোদি দু'জনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক। আপনাকে আমি বলতে পারি, এটা আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। আর আমি মনে করি, এটা এখনো বজায় রাখা কঠিন কিছু না। আমি বরং বিশ্বাস করি, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সেটা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যেটাই হোক না কেন, তাঁরা সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে চাইবে। আর আমরা সেটা ভালোমত বুঝি ও অনুভব করি।
আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমি সবসময় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাইরে উভয় দেশের সুসম্পর্কের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। আমি সুস্পষ্ট করেই বলতে চাই, রাশিয়ার জনগণ বা সরকার ইতালিতে কোন দল ক্ষমতায় সেই বিবেচনায় বন্ধুত্ব করে না, বরং ইতালির সঙ্গে স্বাভাবিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় বিশ্বাসী।
লুসিয়ানো ফোনতানা: মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ইউনিভার্সাল এক্সিভিশান এক্সপো ২০১৫-এর রাশিয়া দিবসে আপনি মিলান যাচ্ছেন। এবারের এই এক্সিভিশানের মূল থিম হলো “Feeding the Planet, Energy for Life.” এখানে রাশিয়ার অবদানের কথা যদি একটু খুলে বলতেন? আর উভয় দেশের সম্পর্ক সেখানে কতোটা তাৎপর্যপূর্ণ?
ভ্লাদিমির পুতিন: পৃথিবীর মানুষের জন্য এটা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইতালির আয়োজকদের এরকম একটি বিষয়কে থিম করার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আগামী ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯ বিলিয়ন। যা এখন ৮৫০ মিলিয়ন, আর এদের মধ্যে অন্তত ১০০ মিলিয়ন হলো শিশু, যারা পুষ্টি ও খাদ্যের অভাবে ভুগছে। আমাদের এই সময়ে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অন্যান্য অনেক ইস্যু আছে যা এখনো পৃথিবীতে অমিমাংসিত। অনেক এলাকায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আছে, জঙ্গী তৎপরতা আছে। আমি মনে করি, এসব বিষয়গুলো একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে ইতালি ও ইউরোপে এই যে অবৈধ অভিভাসনের স্রোত, এটা এসব সমস্যা ও ঘটনা থেকেই উদ্ভুত। আমি আবারো বলতে চাই, আয়োজকরা খুবই সময়োচিত একটি থিম এবার বেছে নিয়েছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাশিয়া এখানে অন্তত ২০০ মিলিয়ন ডলার কন্ট্রিবুশান দিচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশ বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সরাসরি রাশিয়ার সেই রিসোর্স কাজে লাগাচ্ছে। আমরা নিজেদের দেশে কৃষির উপর খুব গুরুত্ব দিয়েছি। রাশিয়ার অর্থনীতি যে সমস্যা মোকাবেলা করছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা কৃষিকে টার্গেট করেছি। গত বছর আমরা কৃষিতে অন্তত ৩.৪ বা ৩.৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি বছর প্রথম চার মাসে আমরা প্রায় ৩ ভাগের বেশি ৩.৪ ভাগ কৃষি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি। কৃষিখাত থেকে উৎপাদিত পণ্যে রাশিয়া বিশ্বে এখন তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর আমরা রেকর্ড পরিমাণ কৃষি পণ্য উপাদন করেছি, যা প্রায় ১০৫.৩ মিলিয়ন টন। তাছাড়া কৃষিখাতে আমাদের পোটেনশিয়াল ভূমিকা সবসময়। আমি মনে করি, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চাষযোগ্য জমি আমাদের আছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ খাবার পানির রিজার্ভও আমাদের। তাছাড়া ভৌগলিকভাবেও রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ।
লুসিয়ানো ফোনতানা: মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমরা যখন আমাদের ছায়া সম্পর্কগুলোর কথা আলাপ করছিলাম, তখন আপনি বলেছিলেন যে, ইউরোপ রাশিয়ার সঙ্গে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যেমন একজন মহিলা তার প্রেমিকের সঙ্গে করে। সেই সম্পর্কটায় বর্তমানে কোন ধরনের সমস্যা রয়েছে বা কী পর্যায়ে রয়েছে? আপনি কী মনে করেন ইউক্রেন সমস্যায় ইউরোপ অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল? ইউরোপ থেকে আপনি আসলে কেমন আচরণ আশা করেছিলেন? আমি আসলে একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলাম!
ভ্লাদিমির পুতিন: আপনি আসলে ইতালীয় ঢঙ্গে একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন (হা হা হা...)। একজন মহিলার ক্ষেত্রে সম্পর্কের বেলায় আপনি যদি মনে করেন, তার বিরুদ্ধে আপনার কোনো অভিযোগ নেই, তাহলে আপনার পার্টনারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা বা নালিশ করারও আপনার কোনো অধিকার নেই।
আমরা কখনো মনে করি না ইউরোপ আমাদের সেই রকম কোনো মিসট্রেস। আমি এ ব্যাপারে এখন খুব সিরিয়াস। আমরা সবসময় সিরিয়াস সম্পর্ক গঠনের প্রস্তাব করেছি। কিন্তু আমার এখন যেটা মনে হয় যে, ইউরোপ সবসময় বস্তুগত সম্পর্ক গঠনে আগ্রহী। আর সেখানে তারা কেবল নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। যেখানে আত্মিক সম্পর্কের একটা ঘাটতি রয়েছে। আপনি দেখেছেন, বিদ্যমান চুক্তিগুলোর থার্ড এনার্জি প্যাকেজে তারা আমাদের সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করেছে। আমাদের নিউক্লিয়ার প্রোডাক্টগুলোর ইউরোপের বাজার ধরার ক্ষেত্রেও তারা অনুৎসাহী। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কগুলো তারা খুব বাজেভাবে দেখছে। আর খুব অপ্রাঙ্গিকভাবে সেখানে তারা নাক গলাচ্ছে। বিশেষ করে আমি বলতে চাই, আমাদের কাস্টমস ইউনিয়ন বা ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন গঠনে আমরা যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সেখানে তারা খুব বিদঘুটে বাকোয়াজ করছে।
এটা ঠিক যে এটা যদি ইউরোপের সঙ্গে ঘটত, তাহলে তাদের কথাবলার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমরা যখন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলায় এই চেষ্টা চালাচ্ছি, সেখানে তারা নিজের নাক কেটে হলেও আমাদের যাত্রা ভঙ্গ করার চেষ্টা করছে। আর তারা বলতে চাইছে যে, রাশিয়া এখানে সম্রাটের ভূমিকায় লিপ্ত হয়েছে। আমি বুঝি না তাদের এধরনের আচরণের মানে কী!
আপনি দেখেছেন, আমি সবসময়ই দীর্ঘ দিনের জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোন গঠন করার কথা বলেছি। আমি চাই লিসবন থেকে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত সেই মুক্ত অর্থনৈতিক এলাকা বিস্তৃত হোক। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গুইল্লে ঠিক একই কথাই বলেছিলেন, যা অনেকটা আমার ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। কেউ এটা নিয়ে কোনো বিরোধিতা করছে না। সবাই বলছে এটা খুব দরকার।
কিন্তু বাস্তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কী ঘটছে? যেমন বাল্টিক দেশগুলো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে। বেশ ভালো কথা, সমস্যা নাই। এজন্য আমরা বলছি, ওকে, তাহলে অন্তত প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার যে দেশগুলো ছিল, অন্তত তাদের এনার্জি সেক্টরের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এনার্জি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার। যেগুলো আগে আমাদের এনার্জি সেক্টরের অংশ ছিল। আমরা জিজ্ঞেস করেছি, এনার্জি যোগানে কী কোনো সমস্যা আছে? এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? তারা জবাবে বলেছে, না, কোনো সমস্যা নেই। আমরাও চেয়েছি এভাবে একটা সম্পর্ক হোক।
এটার বিপরীতে আমাদের কী করতে হয়েছে? আমাদের এনার্জি সেক্টরে বিশেষ করে রাশিয়ার পশ্চিমাংশে আরো ক্যাপাসিটি বাড়াতে হয়েছে। আমরা চাই, রাশিয়া থেকে সরাসরি বাল্টিক দেশগুলোতে ইলেকট্রিসিটি যাক। এমন কি তা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও যাক। আমরা ইলেকট্রিসিটি যোগানের গ্যারান্টিসহ নিশ্চয়তা দিতে চাই। যার খরচ পড়বে অন্তত ২২.৫ বিলিয়ন ইউরো।
এবার আপনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান আর ইউক্রেনের সহযোগিতা চুক্তিটি খেয়াল করুন। ইউক্রেন মোটেও ইউরোপের এনার্জি সিস্টেমের অংশ নয়। কিন্তু তারা এই চুক্তির আওতায় এটাকে ইউরোপের অংশ করতে আগ্রহী। এটা যদি হয়, তাহলে আমরা হয়তো ২২.৫ বিলিয়ন ইউরো খরচ করার সুযোগ পাব না। সেক্ষেত্রে আমরা ৮১০ বিলিয়ন ইউরো একই উদ্দেশ্যে পাল্টা খরচ করতে এখনো প্রস্তুত। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন আমরা লিসবন থেকে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত কমোন অর্থনৈতিক জোন গঠন করতে চাই? আর আদৌ এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা? ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইস্টার্ন পার্টনারশিপের আসল লক্ষ্য তাহলে কী? এটা কী প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্ট দেশগুলোকে ইউরোপে একটিমাত্র দেশ বানানোর চক্রান্ত? আমি তৃতীয়বার আবারো বলছি, লিসবন থেকে ভ্লাদিভস্টক, এটা কী নতুন কোনো সীমানা বানানোর চক্রান্ত যেখানে ইউক্রেন বা মালদোভাও থাকবে?
এবার এই প্রসঙ্গে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। তারপর আপনি ঠিক করবেন, সেই কথাগুলোর কতটুকু ছাপাবেন আর কতটুকু ফেলে দেবেন।
ইউক্রেন সমস্যার মূলে আসলে কী কী? দক্ষিণ ইউক্রেনে যারা বসবাস করছে, যা এখন একটি ট্রাজেডি, তারা বলছে সম্পদের সমান বণ্টন হতে হবে। সমস্যার সূত্রপাত তাদের এই দাবি থেকেই। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ বলেছিলেন যে, তাঁকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের সহযোগিতা চুক্তির আগে কিছু বিষয়ে আরো ভাবতে হবে, যা রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। কারণ রাশিয়া হলো আমাদের প্রধান বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক পার্টনার। এই ঘোষণার পরেই কিয়েভে দাঙ্গার সূচনা হলো। যারা আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার সমর্থক। তারপর সেখানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটল। ক্ষমতায় বসা নতুন সরকার ঘোষণা করল যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেন সহযোগিতা চুক্তি সাক্ষর করবে, কিন্তু তা কার্যকর করা হবে ১ জানুয়ারি ২০১৬ সালে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে সেখানে ক্ষমতার পালাবদলটি কেন ঘটল? তাদের কেন এটা বাস্তবায়নের জন্য একটি গৃহযুদ্ধকে আমদানি করতে হলো? অথচ ফলাফল কিন্তু এখনো আগের মতই আছে।
২০১৩ সালের শেষের দিকে ইউক্রেনকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সরকারি সহযোগিতা দেবার কথা ছিল আমাদের। এমন কি পরে আরো ৫ বিলিয়ন ব্যাংক লোন দেবার কথাও ছিল। তাছাড়া আমরা তাদের অন্তত ৩ বিলিয়ন ডলার তখন দিয়েছিলাম আর আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, যদি তারা নিয়মিত মূল্য পরিশোধ করে, তাহলে আমরা গ্যাসের দাম অর্ধেক করব। আর আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ইউক্রেনের সহযোগিতা চুক্তির মোটেও বিরোধী নই। তবে হ্যাঁ আমরা ইউক্রেনের ফাইনাল সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তাছাড়া এখনো সিআইএস মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের আমরা উভয় দেশই সদস্য আর আমাদের যে কারণে কিছু কমোন অবলিগেশান রয়েছে।
আমাদের সেই কমোন বিষয়কে একদম পাত্তা না দিয়ে এটা কীভাবে সম্ভব যে, তারা চুক্তিও করবে আবার আমাদের প্রতি বৃদ্দাঙ্গুলিও দেখাবে? আমি সত্যি এটা একদম বুঝতে পারি না। সুতরাং এটাই নিয়তি যে, সেখানে ক্ষমতার পালাবদলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা হয়তো সক্রিয় থাকব। যেখানে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অনেকে উদ্বান্তু হয়েছে। সেখানকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। আর আইএমএফ সেখানে চার বছর মেয়াদী ১৭.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করেছে, যেখানে প্রধান শর্ত হলো রাশিয়ার সঙ্গে সবধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। কিন্তু আমরা জানি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটা আরেকটার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান ইউক্রেনের উপর থেকে কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ইউরোপে ইউক্রেনের বাজার কিন্তু একদম বাড়েনি। কেন বাড়েনি? কারণ সেখানে তাদের বিক্রি করার আসলে কিছুই নেই। ইউরোপের বাজারে ইউক্রেনের কোনো জিনিসের সত্যি কোনো বাজার নেই। এমন কি আগে তারা যে পণ্য সেখানে বিক্রি করতো, এখন সেই কোয়ালিটি প্রোডাক্ট বা দাম কোনোটাই তারা ধরে রাখতে পারছে না।
ইউক্রেনে আমাদের অনেক পণ্যের বাজার আছে। উভয় দেশের মিচ্যুয়াল সমঝোতায় আমাদের সেখানে অনেক পণ্য যেত। যেমন আমরা হেলিকপ্টারের সবধরনের কমব্যাট ইঞ্জিন সেখানে থেকে আমদানি করতাম। যার যোগান এখন বন্ধ রয়েছে। সেন্ট পিটাসবার্গে আমরা এজন্য একটি প্লান্ট শুরু করেছিলাম। আর এ বছরে আরেকটি প্লান্ট শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু ইঞ্জিন প্রোডাকশন সেখানে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানি এখন আর তা নিচ্ছে না। ভবিষ্যতেও কোনোদিন নেবে না। বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট না করে ইউক্রেন এই প্রোডাকশান চালিয়ে যেতে পারবে না। যা এখন তাদের জন্য অসম্ভব।
আমি জানি না কেন তারা এভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারল? এমন কি আমি আমাদের ইউরোপিয়ান মিত্রদের ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও এটা নিয়ে আমি কথা বলেছি।
লুসিয়ানো ফোনতানা: জবাবে তাঁরা কী বলেছেন?
ভ্লাদিমির পুতিন: পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আপনি জানেন, আপনার এবং আপনার পত্রিকার পাঠকদের জন্য আমার একটা কথাই বলার আছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিচ ও বিরোধীদলের নেতা একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন। সেই চুক্তিতে কিভাবে সেখানে শান্তি ফিরে আসবে, কিভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্বাভাবিক হবে এবং কিভাবে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই একটি জাতীয় নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। তাঁদের সেই সমঝোতা চুক্তিটি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত ছিল। যেখানে সেই চুক্তিতে তিনজন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যারান্টর হিসেবেও সাক্ষর করেছিলেন।
তাঁরা যদি সেই সমঝোতা চুক্তি মেনে চলত আর ইউরোপীয় সেই মিত্ররা যদি তাঁদের সহযোগিতা করত, যেখানে কার্যত তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। বরং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসিডর আর সিআইএ'র এজেন্টদের একটা আলাদা ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করেছি। তাঁরা (ইউরোপীয় মিত্র) যদি তখন বলত, আমরা রাজনৈতিক সমঝোতা করার জন্য ক্ষমতার কোনো ধরনের পালাবদল চাই না, বরং তোমরা আগে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কর, নইলে আমরা তোমাদের কোনো সমর্থন দেব না।
একই কথা আমাদের আমেরিকান মিত্ররাও বলতে পারতেন। কিন্তু সেখানে তাঁরাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। কিন্তু আশ্চার্যের ব্যাপার হলো, আমেরিকা বা ইউরোপীয় মিত্ররা যেখানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল মেনে নিলেন। বরং তাঁরা যদি বলতেন, যে আগে তোমরা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কর। কারণ সবাই জানতেন সেখানে তাঁদের একশোভাগ নির্বাচনে বিজয়ী হবার মত পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু তাঁরা সেখানে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পথে অগ্রসর হলেন।
সুতরাং আমি মনে করি, এটা তাঁদের চাপিয়ে দেওয়া একটি অগণতান্ত্রিক ঘটনা, যেখান থেকেই তাঁদের সমস্যার সূত্রপাত। আর যা ইউক্রেন প্রোফেশনালি কার্যকর করতে পারেনি। আর যে পদ্ধতি ব্যবহার করে এটা করা হয়েছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা মোটেও আমাদের ইচ্ছায় ঘটেনি। এমন কি আমরা এটা চাইওনি। বরং সেখানে একটা গৃহযুদ্ধ লাগানোর জন্য বাইরের এসব চাপ অনেক বেশি দায়ী।
আমি দুঃখিত যে, কথাগুলো সরাসরি আমাকে বলতে হচ্ছে। আমি আসলে বলতে চাই যে, আমরা মোটেও এই অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেখানে ক্ষমতার পালাবদল চাইনি। সেটা কোনো পয়েন্ট নয়। আসল পয়েন্ট হলো, সমস্যাটির একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপূর্ণ সমাধান আমাদেরও প্রত্যাশা ছিল। অথচ ঘটনা সেখানে ঠিক তার উল্টো ঘটল যে, একদল আরেকদলের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচারণ করে পরস্পর মারামারি আর গৃহযুদ্ধ শুরু করল। আর যাতে চাপ ও ইন্ধন দিয়েছে আমাদের আমেরিকান ও ইউরোপীয় বন্ধুরা। ইউক্রেন ট্রেজেডির জন্য আসলে সত্যি বলতে কী এঁরাও অনেকটা দায়ী।
................................................................... চলবে.................................
১২ অক্টোবর ২০১৫
ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৩:২৩