somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ- লাশকাটা ঘর

০২ রা জুন, ২০১৭ রাত ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দূর থেকে অদ্ভুত রকমের একটা সুর আসতেছে, অদ্ভুত রকমের বাশির সুর। অনেক দূর থেকে বোধহয়। কানের কাছে হালকা অনুভূতি হচ্ছে। গেথে যাচ্ছে ধীরে ধীরে হৃদয়ের গহিনে। সিগারেট টা হাতে নিয়ে বসে পড়লাম। আগুন জ্বালানোর মত অবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে বাশির সুরে। ঠিক মনের ভেতরে ডুকে গেছে সুরটা।

বিকেলের নির্জনতা আমার খুব ভালো লাগে। আমি একা একা থাকতে পছন্দ করি এই সময়টা। বাসা থেকে দূরে গিয়ে বসে থাকি। কেউ থাকবেনা,কোন কোলাহল থাকবেনা। সময়টা অনেকটা নিজেকে উপহার দেয়ার মত।

নিজের জন্য কিছু ভাবতে ভালো লাগেনা তাই বিকেলের এই সময়টা শুধু নিজের জন্য রাখি,নিজেকে রোজ নিয়ম করে উপহার করা। আলাদা একটা অনুভূতি আছে এই উপহারে।

সিগারেট ধরানোর জন্য মন ছটফট শুরু করেছে কিন্তু পারছিনা। হালকা বাতাসে ম্যাচের কাঠি দিয়ে সিগারেট ধরানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার মাঝে কাঠি আছে মাত্র দুটো।

আজকে দিয়াশলাই টা ফেলে এসেছি বালিশের নিচে। আম্মু রুমে গেলে হয়ত পেয়ে যাবে। আমি বাসা থেকে বের হলেই আম্মুর উপস্থিতি আমার রুমে,উদ্দেশ্য এলোমেলো রুমটা একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়া। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুটো ম্যাচের কাঠিও নষ্ট করে ফেলেছি। ধুর ছাই সিগারেট টা খাবোনা। ইচ্ছে করতেছেনা একটু হেটে টং থেকে ধরিয়ে নিয়ে আসতে।

বসে আছি কোলাহল শূন্য একটা জায়গায়,যেখানে একটা নতুন বিল্ডিং হচ্ছে। সম্ভবত সাত তলার মত উঠবে। মালিকের অনেক টাকা পয়সা বুঝা যায়। প্রতিদিন গাড়ি করে আসে,চোখে একটা সাদা-কালো ফ্রেমের চশমা পড়া। গায়ের রঙ শ্যামলা না,তবে কালো বলা চলে। লোকটার নাম হাবিব। সেখানকার সবাই তাকে হাবিব সাহেব হিসেবে চিনে। পড়ালেখা খুব করতে পারেনি। বড়জোর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। বিদেশ থেকে ফিরেই বিশাল কাজ কারবার। হাবিব সাহেবের স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। পড়ালেখায় যেমন দেখতেও অমায়িক সুন্দরী। হাবিব সাহেবের কপাল ভালো। বেশি পড়ালেখা না করেও শিক্ষিত বউ পেলো আর টাকা পয়সাও অঢেল কামালো।

মানুষ অন্যার টাকা পয়সা দেখতে পারেনা। কোটি টাকার মালিকদের নিয়ে সমালোচনা বেশি করে। ব্যাটা এত টাকা কামালো কিভাবে? দুই নাম্বারি করেই কামাইছে নিশ্চয় ইত্যাদি ইত্যাদি। হাবিব সাহেব কে নিয়েও এমন সমালোচনা হয়। এ সমালোচনা থেকে মুক্তি পায়নি তার সুন্দরী উচ্চশিক্ষিতা স্ত্রী ও। হাবিব এত কাইল্ল্যা হয়ে এত সুন্দরী বউ কিভাবে পেল? তাও আবার শিক্ষিতা? ইত্যাদি ইত্যাদি

আমি তার বিল্ডিং এর পাশেই প্রায় সময় বসে থাকি। সেখানটায় এখনো কোন বসতি গড়ে উঠেনি। একটা মাত্র বিল্ডিং নির্মান হচ্ছে তা হাবিব সাহেবের। দূরে রয়েছে একটা স্কুল,সেখানে একজন লোক রোজ বিকেলে বাঁশির সুর তোলে। আমি এখান থেকে শুনতে পাই। লোকটাকে চিনিনা আমি।

সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে যাবো লোকটার কাছে। বাঁশির সুর কাছ থেকে শুনব। কথা বলব তার সাথে। টং থেকে পাঁচটা সিগারেট একটা ম্যাচ বাক্স কিনে হাটা ধরলাম। হাটতে হাটতে হাতে থাকা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম...

লোকটার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম,কোন কথা বললাম না। ঠিক তার পেছনে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই। লোকটা যখন পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখল তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মনে হয়। দ্রুত চোখে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। আমি বুঝতে পারলাম না তার চোখে পানি আসার কারণটা। জিজ্ঞেস করলামঃ-

- চাচা কেমন আছেন?

-এইতো ভালো আছি,তোমাকে তো চিনলাম না ঠিক?

-আমিও আপনাকে চিনিনা,তবে আমি প্রায়সময় আপনার বাঁশির সুর শুনতে পাই। আমার ভালো লাগে।

-কোথায় থাকো তুমি?

-এইতো পাশেই। আপনি কোথায় থাকেন?

-থাকি এখানেই,এই স্কুলের বারান্দায় কোন রকমে কেটে যায়।

-আপনি দারুণ বাঁশির সুর তুলতে পারেন।

-হা হা হা ধন্যবাদ।

লোকটার সাথে আরো অনেক কথা হল,শোনা হল তার অদ্ভুত বাঁশির সুর। লোকটার নাম জানা হলনা,তার চোখে জল আসার কারণ টা ও জানা হলনা। হুট করে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে বসতে আমার কেমন জানি লাগে। জানা যাবে সময় তো আছে। লোকটা যেহেতু স্কুলের বারান্দায় থাকে তাহলে জানা যাবে।

পরেরদিন সকাল সকাল গেলাম লোকটার সাথে দেখা করতে,সারারাত লোকটার কথাই মনে হয়েছিলো। অদ্ভুত সুর আর চোখের জলের কারণ খুঁজতে সকাল সকাল তার সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

নাহ দেখা হলনা!!!
স্কুলের আশেপাশে অনেক খুঁজেছি তাও পেলাম না। ঘুরেফিরে স্কুলের সামনে আসলাম।

খেলনা বিক্রেতা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে হরেক রকমের খেলনা বিক্রি করতেছে। লোভ লেগে গেলো। বাশির সুরের মত লোভ। ইচ্ছে করতেছে কয়েকটা খেলনা কিনে বসে পড়ি মাটিতে। বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। বাধা পড়ল। ইচ্ছে মেটাতে গেলে স্কুলের বাচ্ছাগুলোর মুখে পাগল উপাধি পেতে হবে।

অপলক তাকিয়ে থাকলাম খেলনা বিক্রেতার দিকে। কি সুন্দর করে বাচ্ছাগুলোকে কে আকর্ষণ করতেছে। বাচ্ছাগুলো ছুটে যাচ্ছে তার কাছে। খেলনা কিনে আনন্দে ছুটোছুটি করতেছে। এ দৃশ্য কখনো ভোলার মত না।

পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে যা কখনো ভোলার মত না। প্রেমিকার চোখের কাজল,কপালে কালো টিপ,পরনে নীল শাড়ি তে প্রেমিকা কে কাছ থেকে দেখার দৃশ্য ও কখনো ভোলার মত না।

কি সুন্দর খেলনা বিক্রেতার জীবন টা। সব খেলনা বিক্রি করে তবুও হয়ত সে ঘরে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভাবতেই অবাক লাগে,যে মানুষটা এত্তগুলো বাচ্ছাকে খুশি করতে পারে সে কিভাবে কান্না করতে পারে? সারাবেলার সুখী মানুষটাও ঘরে ফিরে অসুখী কি করে হতে পারে?

ব্যাটা একটা বিয়ে করছে,কিন্তু বউ ছেড়ে চলে গেছে অন্য ব্যাটার সাথে। সারাদিন মানুষ খুশি রেখে সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরেই অসুখী হয়ে যায়। এটা বোধহয় জগতের নিয়ম।

এতটুকু কথা বলে অনেককিছু জেনে ফেললাম। বড্ড বেশি অবাক হয়েছি,এর আগে আমি কখনো মানুষ কে জানতে চাইনি এভাবে। আজ বাঁশিওয়ালার খোঁজে অনেক কিছুই পেয়েছি। বিকেলে আবার আসবো সুরের টানে,এখনের মত ফিরে আসার পথ ধরেছি।

দরজায় টোকা দিলাম,আম্মু রাগান্বিত স্বরে চেচিয়ে বলে উঠলো, সারাদিন কোথায় থাকিস? বাড়িতে যে আমরা আছি সে খেয়াল কি আছে তোর? আর ভালো কথা ইদানীং তো ভালোই অভ্যস শুরু করেছিস! কয় প্যাকেট সিগারেট লাগে দিনে? পেকে গেছিস? এসব একদম ঠিক হচ্ছেনা কিন্তু একদম না। তোর বাবা ফোন করলে হল,তার কাছে নালিশ দিবো " তোমার ছেলের কয়েক প্যাকেট সিগারেট লাগে দিনে "। মায়েদের এই একটা সমস্যা ছেলে দোষ করলে তখন বাপের ছেলে হয়ে যায় আর ছেলে ভালো কিছু করলে ছেলে মায়ের হয়ে যায়।

আম্মুর সাথে কথা না বলাই ভালো হবে,যতক্ষন কথা বলব ততক্ষন চেঁচাবে। সোজা নিজের রুমে গিয়ে উঠলাম। দরজা লাগিয়ে আয়েশ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। জানালায় চোখ গেলো,সেখানটায় একটা খয়েরী রঙের কাগজ পড়ে আছে। বুঝতে বাকি রইলোনা এটা এ্যনিলা রেখেছে। এ্যনিলা পাশের বিল্ডিং এ থাকে চার তলায়,দেখতে সুন্দরী।

এ্যনিলার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক কলেজ থেকেই শুরু। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম " আচ্ছা তুমি কি কখনো খয়েরী রঙ ছাড়া বাকি রঙ পছন্দ করেছো? সে জানালো,তার কাছে রঙ মানে হল খয়েরী। অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষ রঙ দিয়েও হাজার অনুভূতি জড় করে ফেলে।

মেয়েটা রোজ দুপুরে গোসলে যাওয়ার আগে একটা করে কাগজ আমার জানালার ধারে ছুড়ে দেয়,অবশ্য তার কাগজ পাওয়ার জন্য আমি জানালার গ্লাস খোলা রাখি। আমি জানি ও হয়ত ছুড়ে মারেনা,কোন কিছুতে আটকিয়ে জানালায় রাখে। কখনো কখনো কাগজে কিছু লেখা থাকে কখনো শূন্য থাকে। কখনো প্রিয় লিখে মাঝের সব খালি রেখে শেষে ইতি টেনে এ্যনিলা লিখে। আমি জানি এটাতে এক ধরনের সুখ আছে।

একটা জিনিস মানুষ প্রতিদিন প্রতিবার সাজিয়ে গুছিয়ে করতে পারেনা। তা বলে কি সে কাজটা করবেনা? করবে,কিন্তু ভিন্ন উপায়ে।

কাগজ টা না রেখেই গোসল করতে ডুকে গেলাম। আম্মুর চেঁচামেচি সহ্য হচ্ছেনা,তাই যত দ্রুত সম্ভব গোসল সেরে খাওয়াদাওয়া করতে হবে।

খাবার পর্ব শেষ করে সিগারেট টানতে ছাদে উঠা মাত্রই মনে হল এ্যনিলার দেয়া কাগজের কথা। অনেকদিন ধরে শূন্য কাগজ দিচ্ছে,ভাবলাম আজকে হয়ত কিছু লিখেছে। যদিও আমাদের মাঝে ফোনে কথা হয় তবুও কাগজের ব্যাপারটা অন্যরকম। সিগারেট এ কয়েকটান দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কাগজটা খুলে দেখি আবারো শূন্য!! ইদানীং মেয়েটা পাগলামি একটু বেশি শুরু করেছে।

আসরের আজান পড়ে গেলো,

বাঁশিওয়ালা লোকটার খোজ করতে হবে। জামা-প্যান্ট পরে বের হলাম। কোথাও আজকে বসব না। সোজা স্কুলের বারান্দায় গিয়ে উঠবো। কয়েকটা সিগারেট আর ম্যাচবক্স কিনে রওনা হলাম। আম্মুর জ্বালায় দিয়াশলাই আর কেনা যাবেনা।

- চাচা ভালো আছেন?

- এইতো আছি,তুমি না ঐদিন?

- হ্যা আমিই এসেছিলাম। কি অবস্থা আপনার?

- চলছে,বসো এখানে তাড়া না থাকলে!

- নাহ, ভবঘুরে মানুষগুলোর তাড়া আছে কিনা আমার জানা নেই,এরা হুট করে নিজেকে ব্যস্ত বানিয়ে রাখতে পছন্দ করে। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি,আড্ডা দিব।

- হা হা হা,তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারো।

- নাম কি আপনার?

- রফিক,মোহাম্মদ রফিক।

রফিক চাচার সাথে অনেক্ষন কথা হল। রফিক চাচার সেদিনের কান্নার কথা জানতে চাইলে তিনি কোন রকম ইতস্ততা ছাড়াই গড়গড় করে বলেই যাচ্ছিলো তার জীবন কাহিনীঃ-

ছোটবেলা থেকে গায়ের স্কুল,নদীতে সাতার,পাখির বাসা ভাঙা,ঝড়বৃষ্টি তে আম কুড়িয়ে কেটে গিয়েছিলো প্রায় সতেরোটি বছর। বাবার হাত ধরেই শহরে আসা হল,বাবা একটা বাড়ির দারোয়ান ছিল,আমি বাসায় থাকতাম।

একুশ বছরে পা দেয়ার পর কোন এক মাসের দিকে গ্রাম থেকে মা আর দুই ছোট বোন এসেছিলো আমাদের কাছে বেড়াতে। এক সপ্তাহ পর সে মাসের বারো তারিখে গ্রামে ফেরার পথে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মা বাবা ছোট দুই বোন মারা যায়। আমি তখন ও জানতাম না,প্রায় দুই সপ্তাহ পর যখন বাসা ভাড়া না দেয়াতে বাসা থেকে আমাকে বের করে দেয়া হল তখনই গ্রামে ফিরে গেলাম। সেখানেও বাবা মা বোনদের না পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পরে এক চাচা এসে জানালো বাবা মায়ের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর একজন নাকি বাবার পকেটের মানিব্যাগ থেকে গ্রামের ঠিকানা বের করে চাচাকে জানিয়ে গেছে তাদের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হয়েছে।

যাদের কেউ খোজ করেনা,যারা গরিব তাদের লাশ ও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন হয়ে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এমন শত শত লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়। আমি নিজেও এমন কয়েকটা বেওয়ারিশ লাশের জানাজার নামাজ পড়েছি। অদ্ভুত লাগে!!

যে লোকটা জানিয়ে গেছিলো বাবা মায়ের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় তাকে যদি পেতাম বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষন উচ্চ হাসি দিতাম। আমি খুব বেশি হাসতে পারিনা। বাবা মা ও বোনদের মৃত্যু হয়েছে তাও সড়ক দুর্ঘটনায়,যাক খবরটা তো জানতে পারলাম যে তারা আর বেঁচে নেই। এর চেয়ে দারুণ আর কি হতে পারে? এমন অনেকে তো আছে যারা এখনো কোন খোজ পায়নি। এই দিক থেকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিলো খুব।

সকল কষ্ট গুলো বুকের মাঝে মুড়িয়ে ফিরে আসলাম এখানে,একুশ থাকতেই। পকেটে কোন টাকা পয়সা নেই। এভাবেই বেশ কয়মাস কেটে যায়। মায়ের দূরসম্পর্কের এক ছোট ভাইয়ের সাথে এখানে পরিচিত ছিলো আমার। উনি লাশকাটা ঘরে চাকরি করত। উনার সাথে কথা বলে একটা চাকরীর ব্যবস্থা হল লাশকাটা ঘরে।

এভাবে লাশকাটা ঘরে লাশ কাটতে কাটতে কেটে গেলো প্রায় পঁচিশটি বছর। এর মাঝে নিজের বিয়েটাও করতে পারিনি। যে মানুষের হাতে মৃত লাশ রক্তাক্ত হয় সে মানুষের বিয়ে করা উচিৎ না। সংসার করা যেনতেন ব্যাপার না। যারা লাশ কাটে তারা স্বপ্নেও বোধহয় লাশ কাটার স্বপ্ন দেখে পার করিয়ে দেয় দীর্ঘ হওয়া রাত গুলো। রোজ রাতে নিয়ম করে স্ত্রীর ছোঁয়া নিয়ে সকালে উঠে লাশকাটা বোধহয় কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

- তো এখন কি করছেন? মানে কোন কাজ?

- কিছু করছিনা,তবে একটা খাবার হোটেলে কাজ করি শেষ রাতে,যে হোটেলে এক প্লেট ভাত দশ টাকা, ডাল ফ্রি। শেষ রাতে হোটেল পরিষ্কার করে সারাদিনের চা নাস্তা সিগারেট খরচ হলেই চলে,দুপুর বেলা হোটেলে ফ্রি তে খেতে দেয়। মন্দ না, চলে যাচ্ছে তো যাওয়ার মত করে।

আমি থেমে গেলাম,এতক্ষন ধরে উনার কথা শুনে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য রফিক বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করতেছে খুব করে। আমি কখনো কারো কথা মন দিয়ে শুনেছি কিনা জানিনা,তবে রফিক চাচার সব কথাগুলো যেন আমার হৃদপিণ্ডে টাচ করে গেছে।

চাচাকে নিয়ে একটা টং এ বসলাম। চা বিস্কুট খেলাম,সিগারেট টানলাম দুজনে। বেশ আরাম করেই খেয়ে গেলো। মনে হল এতক্ষন সে আমাকে রূপকার প্রেমের সফল গল্প শুনিয়েছে,যে গল্পে কোন দুঃখ নেই।

মানুষ কষ্ট পেতে পেতে সহ্য করার ক্ষমতা দখল করে নেয়। কেউ পারে কেউ হাল ছেড়ে দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়ে।

রফিক চাচা এই স্কুলের বারান্দায় রোজ নিয়ম করে বাঁশির সুর তুলে আর চোখের জল ছেড়ে নিজেকে পরেরদিনের জন্য প্রস্তুত করে। যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুতি নেয়া ভালো, এতে সাকসেস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও আজ পর্যন্ত কোন রকম কোন কাজের জন্য প্রস্তুতি নিইনি আমি তাই বোধহয় এখনো ভবঘুরে হয়ে ছুটতে থাকি।

চাচাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম কতক্ষণ ঠিক জানিনা,তবে ছাড়তে মন চায়নি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত প্রায় নয়টা বেজে গেলো। বাসায় পৌছোতে অর্ধেক রাস্তায় বৃষ্টি ছুঁয়ে গেলো আমাকে। সাধারণত বৃষ্টি আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু আজকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগতেছে। পুরো পথ বৃষ্টিতে ভিজেই এসেছি।

দরজায় দাঁড়িয়ে আম্মুর কাছ থেকে গামছা দিয়ে কোন রকমে ভেজা শরীর মুছে রুমে গেলাম। জানালায় আরো একটা খয়েরী কাগজ জমা। নাহ আজকে নিশ্চয় এ্যনিলা কিছু লিখেছে। না হয় এই সময়ে জানালায় কাগজ থাকার কথা না। তড়িঘড়ি করে কাগজ খুলে পড়তে শুরু করলামঃ-

" আমি জানি বৃষ্টি তোমার একদম পছন্দ না,কিন্তু কেন জানি মনে হল আজকে বৃষ্টিতে ভিজেছো তুমি। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিও সময় হলে। আমি বৃষ্টির সময় সাতবার আয়নার সামনে গিয়েছি আর যতবার দাঁড়িয়েছি ততবারই নিজের বদলে তোমাকে দেখেছি। আমার সাথে এর আগে এমন কখনো হয়নি। যাই হোক হঠাৎ করে বৃষ্টিতে ভিজেছো অসুখ হতে পারে মেডিসিন রেখো সাথে। খাওয়াদাওয়া করে একটা ঘুম দাও,শান্তির ঘুম। যে ঘুমের স্বপ্নে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব আর রূপকার গল্প শোনাবো।

হো হো করে হেসে ফেললাম। মেয়েটা এমন কেন? কিভাবে বুঝতে পারে আমাকে? কোথায় যাই কি করি তা যেন কিভাবে সে টের পেয়ে যায়। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমালে মানুষ লাশ হয়ে যায়। আমি ও লাশ হয়ে গেলাম,এ্যনিলা আসবে একটুপর,মাথায় হাত বুলাবে আর রূপকার গল্প শোনাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:২৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×