(লেখাটার মূল বিষয়বস্তু পুরনো।বিশেষ এক মানুষকে উৎসর্গ করে লেখা হয়েছিলো।মানুষটা চলে গেছে।আমার মস্তিষ্কে কিছু সুন্দর স্মৃতিই শুধু রেখে গেছে। )
ধানমন্ডি ১৩/২ রোডে একটি পুরনো গোছের দোতলা বাড়ি।বাড়ির নাম রেহেনুমা কটেজ।বাড়ির নামেই শুধু রেহেনুমা রয়ে গেছে,আসল রেহেনুমা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে।রেহেনুমার একমাত্র মেয়ে নীরা।সবেমাত্র এস এস সি পাশ করে কলেজে উঠেছে।ইদানিং সে কলেজে যাচ্ছে না।কলেজ তার ভালো লাগে না।দিনের একটা সময় সে ছাদে হেটে বেড়ায়।সকালের চড়ুইগুলোর সাথে কথা বলে,দুপুরের রোদ নিজ গায়ে মাখে,সন্ধ্যার লালচে আভা দেখে মুগ্ধ হয় আবার রাতে জোছনা দেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
রেহেনুমা কটেজের সামনে আরেকটা দোতলা বাড়ি।বেশ কিছুদিন খালি থাকার পর হটাত একদিন একটি পরিবার আসে সেই বাড়িতে।নীরা ছাদ থেকে পরিবারটাকে পর্যবেক্ষণ করে।হাসিখুশি একটি পরিবার।সকাল হলে একসাথে সবাই নাস্তা করে ফেলে।গৃহকর্তা অফিসে চলে যায়,মেয়েটা কলেজে যায়,বড় ছেলেটা চশমা চোখে ভার্সিটি যায় আর মা ঘর গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পরে।বিকেলে বড় ছেলেটা হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যায়।পাশে মা আর ছোট বোন বসে গান শোনে।তারা হয়তো লক্ষ্য করে না দূর থেকে আরেকটা মেয়ে একমনে গান শোনে।
বিকেল শেষে সন্ধ্যের লালচে আভা আকাশ ঢেকে ফেলে তখনো ছেলেটার গলায় সুর থাকে আর নীরা সেই সুরে মুগ্ধ হয়।
ইদানিং নীরা দিনের পুরো সময়টাই ছাদে থাকে।বিকেলের অপেক্ষা করে,অপেক্ষা করে অযাচিত একটা কন্ঠের,দূর থেকেই চশমা পরা একটা ছেলে তাকে শাসন করে।সদ্য কলেজে ওঠা নীরা হয়তো বুঝতেই পারে না দূর থেকে শাসন করার অধিকার শুধু প্রেমিকরাই রাখে।বিকেল হয় হারমোনিয়ামে সুর ওঠে।
"বিরহের এ রাত একেলা কেঁদে হলো ভোর
হৃদয়ে মোর শান্তি নাহি কাঁদে পরান মোর॥
হে মদিনাবাসি প্রেমিক ধর হাত মম"
নীরা পাগলের মত হাত বাড়িয়ে রাখে বাড়িটার দিকে,ছেলেটা সেই হাত দেখে না।হয়তো দেখে।আমি জানি না।
যেভাবে হটাত করে বাড়িটাতে একটা পরিবার এসে উঠেছিলো সেভাবেই হটাত করে বাড়িটা একদিন খালি হয়ে যায়।বাড়ির সামনে একটি গাড়ি আসে তাতে আসবাবপত্র বোঝাই হয়।নীরা ছাদে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থাকে।নীরার বুকে ঝড় ওঠে,সেই ঝড় রেহেনুমা কটেজেই সীমাবদ্ধ।আসবাবপত্রের গাড়িটা চলে যায়।একটু পর বাড়ির অন্য সদস্যরা রিক্সায় উঠে রওনা দেয়।নীরার খুব ইচ্ছা হয় চিৎকার করে বলতে
"প্লিজ আপনারা যাবেন না।আপনারা কি জানেন বন্ধুবিহীন জীবনে আপনারাই আমার একমাত্র বন্ধু?আপনারা চলে গেলে আমি কাদের দিকে তাকিয়ে থাকবো?আচ্ছা আপনারা চলে যান কিন্তু ঐ চশমা পরা ছেলেটাকে রেখে যান।বিকেলে ওনার গান না শুনলে আমার ঘুম হবে না।প্লিজ আপনি যাবেন না।"
নীরা বলতে পারে না।শুধু নীরা না,কোন নিঃসঙ্গ মেয়েই হয়তো বলতে পারে না।
রিক্সা চলতে শুরু করে,একসময় রেহেনুমা কটেজের আড়ালে চলে যায়।ঠিক এই সময় কোন এক বাড়িতে টেপরেকর্ডার বেজে ওঠে।
"চলে যদি যাবি দূরে স্বার্থপর,আমাকে কেন জোছনা দেখালি?
হবি যদি নাও ভাসিয়ে দেশান্তর,পাথরের বুকে ফুল কেন ফোটালি?"
নীরা আজকাল কলেজে যায়,কলেজে যায় বললে ভুল হবে।কলেজ এপ্রোন পরে শহরভ্রমনে বের হয়।যেই শহরে চশমা পরা একটা ছেলে হারিয়ে গেছে।