somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাস্কর্য বিতর্ক: কয়েকটি প্রশ্ন ও কিছু ফুটনোট

২০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফাজলামোর সমস্যা

ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার, এই শিরোনাম দিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম গত পরশু বা তার আগের দিন। এই বাক্যটি দিয়ে আলোচনা শুরু করার পর, অনেকেই বললেন, ফাজলামো শব্দটার কারণে আলোচনাটার ফোকাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই আবার না বোঝার কথা বলে কমেন্টের পর কমেন্ট করে গেলেন, কী কন বুঝাইয়া দেন। কেউ আবার প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পোস্ট দিলেন, তিনি ফাজলামোটাই করতে চান। এবং তার এই ফাজলামোর স্পৃহা নিয়ে তিনি পোস্টদাতার সাথে বাতচিত করার আগ্রহ রাখেন তার পোস্টে।

এই সব প্রতিক্রিয়ার পর, আমি নিশ্চিত হতে পারলাম, যে পর্যবেক্ষণ নিয়ে আমি আমার পোস্টখানি দিয়েছিলাম, তার সত্য জায়গাটি সত্যই আছে। সেটি হল এই: শুয়োরের বাচ্চা কওমী, ফেনেটিক মোল্লা, বাচ্চা তালিবান এইসব শব্দ দিয়ে যেখানে আলোচনা শুরু এবং সারা হয়, সেই আলোচনার গন্তব্য বা পরিণতি কোনটাই শুভ তো নয়ই, আলোচনাটা বিপথগামী এবং ভয়ঙ্কর। ফাজলামোও বটে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের ফাজলামোগুলোকে কেউ ফাজলামো বলে অভিধা দিলে তার ব্যাপারে আমরা জঙ্গী হয়ে ওঠার আওয়াজ তুলি, আর আমাদের ফাজলামোগুলির ব্যাপারে শুয়োরের বাচ্চাগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে ওদেরকে জঙ্গী বলে গালি দেই।


একটি আগ্রহউদ্দীপক লাইন

একটি আগ্রহউদ্দীপক লাইন, আজকের প্রথম আলোতে পেলাম। আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির সঙ্গে, যারা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী-

চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় সচেতন শিল্পীসমাজের ব্যানারে কন্ঠশিল্পীদের প্রতিবাদী সংগীতানুষ্ঠানের প্রাক্কালে তারা এরকম উচ্চারণটি করেন।

এই ভাস্কর্য আন্দোলনের সিগনিফিকেন্ট অনুভূতিটারে আমরা নিদ্বিধভাবে স্পর্শ করতে পারলাম, এইবার বোধ হয়। সকল লুকোছাপার পরও, ওরা এই কথাটি উচ্চারণ করে ফেলেছে, যে, এটি একটি লড়াই, তাদের ভাষায়, যারা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী- তাদের সঙ্গে। এই বিবৃতিটি ভয়ঙ্কর হলেও, অভিনব ব্যাপার নয়। যাদের আফ্রিকান কালো মানুষের দাসত্বের ইতিহাস এবং আমেরিকায় রেড ইণ্ডিয়ানদের পদানত করার ইতিহাস পড়া আছে এবং এটির রাজনৈতিক পাঠ করেছেন, তাদের কাছে। সেই সময়েও এমন কথাটিই শোনা গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদিদের মুখে। ওরা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী। ওরা অসভ্য, তাই ওদের নির্মূল কর, পদানত কর, দাস কর এবং হত্যা কর। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বাক্যটি শিহরণ জাগানো, এই কারণে যে, এই প্রথম বর্ণচোরা সাম্রাজ্যবাদের গোলাম বর্ণবাদী গোষ্ঠি সরাসরি কোন রাখঢাক না করেই নিজেদের বিবৃতিতে এই আকাঙ্ক্ষার তথ্য প্রকাশ করল। এবং নতুন পরিস্থিতির ডাইনামিজম হলো, ওরা ফকির লালনকে বাউল পরিচয় দিয়ে এমনই এক পেটিবুর্জোয়া, বর্ণবাদী, ফ্যাসিস্ট লড়াইয়ের জন্য আইকন বানালো।

কয়েকটি প্রশ্ন

ভাস্কর্য আন্দোলনের কাহন জানলাম।

এখন ভাস্কর্য এবং সেই সংক্রান্ত জটিলতাটারে বোঝার চেষ্টা করি। ভাস্কর্য বনাম মূর্তি বনাম রাস্ট্র। এ যাবত ব্লগে ভাস্কর্য সংক্রান্ত বেশীরভাগ আলোচনায় উঠে এসেছে মূলত ভাস্কর্য বনাম মূর্তি এবং শুয়োরের বাচ্চা মৌলভি তত্ত্ব ও তৎসম্পর্কিত আমাদের ঘোর ও বিবমিষা। কিন্তু এর সাথে রাষ্ট্রের একটা সম্পর্কের জায়গা আছে যেইটা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। মূলত রাষ্ট্র কোন চরম বা চুড়ান্ত কনসেপ্ট না। নাগরিকের কনসেন্ট, নাগরিকের সাথে একটি অলিখিত চুক্তি, যেইটারে আমরা সোশাল কন্ট্রাক্ট বলতে পারি, সেইটাই রাষ্ট্র গঠনে আপাতত বৈধতা তৈরী করে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছুক আমি সাধারণ্যের কাছে। তারপরেই কথা শেষ করবো।

কিছুদিন আগেই দেশে উৎসবের পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দুদের দূর্গাপুজা পালিত হলো, আবার অন্যদিকে ঢাকায় বিমানবন্দরের সামনে লালনমূর্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এলো মাদ্রাসার ছাত্রদের পক্ষ থেকে। আমাদের মৌলভিগণ কোথাও কোন দুর্গাপুজার বিগ্রহ মূর্তি ভেঙেছে, এরকম কোন সংবাদ আমরা পাইনি, কিন্তু বিমানবন্দরে লালনের ভাস্কর্য তোলার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করলো। যদি মূর্তিই এই প্রতিবাদের কারণ হয়ে থাকে, তাহলেতো বিগ্রহই ভাঙার কথা, ভাস্কর্য্য কেন?

এই প্রেক্ষিতে প্রথম প্রশ্নটি দাঁড়ায়: বিমান বন্দর বা হাজ্বীক্যাম্প যাই হোক না কেন, পাবলিক স্পেসের সামনে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের প্রশ্ন রাজনৈতিক নাকি শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপার?

যদি রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে থাকে, এবং তাই হওয়া সম্ভব, একটি পাবলিক স্পেসে এই ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রাস্ট্র কি নাগরিকদের সাথে এই সংক্রান্ত রাজনৈতিক বোঝাপড়া শেষ করেছে?

যদি না করে থাকে, তাহলে কি রাস্ট্র এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, নাগরিকদের সাথে তার সোশাল কনট্রাক্ট ভঙ্গ করেছে?

ফুটনোট

ক. শিল্প সংস্কৃতি এইসবের কোনটাই ধোয়া তুলসিপাতা নয়, এসবের রাজনৈতিক পাঠ জরুরী।

খ. ষাট সত্তর দশকে ভারতের প্রভাবশালী নকশাল আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা প্রচুর ভাস্কর্য ভেঙেছে। মূর্তি নয় ভাস্কর্য, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ এলিট আইকনদের, এবং এলিট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক অবস্থান নিয়েছে।

গ. আফগানিস্তানে যখন জাতিসঙঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে অনাহারে প্রচুর শিশু মারা যাচ্ছিল, জাতিসঙঘ তখন বুদ্ধমূর্তি সঙস্কারের জন্য প্রচুর টাকা নিয়ে হাজির হলো- তালেবানরা তখন বলেছিল, আমাদের মূর্তির দরকার নেই, আমাদের শিশুদেরকে আহার দিন।

কিন্তু তারা মূর্তিকেই অগ্রাধিকার দিলো এবং তালিবানরা মূর্তিটি ভাঙলো। আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম একটা মূর্তির জন্য, তাদের শিশুগুলোর জন্য আমাদের কোন অনুভূতিই তৈরী হলো না।

তারা মরলো। বোমায় এবং ক্ষুধায়।

ঘ. এটি কোন ধর্মীয় বিষয় নয়, এটি হল আইকনকে ব্যবহার করে রাস্ট্রের ধর্ম হওনের কাঙ্ক্ষা, যেইটারে প্রতিরোধ করা সব নাগরিকের দায়িত্ব।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩৯
২২টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×