বলছি ২০১৫ সালের জানুয়ারির এক সন্ধ্যার কথা। চ্যানেল আইয়ের স্টুডিওতে বসে আছি। মায়ের একটা প্রোগ্রামের রেকর্ডিং। পৌঁছালাম ঠিক সাতটায়। এরপর বাজে আটটা বিশ। অনুষ্ঠান আর শুরু হওয়ার নাম নাই। বিয়ে বাড়ির মতো। কার্ডে লেখা থাকে সন্ধ্যা সাতটা। মানুষ হেলেদুলে আসেন নয়টার দিকে। আর খেতে দেওয়া হয় দশটার পরে।
সেদিন আমার খুব খিদে পেয়েছে। ওই মুহূর্তে যেকোনো কিছু খেতে দেওয়া হলে খুব আগ্রহ নিয়ে খেতাম। একবার মনে হলো, তাদের কোনো ক্যাফেটেরিয়া আছে কিনা জিজ্ঞেস করি। আবার ভাবলাম, লাভ নেই। মা ঝামেলা করবেন। বলবেন, ‘এ্যাই চোওওপ! কোথাও যাওয়া যাবে না।’ বয়সের কোঠা তিরিশের আশপাশে হলেও মার কাছে আমি এখনো তিন! তাই দেশে ফিরে আসার পর থেকে স্বাধীনতার খুব অভাব বোধ করছি। এক সময় আমাকে ফুলার রোড থেকে নিউমার্কেটে যেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু সেই আমাকেই ২০১০ সালের এক শীতের রাতে জার্মানির মতো একটা দূর দেশে একা একা পিএইচডি করতে ছেড়ে দেওয়া হলো। বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। সেই গেরো গলে আমি বেরিয়ে গেলাম।
দেশের অবস্থা আপাতত লে হালুয়া। অবরোধ আর হরতাল। চলছে। চলবেও। সেই সঙ্গে গাড়ি পোড়ানোর মোচ্ছব। জগাখিচুড়ি আর কাকে বলে! রাস্তায় বেরোনো মানে মারাত্মক ভয়ংকর একটা ব্যাপার তখন। ভীষণ আনন্দ আর উৎসাহের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে ঢুকেছিলাম। তখন পেট্রল বোমায় পুড়ে গ্রিল চিকেন কিংবা মাটন কাবাব হওয়ার আতঙ্কে সেই আনন্দে গুড়ে বালি। দুই মাসে ক্লাস নিতে পারলাম মাত্র চারটা। মানে প্রতি পনেরো দিনে গড়ে একটা ক্লাস। এর কোনো মানেই হয় না। চরম হতাশ লাগছে। এদিকে এসএসসি পরীক্ষার মাঝে পড়ে গেল হরতাল। প্রথমে মনে হলো, আহা ওদের কত দুঃখ! পরে চিন্তা করে দেখলাম, সবাইকে তো ফলাফলের সময়ে ঢালাওভাবে গোল্ডেন ফাইভ দেওয়া হবে। কে ভালো আর কে খারাপ করল তার কোনো মূল্যায়নই হবে না। আসলেই—‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।’
রেকর্ডিং শুরু হয়েছে অবশেষে। বিষয় পশুপাখির মাতৃভাষা। কবি, পরিবেশবিদ, প্রাণিবিদ মিলে মিশে এক প্রাণবন্ত আলোচনা। তবে একই সঙ্গে চলছে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড শস্যের মুণ্ডুপাত। ওরে বাবা, আমার মাস্টার্স অবধি পড়াশোনা যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর, এটা এখানে যতক্ষণ আছি, কায়দা করে চেপে যেতে হবে।
বাইরে একটু দূরেই বিমানবন্দর রোডে বাস পুড়িয়ে দিয়েছে খানিকক্ষণ আগে। সারা দেশ পুড়ছে। এর মাঝে পশুপাখির ইতং-বিতং। চিন্তা হচ্ছে কেমন করে আস্ত আর জ্যান্ত মানুষ হিসেবে বাসায় ফিরে যাব। উত্তরাকে দিল্লি দূর মনে হচ্ছে। মাঝপথে পুড়ে ভোম হয়ে গেলে তো কারও দায় থাকবে না। কেন যে মা রাজি হলেন এতটা পথ আসতে, ধুর! পেটের ভেতর পাঁচ মাসের তাফসু মিয়াও বাইঙ মাছের মতো ঘাই মেরে তার বিরক্তি জানিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই বিপজ্জনক অভিযানের কথা জার্মানিতে থাকা তাফসু মিয়ার বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেওয়া যাবে না। জানতে দিলে সমূহ বিপদ।
রাত বাজে প্রায় বারোটা। আসার পথেও তারা গাড়ি দিয়ে দিল। চালকের চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। চালক ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস স্টাইলে গাড়ি টান দিলেন। এর কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই বিকট শব্দ আর লোকজনের হল্লা। চালক বললেন, ‘আপনারা পেছনে তাকাইয়েন না। বাসের গায়ে পেট্রলবোমা মারসে।’ আমি আর মা জমে গেলাম ভয়ে। অবস্থা পুরাই ইয়া নফসি ইয়া নফসি। মুখস্থ থাকা, ভুলে যাওয়া সব সুরা আওড়ালাম মনে মনে। পুরোটা পথ আমার আর মায়ের গলা দিয়ে স্বর বেরোল না, শুধু চিঁ চিঁ...পশুপাখির মাতৃভাষা...!
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।