somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাইন নদীর এলোকেশী ৪

১৭ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সকালের মিষ্টি রোদ পিঠে নিয়ে খামারবাড়ির টান-বারান্দায় অলস বসেছি মাত্র। মৌরি আপুর হাতে মুরাকামির 'নরওয়েজিয়ান উডস্' তো আমার চোখ মুজতবা আলীর 'চাচা কাহিনী'র পাতায়। কফি মগে ধোঁয়ার কুন্ডুলী বাতাসে একটা ছুটি-ছুটি ঘ্রান ছুটিয়ে দিচ্ছে। এই সুখ বেশিক্ষন সইল না। হাদি ভাই আর রুমি মিলে হইহই জুড়ে দিল আজও কোথাও বেরোবে বলে। ছানারাও তাল মিলিয়ে রইরই করে উঠলো। আমাদের চিঁ চিঁ ক্ষীন আপত্তির মুখে তাৎক্ষনিক একটা এলোমেলো ভোটাভুটি হল। 'আলসে পার্টি' (আপা) বনাম 'বাপ-ছেলের দল' (বাছেদ)। অতর্কিত রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে আপারা পরিষ্কার দুই ভোটের ব্যবধানে বাছেদের কাছে হেরে গেল। অগত্যা বইয়ের ভাঁজে বুকমার্ক গুঁজে নেহাৎ অনিচ্ছায় পায়ে চপ্পল গলালাম দুই পরাজয়ী।

আধ ঘন্টার মাথায় অবশ্য পরাজয়টা অত খারাপ ঠেকলো না। পাহাড়ে মাথায় জায়গাটার নাম গিডিয়ন্সয়েক। তার একটা বড় অংশ ঘিরে গাছগাছালিতে ছাওয়া ছিমছাম রেস্তোরা। আরামের এমন চমৎকার ব্যবস্থা দেখে চেয়ার টেনে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়লাম গাছের ছায়ে। ওয়েটারকে ইশারা দিতেই কফি চলে এলো। সুড়ুৎ চুমুকে খামারবাড়ির আলসেমিটা ফিরিয়ে আনলাম এক ঝটকায়। দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দিলাম। পাহাড়ের গায়ে ছককাটা আঙ্গুরের ক্ষেত বা ভিনিয়ার্ড। আকাশে মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি ভিনিয়ার্ডের বুকে আলো-ছায়ার খেলা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে।

আঙ্গুরের ক্ষেত ঢালু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নেমেছে নদীর ঘোলা জলে। মাতাল হাওয়ায় পাল তুলে রাইনের ঢেউ এই পথ জুড়ে বয়ে গেছে সুদীর্ঘ পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। রাইনের বেঁকে চলা নিখুঁত সুডৌল বাঁক যেন লাস্যময়ী লোরেলাইকেও হার মানায়। মাঝনদীতে ভিনিয়ার্ড সমেত গোলাকার বোপার্ড শহর ঝিনুক-খোলা মুক্তার মতই জ্বলজ্বল করছে। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় রাইনভ্যালির নাম থাকার কারনটা বেশ বোঝা গেল এই গিডিয়ন্সয়েক থেকে।

রাইনের অলক ইশারা আর উপেক্ষা করা গেল না। গিডিয়ন্সয়েক থেকে গড়িয়ে নেমে সোজা চেপে বসলাম মাঝারি সাইজের জাহাজে। নিস্তরঙ্গ নদীতে বিলাসী নৌবিহার না করলে আর চলছে না। বাচ্চাদেরকে বাছেদ পার্টির সিনিয়র দুই সদস্যের কাছে গছিয়ে দিয়ে কাছ থেকে আমরা দুই আপা সটকে পড়লাম রিভার ক্রুজের নিরিবিলি এক কোনে।

বেশ আয়েশ করে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি কাঠের বেঞ্চিতে। হালকা খিদে পেয়েছে। মৌরি আপুর সাথে টুকটাক ফলমূল থাকে। খিদের কথা শুনে তার থলে থেকে কমলা আর কলা উঁকি দিল। এদিকে জাহাজের স্পিকার কড়কড়্ শব্দে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, 'রাইনের জলরাশিতে সুস্বাগতম। এবার আপনাদের শোনাবো রাইনভ্যালির ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গল্প'। খিদে পেটে ইতিহাসে রুচি হল না। তার বদলে কমলার খোসা ছাড়াতে লাগলাম গভীর মনোযোগে। মৌরি আপুও গম্ভীর মুখে কপকপ্ কলা চিবোতে লাগলো।

স্পিকারে ঘ্যানঘ্যানে স্বরে ভাঙ্গা রেকর্ড চলছে তখনো। হঠাৎ ইঁদুর-বিড়াল দূর্গের প্রসঙ্গ আসতেই কান খাড়া করে হয়ে গেল। বোপার্ডে আসা অবধি নামগুলো খুব শুনছি। কমলার শেষ কোয়া মুখে পুরে কেচ্ছা শুনতে লেগে গেলাম।

ঘটনা সেই নয়শ চুয়াত্তর সালের। সত্য কি মিথ্যা, কেউ জানে না। এই এলাকার লোককাহিনী আর কি। ইঁদুর কেল্লা বা মাউস টাওয়ার তখন খাজনা আদায়ের আপিস। জার্মানির মাইঞ্জ শহরের আর্চবিশপ, নাম তার হাতো। সে তখন সেই আপিসের দায়িত্বে। নাম হাতো হলে হবে কি, তার হাত ছিল বেজায় কঞ্জুস। সেবার দুর্ভিক্ষ হলে এই হাড়কিপ্টে সব গম-ভুট্টা গুদাম করে ফেললো। বেশি দামে ধনীদের কাছে বেচবে বলে। ওদিকে গরীবের দল একদিন হল্লা করে জমায়েত হল গুদামের সামনে। তাদেরকে শস্যের ভাগ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে চুপিসারে খড়ের গাদায় আগুন দিল হাতোর বাহিনী। নির্দোষ মানুষগুলো জ্যান্ত পুড়ে মরে গেল চোখে সামনে। সেই আর্তনাদ শুনে হাতো ক্রু হেসে বললো, 'হ্যাহ্, যতসব ইঁদুরের কিচিরমিচির!'।

ঘটনার সেখানেই শেষ না, বরং শুরু। আচমকাই একটা-দু'টা করে শ'খানেক, তারপর হাজারে-বিজারে ইঁদুরের পাল এসে পঙ্গপালের মত ছেঁকে ধরলো হাতো সাহেবকে। পালিয়ে বাঁচতে নদী পার হয়ে সে তার খাজনা আদায়ের কেল্লায় আশ্রয় নিল। ওদিকে ইঁদুরের দল পিছু ছাড়লো না। তারা সাঁতরে নদী পেরিয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কেল্লার উঁচু দেয়াল খামচে উঠে পড়লো পিলপিল করে। তারপর হাতোকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো উন্মাদ খিদে নিয়ে। রক্তহিম করা কিচিরমিচির শব্দে কেঁপে উঠল কেল্লার অন্দর। আর সেই থেকে এর নাম হল ইঁদুর-কেল্লা।

রোম খাঁড়া দেয়া গল্পটার রেশ না কাটতেই বিড়াল দূর্গের কাহিনী শুরু হল। কিন্তু সে আর শোনা হয়ে উঠলো না। স্পিকার থেকে গোঙ্গানির মত ঘড়ঘড় শব্দ বেরুচ্ছে। গল্পের আশা ছেড়ে বরং পাহাড়, নদী, কেল্লা আর মেঘমল্লার দেখতে লাগলাম নির্বিকার।

মৃদু ধাক্কা তুলে ঘাটে এসে ভিড়লো আমাদের রিভার ক্রুজ। নৌবিহারের পাট চুকিয়ে চললাম রাইনষ্টাইন দূর্গ দেখতে। রাইনের দু'পাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত ছড়ানো ছিটানো শুধু কেল্লা আর দূর্গ। এই যেমন ঘাট বরাবর জেব্রা ক্রসিংটা পার হলেই রাইনষ্টাইনের সিড়ি। জল ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে নূর আর তাফসু মিয়া এক বানর লাফে মিলিয়ে গেল দূর্গের কোন গহীনে। ও নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম তেরশ শতকের এই বিচিত্র স্থাপনা।

ইট-পাথর ছাপিয়ে প্রথমেই মন কেড়ে নিল প্রকান্ড এক ফুলের বাগান। বেগুনি ল্যাভেন্ডার আর গোলাপি ওলিয়েন্ডারের ঝোঁপ চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নানা ফুলের জাত আগুন লাগিয়েছে একোন-ওকোনে। লতানো গুল্ম যেন মাথার উপর শামিয়ানা খাটিয়েছে অতিথিরা আসবে বলে। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এই শুন্যোদ্যানের নাম 'বার্গেন্ডি গার্ডেন'। লাল আঙ্গুরের ক্ষেত, 'বার্গেন্ডি ভাইন' দেখা যায় নদীর ওধারে। তারই নামে নাম এই ঝুলন্ত বাগানের।

রোমান্টিক আবহটা গুবলেট করে দিয়ে ভ্যাড়ার ডাক ভেসে এল। 'ম্যা, ম্যা, শিগগির এদিকে...!'। বাম দিকে নাইটস হল। ডাক আসছে ওদিক থেকেই। সেকালের সৈন্য-সামন্তের বর্ম-তলোয়ার সাজানো এ ঘরে। তাফসু মিয়া আর নূর মিয়া তলবারি ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে কি না কে জানে। আবছা আঁধারে ঢাকা বিরাট হলঘরে ঢুকতেই লাল-নীল আলোর ছটায় অভিভূত হলাম। রঙ্গীন কাঁচের নকশা ছাদ-ছোঁয়া জানালায়। ‍গথিক আমলের গির্জার সাজ। আবার মনে হল ডিস্কো হলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে আলো নাচছে ঘুরে ঘুরে। কিন্তু সম্বিত ফিরলো তাফসু মিয়ার ব্যাকুল ডাকে। তার হাতে এক টুকরো ধাতব পাত। আবিষ্কার হল সৈন্যের বর্ম ধরে ঝাঁকাঝাঁকি করতে গিয়ে খুলে এসেছে পটাং। তাও আবার উরু বরাবর এক বেজায়গায় থেকে। জোড়া দিতে গিয়ে সৈনিকের আরো মানহানি ঘটতে পারে। তাই টুকরাটা আস্তে করে পায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে এলাম নাইটস হল থেকে।

প্যাঁচানো সিড়ি বেয়ে একেবারে উপরের মিনারটায় উঠে এলাম। দিগন্তজুড়ে রাইন আর রাইন। কত অতীত আর বর্তমানের সাক্ষী হয়ে আছে এই নদী। না জানি আরো কত অজানা লুকিয়ে তার জলের অতলে। ডুবুরি বেশে একবার দেখে আসতে পারলে মন্দ হত না। ইতস্তত ভাবনায় ছেদ পড়লো হাদি ভাই আর রুমির ডাকাডাকিতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাইনষ্টাইনের চূড়ায় সূর্য ডুবিয়ে সেদিনের মত খামারবাড়ির পথ ধরলাম সবাই মিলে।

পরদিন। আজকেও দূর্গ দর্শনে বেরোচ্ছি। এ কয়দিন ডজনকে ডজন দূর্গ ঘুরে ঘুরে রীতিমত দুর্গেশনন্দিনী বনে গেছি। কিন্তু আজ বোধহয় মৌরি আপুকে হাতিটানা দিয়েও ঘর বার করা যাবে না। 'নরওয়েজিয়ান উড' আগলে ঝিম মেরে বসেন আছেন। সুতরাং তাকে আর না ঘাটিয়ে হাদি ভাই আর নূরকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কেল্লার নাম এরেনবুর্গ। পাহাড়ের মাথায় প্রায় আড়াইশ মিটার উঁচুতে ঘন জঙ্গলের মাঝে ইট-কাঠ সমেত বেখাপ্পা দাঁড়িয়ে। লোকালয় থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে ফটকে পৌঁছাতে হল। সাড়ে আটশ বছরের পুরানো এরেনবুর্গ নাকি প্রতি রবিবার আর ছুটির দিনগুলোতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজকেও রবিবার। দেখাই যাক কি ঘটছে দরজার ওপাশে। কৌতূহলী উঁকি দিতেই যেন পিছিয়ে গেলাম পাঁচশ বছর। লোকজন ঢিলেঢালা ঝুল দেয়া কাপড় পড়ে ঘুরছে। কারো বা কোমরে তলোয়ার কিংবা পিঠে তীর-ধনুক। এ যেন এক টাইম ক্যাপসুল।

কাউন্টারে টিকেটের টাকা রেখে হাতে কতগুলো ধরিয়ে দেয়া হল বেঢপ সাইজের গোল গোল চাকতি। এগুলো নাকি মধ্যযুগীয় মুদ্রা। হালের ইউরো-ডলার এই এরেনবুর্গে অচল। স্যুভেনির কিনতে বা কিছু খেতে হলে এই মুদ্রাই ভরসা।

যাহোক, পায়ে পায়ে এগোতেই কুমারশালার দেখা মিলল। মাটির হাড়ি-কুড়ি নিয়ে এক বুড়ো বসে আছে। তার পায়ের কাছে অতিকায় এক জার্মান শেপার্ড আধঘুমে। পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু বুড়ো হেঁকে বললো, 'এই হাড়িটা নেবে নাকি? কাঁচা আলু ছুড়বে আর সেদ্ধ আলু তুলবে। দুই মুদ্রায় ছেড়ে দেবো, নিয়ে যাও'। হাড়ি বগলে ঘুরে বেরানোর ইচ্ছে নেই। তাছাড়া, ভেতো বাঙ্গাল। আলুর প্রতি প্রেম সীমিত। অতএব, বিনয়ের সাথে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম।

কুমারশালার উল্টো দিকেই কামারশালা। সেখানে হাতুড়ি-বাটালি ঠুকে কাজ করছে শক্ত চোয়ালের এক লম্বা-চওড়া লোক। কাঠের তক্তার উপরে এক ডাঁট গোলাপ রাখা। পুরোটাই লোহার তৈরি। দেখে তারিফ করতেই হল। তবে লোকটা গোলাপ কিনতে সাধলো না। বরং বাঁশের কঞ্চির মত কি যেন একটা ধরিয়ে দিল। এক পাশ ফালি করে কাটা দেখে ঝাড়ু-ঝাঁটার মত দেখাচ্ছে। 'যাও, তোমাকে এটা উপহার দিলাম। খুব কাজের জিনিস, বুঝলে। যেমন পিঠ চুলকানো যায়, তেমনি স্যুপ নাড়াতেও দুর্দান্ত'। বলেই সেটা দিয়ে পিঠ চুলকে একটা হ্যান্ডস্-অন ডেমো দেখিয়ে দিল। আরেক হাত উঁচিয়ে বললো, 'ঐ দেখো চুলায় স্যুপ চাপিয়েছে'। তাকিয়ে দেখি, অদূরেই ছাউনির নিচে কেউ একই নাড়ুনি দিয়ে হাড়ি নাড়ছে। সামনে লম্বা লাইন। লোকে কয়েন ফেলে বাটি ভরে স্যুপ নিয়ে যাচ্ছে। রাঁধুনির উশখুশ চেহারা দেখে মনে হল, ফাঁক পেলেই সে পিঠ চুলকে নেবে একটু। আজকে আর যাই হোক, স্যুপ খাওয়া যাবে না দেখছি।

এর মাঝে ট্যুর গাইড চলে এসেছে। ছোট দলে ভাগ হয়ে দূর্গের অন্দরমহল ঘুরে দেখা শুরু হল। কামরাগুলো গুহার আদলে বানানো। আরাম-আয়েশের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। রাইনষ্টাইনের সাথে বিরাট ফারাক এরেনবুর্গ দূর্গের। তবে এই বনজঙ্গলের ভেতর বিলাসের উপকরনও বা মিলবে কোথায়। এঘর-ওঘর পেরিয়ে খোলা ছাদে এসে পৌঁছালাম। এক প্রান্তে বিচিত্রদর্শন এক কামান পড়ে আছে। সেকালের গুলতি-কামান। ধাতব গোলা কাঠের তক্তার এক মাথায় বেঁধে উড়িয়ে মারা হত দূর নিশানায়। শত্রু এসে এরেনবুর্গ দখলে নিতে চাইলে এই গোলার আঘাতে ভর্তা করে দেয়া হত একেবারে। আর যদি বা এই রক্ষাবুহ্য ভেদ করে কোনোমতে দূর্গে পৌঁছে যেতই, তাহলে বোধহয় নাড়ুনি দিয়ে বেশ করে পিঠ চুলকে স্যুপ বানিয়ে খাইয়ে দেয়া হত জামাই আদরে।

দুপুর নামিয়ে এরেনবুর্গ থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। বাকিদিনটা খামারবাড়িতে গল্প-গুজবে কাটানো যাবে। আজকেই শেষ দিন। কালকে শহুরে মানুষ আবার শহরপানে ছুটবো।

খামারবাড়ির আঙ্গিনায় বাকিদেরকে পাওয়া গেল। নূর খরগোশের কান মুলছে, মৌরি আপু খামারবাড়ির মালিকের সাথে গল্পে মজেছে আর হাদি ভাই 'চাচা কাহিনী'র পাতা ওল্টাচ্ছে বারান্দায় আধশুয়ে। এই না হলে ছুটি। ছুটির স্বাদ আরো বাড়লো যখন খামারবাড়ির মালিক ভদ্রলোক দড়ি ধরে দু'টা টাট্টু ঘোড়া নিয়ে এল। মাথায় হেলমেট চাপিয়ে নূর আর তাফসু মিয়া তাতে পাকা ঘোড়সওয়ারের মত লাফিয়ে চড়ে বসলো। আর আমরা চললাম পিছু পিছু।

পথের পাশে গাছের গায়ে এক-আধটা নীল-হলুদ নিশানা সাঁটা। দেখতে অনেকটা ঝিনুকের মতন। জিজ্ঞাসু চেহারা দেখে হাদি ভাই জবাব জোগালেন, 'এই হল 'ইয়াকবস ভেগ' (Jacoks Weg)। মানের 'ইয়াকুবের রাস্তা'। সেন্ট ইয়াকুব বা জ্যাকবের আরেক নাম সেন্ট জেমস'। এই নীল-হলুদ ঝিনুক-ছাপ তারই প্রতীক'। হাদি ভাই আমাদের ভ্রাম্যমান উইকিপিডিয়া। দলের ভেতর একজন এমন সবজান্তা থাকা জরুরী। উনি গড়গড়িয়ে বলে চললেন আর আমরা চোখ গোল গোল শুনতে লাগলাম।

'সেন্ট জেমস ছিলেন যীশু খ্রিস্টের বারো শিষ্যের একজন। ঐ যে লিওনার্দো ভিঞ্চির 'লাস্ট সাপার' ছবিতে যেই বারো জন ছিল। এই সেন্ট জেমস মারা যান এক ইহুদি রাজার হাতে। তাকে সমাহিত করা হয় স্পেনের 'সান্তিয়াগো দে কম্পোস্তিলা'য়। জায়গাটা সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান। এই ঝিনুক-ছাপ দেয়া পথ ধরে লোকে পায়ে হেঁটে তীর্থে যায়। বেশ কয়েকটা দেশের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথটা। দীর্ঘ এই যাত্রার নাম কামিনো দে সান্তিয়াগো। অনেকে ছোটো করে বলে শুধু কামিনো'। আমাদের ভ্রাম্যমান গুগল, হাদি এক নিশ্বাসে সব বলে ব্রেক চাপলেন এবার।

সন্ধ্যা নেমেছে। ঝোঁপ-ঝাড়-জঙ্গলে ছাওয়া কামিনো পথটা ভুতুড়ে দেখাছে আবছা আঁধারে। আর না এগিয়ে আমরা উল্টো ঘুরলাম।

খামারবাড়ি পৌঁছে অল্পের ভেতর খাদ্যপর্ব চুকিয়ে আমরা ঝুলবারান্দায় চুটিয়ে আড্ডায় বসেছি। এমন চাঁদের আলোয় ভূতের গল্প ফাঁদতে হয়। বাতাসে গাছের পাতা নড়ে উঠলে কি একটা চামচিকা দৌড়ে পালালে ভয় জমে ক্ষীর একেবারে। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় কালো একটা হুলো বিড়াল টপ্ করে কোলে উঠে এল। তুলতুলে পিঠে আলতো হাত বোলাতেই ভোশ ভোশ নাক ডাকা শুরু হল। কিন্তু, ভূতের গল্পে না মজে আমরা হানা দিলাম হাদি ভাইয়ের ক্যাডেট ইশকুলের স্মৃতির পাতায়।

ক্লাসের ঘন্টা পড়েছে। অথচ বাংলা স্যারের দেখা নেই। এই ফাঁকে ক্লাসের পাজী ছেলে ব্ল্যাকবোর্ডে বড় বড় হরফে লিখেছে, 'পাছা মোটা শয়তান - পামোশ'। বাংলা স্যারকে আড়ালে পামোশ ডাকা হয়। এমন সময়ে স্যারের চপ্পলের ফট ফট্ শোনা গেল। পামোশ-রহস্য ফাঁস হলে আর রক্ষা নেই আজকে। বেত পড়বে সপাং সপাং। পাজীতে-হাজীতে ফারাক হবে না। অবস্থা বেগতিক সমঝে ক'জন বোর্ডে ছুটে চক-ডাস্টারে চালালো হিং-টিং-ছট। জটলা দেখে স্যার বাঁজখাই হাঁক দিলেন, 'অ্যাঁও! হচ্ছেটা কি?'। একজন সাহস করে বললো, 'স্যার, আমাদের নতুন শ্লোগান, 'পরাজয় মোদের শক্তি - পমোশ'!। বাকিরা গলা চড়িয়ে ধুঁয়া তুললো, 'পমোশ, পমোশ!'। স্যার চওড়া হাসিতে শুধালেন, 'শ্লোগান জব্বর হয়েছে রে। তোরা দেখছি জাত ক্যাডেট। নে, এবার বই খোল...'।

চায়ের কাপে টলটলে চাঁদ ভাসছে। আমাদের আড্ডা এগিয়ে চলছে তুমুল উচ্ছ্বাসে। আর হৈ-হুল্লোড়ে কোলের হুলোটা যে কখন পালিয়েছে, কে জানে। (সমাপ্ত)

রাইনের পাড়ে পাহাড়ের গায়ে আঙ্গুরের ক্ষেত বা ভিনিয়ার্ড

নিস্তরঙ্গ নদীতে বিলাসী নৌবিহার

পাহাড়, নদী, কেল্লা আর মেঘমল্লার

রাইন নদীর আঁচল ছুঁয়ে বোপার্ড শহর

রাইনষ্টাইন দূর্গ

সিড়ি ভেঙ্গে দূর্গের অন্দরে যাত্রা

রাইনষ্টাইন দূর্গের শূন্যোদ্যান, বার্গেন্ডি গার্ডেন

রাইনষ্টাইন দূর্গের সাজানো উঠানে আমরা

দূর্গের ছোট্ট চার্চে রঙ্গীন কাঁচের বাহারি নকশা

এপাশে অতীত, ওপাশে বর্তমান আর মাঝে সাক্ষী এক নদী

১৬ কেল্লার ফটকে দলের একাংশ

এরেনবুর্গ দূর্গের ফটক

এরেনবুর্গ দূর্গের কুমারশালা

দূর্গের কামারশালায় গড়া লোহার গোলাপ

মধ্যযুগীয় গুলতি-কামান

এরেনবুর্গ দূর্গের অন্দরমহল

খামারবাড়ির একাংশ

ইয়াকবস্ভেগ বা সেন্ট জেমস-এর তীর্থপথ আর পথের নীল-হলুদ নিশানা

দুই ঘোড়সওয়ার
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৩:২৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×