somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাটি ও মানুষের কথা-৩

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাটি ও মানুষের কথা ৩
অন্তরালের মানুষ-আলিমউজজামান
বাংলাদেশে টেলিভিশনের প্রযোজকদের মধ্যে আলিমউজ্জামান ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। তাঁর গ্রামের বাড়ী ছিল যশোরে। একটি শিক্ষিত রুচিবান পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল সবার কাছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় সব অনুষ্ঠানের পিছনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেপথ্য কর্মী। বিশেষ করে ঢাকা টেলিভিশনের রক্তকরবী, জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নতুন কুড়ি, মাটি ও মানুষ, আইন আদালত এগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার কথা সংশ্লিষ্ট সকলে মনে রাখবে। মুক্তিযদ্ধর একজন সাহসী সৈনিক হিসেবে তিনি জামিল চৌধুরির সাথে, মুস্তাফা মনোয়ারের সাথে কাজ করেছেন। তাঁদের সাথে কাজ করতে করতে জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।
শিল্পলীদের সাথে তাঁর ছিল অসাধারণ সম্পর্ক। গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, জহুর আহমদে, রায়হান গফুর, জয়ন্ত চ্যাটার্জী এদের সাথে ছিল ঘনিষ্টতম সম্পর্ক। বন্ধুদের তিনি কতটা ভালবাসতেন তার দু একটা নমুনা আছে আমার কাছে। জয়ন্ত চ্যাটার্জী যখন অভিনয়ে ক্যরিয়ার গড়তে ঢাকা এলেন তখন কিন্তু সপরিবারে আলিমউজ্জামানের বাড়ীতে ওঠেন। অনেকদিন তাদের সংসারের সাথে ছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে জান এক্ষেত্রে আলিমউজজামানকে ঘরে বাইরে অনেকের কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু বন্ধুত্বে সম্মান তিনি দিয়েই গেছেন।
আলিমউজ্জামানের এই ধরনের আচরণের জন্য তার পরিবারকেও সম্মান করতে হয়। সেই পরিবারের সদস্যরা নিজ বাড়ীতে নিজেদের সুবিধাকে ত্যাগ করে অতিথিদের জন্য জায়গা করে দিয়েছেন। এই জগতে এমন উদাহরণ আসলেই বিরল।
শান্তিনগরে ম্বশুরের দেওয়া বাড়ীতে তিনি থাকতেন। তার এক বন্ধুর জন্য নিজের বাড়ী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বন্ধু কিন্তু ঋণ শোধ করেন নি। আর আলিমউজ্জামান মারা যাওয়ার পর বাড়ীটি নিলামে ওঠার উপক্রম হয়। এরপর এক ডেভেলপারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই সমস্যার সমাধান হয়।
টেলিভিশনে তার পরিচিতি ছিল বঙ্গবন্ধু হিসেবে। কেউ তার কাছে টাকা চাইলে নিজের পকেট উজাড় করে দিতেন এবং পরে নিজের বাস ভাড়াটিও যোগাড় করতেন অন্য কারো কাছ থেকে।
আলিমউজ্জামানের ডাক নাম ছিল দুলু। আমরা দুলু ভাই বলেই ডাকতাম। প্রযোজক- ফখরুল আবেদীন দুলাল, ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন বুলু- তাকে ডাকতো আব্বা বলে। তার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা ঋণী।
তার হাত ধরে টেলিভিশনে যারা জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের মধ্যে আহমেদ ইউসুফ সাবের, অভিনেত্রী তিশা, অরুনা বিশ্বাস, অন্যতম। আলিমউজ্জামানের হাত ধরেই টেলিভিশনে আসেন সে সময়ের উপস্থাপক রেজাউর রহমান, আমি নিজে, রায়হান গফুর, জয়ন্ত চ্যাটার্জী সহ আরো অনেকে।

আলিমউজ্জামানের ছিল কৃষকদের প্রতি একটা দরদী মন। কিভাবে কৃষকদের ভাল করা যায় সেটি ভাবতেন। আমাদের পরামর্শ দিতেন, শিখিয়ে দিতেন কিভাবে কথা বলতে হবে। আমরা কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইলেও তিনি না করতেন না। আমি মাটি মানুষের সাথে সংযুক্ত করেছিলাম মামুন রশিদ (সাবেক ব্যাংকার এবং বর্তমানে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত), ফাহমিদা (সিপিডিতে কর্মরত), সহ আরো অনেক কে। এরা মাটি মানুষের জন্য তথ্য ও গবেষণার কাজ করতেন। মাটি ওমানুষ অনুষ্ঠানে ধন মিয়া পুতুল নাচ দেখিয়েছেন। আজিজুল হাকিম আর অরুনা বিশ্বাস নাটকের স্কিড পরিচালনা করতেণ্ অভিনয় জগতে আজিজুল হাকিমের শরু কিন্তু এই মাটি মানুষ থেকেই।
আমাদের বিপদে আপদে আলিমউজ্জামান সহায়তা করতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যখন হল বন্ধ হয়ে যেতো তখন দু এক রাত তার বাসাতেও কাটিয়েছি। তার সাথে ঘুরেছি দেশের প্রত্যন্ত স্থানে। এমনি ভাবে অনেক পথ তিনিই আমাদের চিনিয়েছেন।
কৃষি ও কৃষকের উঠোনে তিনি বসে পড়তেন। কৃষকদের তিনি সম্মান করতেন। বিজ্ঞানীদের প্রতিও তাঁর ছিল অসাধারণ শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যখন কাজী পেয়ারার গবেষণা হয় তখন গবেষণা মাঠ থেকে তারুন্যের উচ্ছলতায় একটি পেয়ারা ছিড়ে পকেটে ভরতে চেয়েছিলেন শাইখ সিরাজ। কিন্তু আকারে বড় হওয়ায় এটা পকেটে নেওয়া যাচ্ছিল না। এটা দেখে আলিমউজ্জামান দুলু ভাই অসম্ভব রেগে গিয়েছিলেন। গবেষণা মাঠ থেকে ফসল তোলা যে উচিত নয় সেদিন তিনি শিখিয়েছিলেন।
আজ যখন অনুষ্ঠান করতে যাই অনেককে দেখি পাকা ফল গাছ থেকে নিয়ে কেউ কেউ খেয়ে ফেলছে। কিন্তু যখনই তেমন কিছু দেখি তখন মনে পড়ে সেই দিনের কথা। দুলু ভাইয়ের সেই চোখ ভেসে উঠে চোখের সামনে।
আলিমউজ্জামান ভালবাসতেন মানুষকে। ধর্মকর্মের প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তিনি কারো সাথে অন্যায় করেছেন, কিংবা তার দ্বারা কোনো ক্ষতি কারো হয়েছে একথা কেউ বলতে পারবে না। তার দ্বারা ক্ষতি যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে তা নিজেরই, অন্য কারো না।
তা না হলে কেউ নিজের ঘরে অপরকে মাসের পর মাস থাকতে দেয়? নিজের বাড়ী অরের নামে বন্ধক দেয়? আপন মানুষও কি এমন বোকামী করে?
এমনিভাবে আলিমউজ্জামান আগলে রেখেছিলেন মাটি মানুষকে। ১৯৯১ সালে বিন্ইপ সরকার এলে এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপি তখন মনে করেছিল এটা মনে হয় এরশাদ সাহেবের কোনো অনুষ্ঠান। কিন্তু পরে যখন এটি আবার চালু করা হয় তখন তা চলে যায় অন্য প্রযোজকের হাতে। নিজের সন্তান অন্যের কাছে যাওয়ায় অনেকটা কষ্ট ছিল তার মাঝে। তখন কিন্তু কিছুদিনের জন্য আমিও বাদ পড়ে যাই। অনুষ্ঠান শুরু হলো- কিন্তু আমাকে খবর দেওয়া হলো না। এ প্রসঙ্গে পরে আরো লিখবো। তবে আলিমুজ্জমান আর অনুষ্ঠানে ফেরত আসেননি।
মৃত্যুর দুইদিন আগে আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল। গিয়েছিলাম তার বাড়ীতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন শনিবার টিভিতে যেতে। কিন্তু শুক্রবার রাতেই তার মৃত্যুর খবর পেলাম।
আলিমউজ্জামান। আমার জীবনে এই ব্যক্তির নামটা কোনোদিনই ভোলার নয়। তিনি আছেন সারাজীবন। বিশেষ করে যখন মাটি ও মানুষের টাইটেল যখন বেজে ওঠে তখনই মনে হয় বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন অন্তরালের মানুষ আলিমউজজামান।

আগের পোষ্টগুলো এখানে দেখুন
মাটি ও মানুষের কথা ১
Click This Link
মাটি ও মানুয়ের কথা ২
Click This Link


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৩২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×