মাটি ও মানুষের কথা ৩
অন্তরালের মানুষ-আলিমউজজামান
বাংলাদেশে টেলিভিশনের প্রযোজকদের মধ্যে আলিমউজ্জামান ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। তাঁর গ্রামের বাড়ী ছিল যশোরে। একটি শিক্ষিত রুচিবান পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল সবার কাছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় সব অনুষ্ঠানের পিছনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেপথ্য কর্মী। বিশেষ করে ঢাকা টেলিভিশনের রক্তকরবী, জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নতুন কুড়ি, মাটি ও মানুষ, আইন আদালত এগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার কথা সংশ্লিষ্ট সকলে মনে রাখবে। মুক্তিযদ্ধর একজন সাহসী সৈনিক হিসেবে তিনি জামিল চৌধুরির সাথে, মুস্তাফা মনোয়ারের সাথে কাজ করেছেন। তাঁদের সাথে কাজ করতে করতে জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।
শিল্পলীদের সাথে তাঁর ছিল অসাধারণ সম্পর্ক। গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, জহুর আহমদে, রায়হান গফুর, জয়ন্ত চ্যাটার্জী এদের সাথে ছিল ঘনিষ্টতম সম্পর্ক। বন্ধুদের তিনি কতটা ভালবাসতেন তার দু একটা নমুনা আছে আমার কাছে। জয়ন্ত চ্যাটার্জী যখন অভিনয়ে ক্যরিয়ার গড়তে ঢাকা এলেন তখন কিন্তু সপরিবারে আলিমউজ্জামানের বাড়ীতে ওঠেন। অনেকদিন তাদের সংসারের সাথে ছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে জান এক্ষেত্রে আলিমউজজামানকে ঘরে বাইরে অনেকের কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু বন্ধুত্বে সম্মান তিনি দিয়েই গেছেন।
আলিমউজ্জামানের এই ধরনের আচরণের জন্য তার পরিবারকেও সম্মান করতে হয়। সেই পরিবারের সদস্যরা নিজ বাড়ীতে নিজেদের সুবিধাকে ত্যাগ করে অতিথিদের জন্য জায়গা করে দিয়েছেন। এই জগতে এমন উদাহরণ আসলেই বিরল।
শান্তিনগরে ম্বশুরের দেওয়া বাড়ীতে তিনি থাকতেন। তার এক বন্ধুর জন্য নিজের বাড়ী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বন্ধু কিন্তু ঋণ শোধ করেন নি। আর আলিমউজ্জামান মারা যাওয়ার পর বাড়ীটি নিলামে ওঠার উপক্রম হয়। এরপর এক ডেভেলপারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই সমস্যার সমাধান হয়।
টেলিভিশনে তার পরিচিতি ছিল বঙ্গবন্ধু হিসেবে। কেউ তার কাছে টাকা চাইলে নিজের পকেট উজাড় করে দিতেন এবং পরে নিজের বাস ভাড়াটিও যোগাড় করতেন অন্য কারো কাছ থেকে।
আলিমউজ্জামানের ডাক নাম ছিল দুলু। আমরা দুলু ভাই বলেই ডাকতাম। প্রযোজক- ফখরুল আবেদীন দুলাল, ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন বুলু- তাকে ডাকতো আব্বা বলে। তার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা ঋণী।
তার হাত ধরে টেলিভিশনে যারা জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের মধ্যে আহমেদ ইউসুফ সাবের, অভিনেত্রী তিশা, অরুনা বিশ্বাস, অন্যতম। আলিমউজ্জামানের হাত ধরেই টেলিভিশনে আসেন সে সময়ের উপস্থাপক রেজাউর রহমান, আমি নিজে, রায়হান গফুর, জয়ন্ত চ্যাটার্জী সহ আরো অনেকে।
আলিমউজ্জামানের ছিল কৃষকদের প্রতি একটা দরদী মন। কিভাবে কৃষকদের ভাল করা যায় সেটি ভাবতেন। আমাদের পরামর্শ দিতেন, শিখিয়ে দিতেন কিভাবে কথা বলতে হবে। আমরা কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইলেও তিনি না করতেন না। আমি মাটি মানুষের সাথে সংযুক্ত করেছিলাম মামুন রশিদ (সাবেক ব্যাংকার এবং বর্তমানে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত), ফাহমিদা (সিপিডিতে কর্মরত), সহ আরো অনেক কে। এরা মাটি মানুষের জন্য তথ্য ও গবেষণার কাজ করতেন। মাটি ওমানুষ অনুষ্ঠানে ধন মিয়া পুতুল নাচ দেখিয়েছেন। আজিজুল হাকিম আর অরুনা বিশ্বাস নাটকের স্কিড পরিচালনা করতেণ্ অভিনয় জগতে আজিজুল হাকিমের শরু কিন্তু এই মাটি মানুষ থেকেই।
আমাদের বিপদে আপদে আলিমউজ্জামান সহায়তা করতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যখন হল বন্ধ হয়ে যেতো তখন দু এক রাত তার বাসাতেও কাটিয়েছি। তার সাথে ঘুরেছি দেশের প্রত্যন্ত স্থানে। এমনি ভাবে অনেক পথ তিনিই আমাদের চিনিয়েছেন।
কৃষি ও কৃষকের উঠোনে তিনি বসে পড়তেন। কৃষকদের তিনি সম্মান করতেন। বিজ্ঞানীদের প্রতিও তাঁর ছিল অসাধারণ শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যখন কাজী পেয়ারার গবেষণা হয় তখন গবেষণা মাঠ থেকে তারুন্যের উচ্ছলতায় একটি পেয়ারা ছিড়ে পকেটে ভরতে চেয়েছিলেন শাইখ সিরাজ। কিন্তু আকারে বড় হওয়ায় এটা পকেটে নেওয়া যাচ্ছিল না। এটা দেখে আলিমউজ্জামান দুলু ভাই অসম্ভব রেগে গিয়েছিলেন। গবেষণা মাঠ থেকে ফসল তোলা যে উচিত নয় সেদিন তিনি শিখিয়েছিলেন।
আজ যখন অনুষ্ঠান করতে যাই অনেককে দেখি পাকা ফল গাছ থেকে নিয়ে কেউ কেউ খেয়ে ফেলছে। কিন্তু যখনই তেমন কিছু দেখি তখন মনে পড়ে সেই দিনের কথা। দুলু ভাইয়ের সেই চোখ ভেসে উঠে চোখের সামনে।
আলিমউজ্জামান ভালবাসতেন মানুষকে। ধর্মকর্মের প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তিনি কারো সাথে অন্যায় করেছেন, কিংবা তার দ্বারা কোনো ক্ষতি কারো হয়েছে একথা কেউ বলতে পারবে না। তার দ্বারা ক্ষতি যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে তা নিজেরই, অন্য কারো না।
তা না হলে কেউ নিজের ঘরে অপরকে মাসের পর মাস থাকতে দেয়? নিজের বাড়ী অরের নামে বন্ধক দেয়? আপন মানুষও কি এমন বোকামী করে?
এমনিভাবে আলিমউজ্জামান আগলে রেখেছিলেন মাটি মানুষকে। ১৯৯১ সালে বিন্ইপ সরকার এলে এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপি তখন মনে করেছিল এটা মনে হয় এরশাদ সাহেবের কোনো অনুষ্ঠান। কিন্তু পরে যখন এটি আবার চালু করা হয় তখন তা চলে যায় অন্য প্রযোজকের হাতে। নিজের সন্তান অন্যের কাছে যাওয়ায় অনেকটা কষ্ট ছিল তার মাঝে। তখন কিন্তু কিছুদিনের জন্য আমিও বাদ পড়ে যাই। অনুষ্ঠান শুরু হলো- কিন্তু আমাকে খবর দেওয়া হলো না। এ প্রসঙ্গে পরে আরো লিখবো। তবে আলিমুজ্জমান আর অনুষ্ঠানে ফেরত আসেননি।
মৃত্যুর দুইদিন আগে আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল। গিয়েছিলাম তার বাড়ীতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন শনিবার টিভিতে যেতে। কিন্তু শুক্রবার রাতেই তার মৃত্যুর খবর পেলাম।
আলিমউজ্জামান। আমার জীবনে এই ব্যক্তির নামটা কোনোদিনই ভোলার নয়। তিনি আছেন সারাজীবন। বিশেষ করে যখন মাটি ও মানুষের টাইটেল যখন বেজে ওঠে তখনই মনে হয় বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন অন্তরালের মানুষ আলিমউজজামান।
আগের পোষ্টগুলো এখানে দেখুন
মাটি ও মানুষের কথা ১
Click This Link
মাটি ও মানুয়ের কথা ২
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




