বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শান্তিনগর যাবার পথটুকু এখন ভিআইপি সড়ক ; বলতে গেলে হঠাৎ করেই এই ঘোষণা । কিন্তু ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যেতে হবে বাধনকে ।‘ভিআইপি রাস্তা ’ তাই রিক্সা চলাচল নিষেধ ।- বিকল্প উপায় হিসেবে আছে বিশ্ববিদ্যালয় বাস সার্ভিস । ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা বাসগুলোতে করে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালযের আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো বাধনেরও । কিন্তু চির পরিচিত লাল বাসগুলো কখন কোথা হতে গন্তব্যেও উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় তা দুই বছরের এই ক্যাম্পাস জীবনে তার জানা হলো না । তবে এমন দুর্দিনে ও তার পাশে আছে তার বন্ধুরা , জানা গেল দশ মিনিটের মধ্যে টিএসসি থেকে ছেড়ে যাবে ‘কিঞ্চিৎ’ আর তাতে করেই বাড়ি ফিরতে পারে বাধন । পনের মিনিট দাড়িয়ে থাকার পর যখন তার চোখের সামনে দিয়ে কিঞ্চিৎ নামধারী বাসটি চলে যায় , তখন বাধনের মনে পরে বাসটা এতক্ষণ ফটো স্টুডিও টির সামনে দাড়িয়ে ছিলো ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন হাজারখানেক অভিজ্ঞতা রয়েছে বিশ্ববিদ্যলয়ে সদ্য যোগদানকারী শিক্ষার্থী ’ বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা লাখখানেক শিক্ষার্থীর। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে ভালবাসে বলেই হয়তো মধ্যরাত অবাদি স্থানটা থাকে জমজমাট । আর প্রবীণ বয়সে অনেকে ধুলো পড়া ডায়েরির পাতা খুলে ক্যাম্পাস জীবনকে মনে করে আনন্দ পায় । আবার অনেকে আনমনে হেসে ওঠেন সেই বাধনহারা জীবনের কথা মনে করে , কেউ কেউ নিজের সেই অভিজ্ঞতাগুলো ছড়িয়ে দেন তার নাতি নাতনিদের কাছে ।
এইসএসসি পাস করে প্রতি শিক্ষর্থীর মাঝে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাকুল ইচ্ছা থাকে । ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’কারো জন্য একথা সত্য হলেও অনেকের জন্যই তা নির্মম মিথ্যা । তবে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে তেমন সৌভাগ্যমান শিক্ষর্থীর ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিনগুলো কাটে অপরাজেয় বাংলা , বটতলা , আমতলা , সবুজ চত্বর , হাকিম চত্বর , ডাস, মলচত্বর , রেজিস্টার ভবন কিংবা কলা ভবনের গোলক ধাধার সমাধান করতে আর পাশাপাশি চলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনন । তবে জ্ঞান তপস্যায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থীর দিনগুলো কাটে সেন্ট্রাল লাইব্রেরী কিংবা সেমিনার লাইব্রেরীর কঠিন দেয়াল ভেঙ্গে উদ্ধাওে মগ্ন থেকে।
আর এভাবেই স্বপ্নময় ছলছল চোখগুলো সমেেয়র পরিক্রমায় ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়ে। পাঠাগারে বইয়ের অভাব ,শ্যাডোতে হ্যান্ড নোটের ছড়াছাড়ি , সেশন জট , মানসম্মত শিক্ষার অভাব , হলগুলোর দুরবস্থার পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতি নামে অপরাজনীতির চর্চার কারণে দ্বিতীয় , তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে । কিন্তু তার মাঝেও দেশের ভবিষ্যৎ হবার সুপ্ত আকাঙ্খা তাদের প্রতিমুহুর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ধাবিত করে । তাইতো প্রায়ই অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শোনা যায় কোন না কোন প্রতিবাদের সুর - ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কখনো বাউলদের দাড়ি কেটে নেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা বিক্ষোভ সমাবেশ বা মানব বন্ধন ।
ধীরে ধীরে এবটু একটু করে সচেতনতা আর দাযিত্ববোধ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস জীবনের শেষ লগ্নে এসে পড়ে । কিন্তু তখনো থামে না আড্ডা কিংবা কোন বন্ধুত্বেও বন্ধন । আর এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলোতে প্রতিনিয়ত লোকমুখের বদল ঘটে পরিবেশের নয় । আর কালের পরিক্রমায় আজো মধুদার কেন্টিনে রাজনীতি নিয়ে আলোচনার আসর বসে। ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে যে মধুদাকে পাক হানাদার বাহিনী নির্মম ভাবে হত্যা করে তার একটা প্রতিমূর্তি আজো মধুর কেন্টিনের সামনে দাড়িয়ে আছে , প্রতি সকালে সেখানে পুজো দেয়া হয় । এই নিয়মের যেমন কোন পরিবর্তন হয় নি তেমনি সেখানে আজো সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের কার্যক্রম নিয়ে বাকযুদ্ধ চলে , আর তার পাশেই মনোযোগী কিছু দর্শকের ভিঢ় থাকে । ভিড় থাকে মিষ্টি ভোক্তাদের ও , তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ; যাদের মধ্যে অনেকেই আসেন মিষ্টির লোভে , অনেকে পুরোনো দিনে ফিরে যেেেত আবার অনেকে নতুন প্রজন্মকে অতীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে । এর পাশাপাশি আমাদের দেশের স্বাধীনতায় মধুর কেন্টিনের অবদান ধারন করে প্রতিনিয়ত তা প্রতিফলিত করছে কেন্টিনের ছদে আকা সেই লাল সবুজ পতাকাটি । এসবের সাথেসাথে স্কংৃতি চর্চার এক ক্ষুদ্র তীর্থক্ষেত্র এই মধুর কেন্টিন । কারণ এর আধ পোড়া গাছটির পাশে প্রায়ই গানের খেলা চলে কিংবা প্রতিধ্বনিত হয় রবীন্দ্র নজরুল বিতর্ক সহ সাহিত্যের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা । আর তা শুনে রেজাউল করিম নামে এক প্রকৌশলী বলেন , এখানে এলে মনে হয় বাংলা সাহিত্যের চর্চা কমে নি বরং বেড়েছে ।
মধুর কেন্টিনের ঠিক বিপরীতে আছে ডাকসু সংগ্রহশালা – যা ইতিহাসের এক নীরব স্বাক্ষী । ডাকসু নিয়ে বিতর্কেও শেষ নাই কিন্তু সবার অন্তরালে নির্জন এই সংগ্রহশালাটি ৫২’ ৬২’ ৬৯’ ৭১’ ৯০’ এর আন্দোলন সহ অনেক ইতিহাসকে সযতেœ লালন করছে । সালাম বরকত রফিকের ব্যবহৃত জিনিস ও ছবি আর পুরানো পত্রিকা খানিকের জন্য হলেও দর্শকে ফেলে আসা ইতিহাসে ফেরত নিয়ে যাবে । আর বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইতিহাসকে জানাতে এখানে রয়েছে বেশ কিছু বই । এই সংগ্রহশালাটি যে কেবল ফেলে আসা দিনের কথা বলছে তা ঠিক নয় বরং আবু বকরের রক্তমাখা নোট খাতাটি প্রমাণ করে ডাকসু সংগ্রহশালা আজকে কথাকেও লালন করছে । সচেতন নেতৃত্ব তৈরীর লক্ষ্য বাস্তবায়নে ডাকসুর কার্যক্রম আপতত ¯থমিত থাকলেও প্রতিসন্ধ্যায় এর সিড়িতে পল্লীগীতির আসর অবচেতনভাবেই তৈরি করছে দেশপ্রেম আর সচেতনতা ।
বদলে যাও বদলে দাও - এর দিনে বদল ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালযের বহু কিছুর যেমন – ডাকসু ১৮ টাকার খাবার এখন ২০ টাকা , ক্যাম্পাস শ্যাডোর নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে ছ্যাকা চত্বর ( নতুন নামকরনের ইতিকথা এখনো অজানা ) ।আর বদলে গেছে ক্যাম্পাস জীবনের ছেলে মেয়েতে বন্ধুত্বেও ধরনটি ও। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইরৈ প্রক্টরের অনুমতি লাগতো আর আজ হরহামেশাই চলছে কথোপকথন আর হাসিঠাট্টা । তাই মেয়েদের সাথে কথা বলতে চাইলে জরিমানা বিষয়ক বিম্ববিদ্যালযের আইনটি আজ ব্যবহার অনুপোযোগী । বিশ্ববিদ্যালযের এমন পরিবর্তন দেখে অনেক সময় ডীন গেটের পাশে দাড়িয়ে কাউকে বলতে শোনা যায় আমাদের সময় তো এমনটা ছিলো না । সত্যিই এমনটা ছিলো না - হলভর্তি গাদাগাদা ছাত্রছাত্রী ছিলো না , নোংরা – ধ্বংসাত্মক ছাত্ররাজনীতির চর্চা ছিলো না , ছিলো না গেস্ট রুম আর ছাড়পোকার যন্ত্রনা ।তবে এসবের পরও শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে হতদরিদ্রসহ সব শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থী দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে ।কারো স্বপ্ন হয়তো মুনীর চৌধুলী কিংবা জহির রায়হান হবেন আবার কারো স্বপ্ন তাদের মত শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসবে । লোকচক্ষুর অন্তরালে অনেকের সেই স্বপ্ন হয়তো পূরণ হয় কিন্তু তাদে সেবা কী পায় এই ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় ? তাইতো এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখে শুনি , একাত্তরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র হয়েই লড়াই করেছিলাম তখন ভেবেছিলঅম স্বাধীন দেশের উন্নয়নে এটি কতো না অবদান রাখবে । কিন্তু আজ যখন উপলব্ধি করি এই জ্ঞানকেন্দ্রটি অনেক অপ্রযোজনীয শিক্ষার্থী তৈরি করছে তখন খুব কষ্ট হয় ।
তবে এতটা হতাশা থাকার পরও সদ্য মাস্টার্স পাশ করা সোহেল মামুন বলেন- গরীব দেশে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয আছে তা অনেক গর্বের। জ্ঞানী হবার যাবতীয় সরজ্ঞাম আছে এখানে তাইতো অনেকে বলে ঢাকা বিশবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরলেই জীবনের অর্ধেক শিক্ষা অর্জন হয়ে যায় ।আর এই কারণেই সুযোগ পেলে তিনি ও দলবল নিয়ে চলে আসেন ক্যাম্পাসে । ওদিকে আবীর আহমেদ চৌধুরী , সম্প্রতি তার শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন । তিনি অবশ্য ৫ বছরের শিক্ষা জীবন সাড়ে ছয় বছরে শেষ করার যন্ত্রনা মনে করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরানো ঘুনে ধরা জ্ঞান চর্চার আসর বলতে দ্বিধা করেননি ।তবে বাস্তবতা যাই হোক ক্যাম্পাসের শিমুল গাছগুলোতে যেমন প্রতিনিয়ত নতুন ফুল ফোটে তেমনি ক্যাম্পাস ও প্রতিনিয়ত মুখরিত হয়ে ওঠে নতুনের আগমনে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জরিয়ে আছে অনেক অপ্রাপ্তি - অনেক হতাশা , তাই বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যা লয়ে স্থান হয়নি তার ।কিন্তু আজও এটি কালের এক নীরব সাক্ষী তাইতো সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ গেরিলা’ সিনেমাটির বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে । প্রয়েজনীয় সুযোগ সুবিধার অভাব , অব্যবস্থাপনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলার গতিকে মন্থর করেছে বৈকি কিন্তু ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে জ্ঞানপিপাসুদের আলাপচারিতা খানিক আশার প্রদীপ জালিয়ে তুলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আবার এটি হয়ে উঠবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ; হয়তো আবারও একদিন বটতলায় স্বাধীণ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মতো করে উত্তোলিত হবে দেশের এগিয়ে যাবার পতাকাটি ।
মেহনাজ হক রকি