অনেক বলার পরেও মিজানকে রাজাকার বানানো সম্ভব হচ্ছেনা!! আরে বাবা, সবাই যদি মুক্তিযোদ্ধা হতে চাস তাহলে হবে কি করে। কাউকে না কাউকে তো রাজাকার হতেই হবে, নাকি?
প্রতি বছরের মত এ বারও ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের হাই স্কুল মাঠে বিজয় মেলা হচ্ছে। মেলায় হাই জাম্প, লং জাম্প, মোরগ লড়াই , বিস্কুট দৌড়, অংক দৌড়, মেয়েদের মিউজিকেল চেয়ার সহ মজার মজার সব খেলা হবে। বিজয়ীদের জন্য বরাবরের মতই থাকছে দারুন সব পুরস্কার। খেলাধুলায় আমি বরাবরই খুবই কাঁচা। তাই পুরস্কার পাওয়ার জন্য সবসময় আমার টার্গেট থাকে “যেমন খুশি তেমন সাজ”। এর আগের দুই বছর সারা গায়ে কাঁদা মেখে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য সেজে আমি আর মাসুদ ফার্স্ট পুরস্কার পেয়েছিলাম, কিন্তু গত বছর আমরা ছাড়াও আরো দুইটা দল ভাস্কর্য সেজে এসেছিল। তাই স্যাররা আমাদের সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়েছে। ফার্স্ট পুরস্কার পেয়েছে একটা মেয়ে। মেয়েটা গ্রাম্য বধু সেজে এসেছিল। এ বছর ফার্স্ট পুরস্কার পেতে আমাদের তাই নতুন পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। মাসুদ আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে।
“মাঠের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আবহ তৈরি করা হবে। মঞ্চের পিছনে পটকা ফুটবে, একদিক দিয়ে ঢুকবে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অন্যদিক দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে ঢুকবে মুক্তিযোদ্ধারা। অতিথি মঞ্চের সামনে এসে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নেবে এবং মঞ্চের বিচারকদের কাছে নিয়ে যাবে”।
মাসুদের প্রস্তাবটা সবার দারুন পছন্দ হয়েছে কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে কেউ রাজাকার হতে চাচ্ছেনা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল মাসুদ রাজাকার সাজবে। আবার ঝামেলা। সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়, কেউ পাকিস্তানি হতে চাচ্ছেনা। আমি মিজানকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, “দেখ দোস্ত, আমার মত হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলেকে পাকিস্তানি হিসাবে মানাবে না। তুই কি সুন্দর লম্বা, ফর্সা। আর শোন আমরা তোকে খুব সুন্দর একটা গোঁফ লাগিয়ে দেব।” গোঁফের লোভে হোক আর অন্য কারনেই হোক মিজান রাজি হল। এবার গো ধরল হাবিব। তার বক্তব্য সে তো আর মিজানের মত সুন্দর নয়। ওর মত কালো একজনকে পাকিস্তানী মানাবে না। আমি বললাম তুই পাকিস্তানী না সাজলে বাদ। বাদ পড়ার ভয়ে সেও রাজি।
মাঠের দুই পাশ দিয়ে আমরা দুই দল ঢুকলাম। মাইকে গুলির শব্দ, মঞ্চের পিছনে পটকার শব্দ স্কুল মাঠে দারুন এক যুদ্ধের আবহ তৈরি করল। সব কিছুই হল অধসাধারণ। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ধরে নিয়ে মঞ্চের দিকে রওনা হলাম। আামি ধরেছি মিজানকে। নিয়ে যাওয়ার সময় আমি মিজানের পাছায় লাথি মারছি। আমাদের আশেপাশের জমে যাওয়া পিচ্চি ছেলেগুলো বেশ মজা পাচ্ছিল। আমি ফাজলামো করে একটা পিচ্চিকে বললাম এটা পাকিস্তানি হানাদার। একে লাথি মার। মিজান অসহায়ের মত আমার দিকে তাকাচ্ছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিচ্চি ছেলেটা হঠাৎই মিজানের পাছায় কষে এক লাথি মারল। আমরা তো থ। অভিনয়ের মধ্যে আছে বলে মিজান কিছু বলতেও পারছে না। যাই হোক, আমাদের অভিনয় শেষ হল। হুম, আমরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফার্স্ট হয়েছিলাম।
আমি বরাবরই এমন। স্কুলে এভাবে আমার কত বন্ধুকে যে মাইর খাইয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এই মুহুর্তে মানিকের কথা মনে পড়ছে। মওলানা স্যারের ইসলাম শিক্ষা ক্লাসে গোলমাল বাঁধিয়ে সটকে পড়লাম, আর ফেঁসে গেল মানিক। তারপর, মওলানা স্যারের বেত আর মানিকের চওড়া পিঠ। আহ, কি মজা। এভাবে মাইদুল (তেলতেলা), সুমন, এমনকি রুবেলকে ফাসিয়ে মাইর খাওয়ানোর কথাও মনে পড়ছে। আবার কখনো কখনো কৌশলে কারও পেছনে দড়ি বেঁধে লেজ বানিয়ে সারা স্কুল ঘোরানোটাও আমার ভীষণ পছন্দের বিষয় ছিল। আর একটা বড্ড বাজে অভ্যাস ছিল আমার, মানুষের আজেবাজে নাম দেয়া, এন.টি, টিটি, খাং.রিং.জং (খারিজ) নাম গুলো কিন্তু আমারি দেয়া।
একথা মনে করার কোন কারন নেই বন্ধুরা আমাকে খুব পছন্দ করত। আন্তরিকতার সাথে জানাচ্ছি, ক্লাসের এমন একটা ছেলেও পাওয়া মুশকিল হবে যার সাথে আমার ঝগড়া হয়নি। আর মেয়েরা???
এইতো সেদিন অনেক বছর পর রাস্তায় ইতি রানির সাথে দেখা হলে কেমন আছে জিজ্ঞাস করলাম। উত্তরে সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ভাল আছি। কিন্তু তুমি মেয়েদের সাথে কথা বল কবে থেকে???!!!
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি কিন্তু স্কুলের আমি থেকে সম্পুর্ণ আলাদা।
যাই হোক, এত ঝগড়া, মারামারির পরও স্কুল লাইফটাই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, স্কুল লাইফটাকেই আজ সবচেয়ে বেশি মিস্ করি। মিসকরি, রুবেল, সুমনের সাথে আযথাই এদিক সেদিক ঘুরে কাটানো সময় গুলো। গভীর রাতে স্কুল মাঠে কিংবা, শহীদ মিনারে বসে চিৎকার করে গান করা। হযরত আর রুবেলের সাথে ব্যাঙ ধরতে গিয়ে অন্য মানুষের মুরগী ধরে আনা। হুম, মিস্ করি আমার স্কুল জীবনের সব বন্ধুদের।
গল্পের পিছনের গল্পঃ মিজান এতদিন মালয়শিয়ায় ছিল, ফিরে এসে নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। শুনলাম, বেচারা এলাকার সব সুন্দরী মেয়ে দেখে শেষ করেছে কিন্তু বিয়ে করার মত কাউকে পাচ্ছেনা। বেচারাকে কেউ হেল্প কর। হাবিব একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করছে। ফুলু বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। মানিক জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে বি.সি.এস ক্যাডার হওয়ার অপেক্ষায় । হযরত আলী দুবাইয়ে। রুবেল একমির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। আমি এগ্রি ভার্সিটি শেষে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর মাঝে মাঝেই একলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুরাতন দিন গুলোর কথা ভাবি আর ক্লান্তি ভুলে নতুন ভাবে রিচার্জ হই। একটা কথা কিন্তু তোদের কোনদিন বলা হয়নি। সারাক্ষন উল্টাপাল্টা ঝগড়া করা এই আমি তোদের অনেক ভালোবাসি। বন্ধু দিবসে, আমার স্কুল জীবনের সব বন্ধুর জন্য দোয়া, তোরা অনেক ভাল থাক, আল্লাহ তোদের সব সৎ আশা গুলো পূরন করে দিক।
ছবি ক্রেডিটঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩০