মাননীয় প্রধান মন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হঠকারিতার সাথে ডঃ ইউনুস সম্বন্ধে যে ভাষায় মন্তব্য করেছেন, নিতান্তই তাঁর অনুগত চামচা ছাড়া আর কেউ তা সমর্থন করবেন না। কিন্তু সেই অজুহাতে ইউনুস সাহেব খালাস পেতে পারেন না। দ্বিতীয় চিন্তায় নরওয়ে যে এন ও সি দিয়েছে, তাও ফেস ভ্যালিউতে নেয়া যায় না, কারণ স্পষ্টত তারা এই ব্যক্তিকে নোবেল দিয়ে এক ঝামেলায় পড়ে গেছে বোধ করছে, এবং বিষয়টি আর এগুতে দিতে চায় না।
ইউনুস সাহেব চাটগাঁয়ের ধার্মিক অথচ সুদখোর স্বর্ণকার দুলা মিয়া সওদাগরের সন্তান, যিনি কর্মজীবনে অনেক মহিলার গয়নাই আত্মসাত করেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের কোন আদর ভালোবাসা কোন সন্তান পান নি। বাবার আদর্শেই সবাই মানুষ হয়েছেন। ইউনুস সাহেবও বাবার মতই এক বুদ্ধিমান, নিজ স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন ব্যবসায়ী ইনস্স্টিংট নিয়ে গড়ে উঠেছেন। তাঁর অন্য দুই কৃতি ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহীম ও মুহাম্মদ জাহাংগীরও আধুনিক যুগে বিকাশমান অর্থনীতির দেশে সব চেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক এন জি ও ব্যবসা করে জীবনে উন্নতি করেছেন।
ইউনুস সাহেব কখনো দান-ধ্যানে বিশ্বাস করেন না। চাটগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের জোব্রা গ্রামের সুফিয়াকে যে তিন চারশ টাকার ঋণ দিয়েছিলেন তা কড়ায় গন্ডায় সুদ সুদ্ধ উসুলও করে নিয়েছেন। তার কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেশ-বিদেশে বিক্রি করেছেন। বছর দুয়েক আগে সুফিয়া অসহনীয় ঋণের ভারে মারা যান। তাঁকে চাঁদা তুলে দাফন করতে হয়। ইউনুস সাহেব কোন খবর নেন নি। অথচ তাঁর দাবি হলো, নরওয়ের টাকা গ্রামীন কল্যান নামের অননুমোদিত সহপ্রতিষ্ঠানে জমা রাখার উদ্দেশ্য ছিল ঋণগ্রহীতাদের সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করা।
ইউনুস সাহেব মানুষের ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙতে পারঙ্গম। তাঁর ব্যাংকের তিনি একচ্ছত্র সম্রাট, প্রতিটি কলকাঠি তাঁর কথাতেই নড়ে। অথচ এখন বিপদে পড়ে বলছেন, 'আমি না, আমি না, বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গ্রামীন কল্যানে টাকা সরিয়ে আবার মূল গ্রহীতা ব্যাংকের কাছে তা ঋণ দিতে '। তিনি ৭২ বছর বয়সেও আইন ভেঙে ব্যাঙ্কের এমডি রয়েছেন। কখনো তাঁর সহকর্মীদের পাদপ্রদীপের আলোতে আসতে দেন নি। ডেপুটি এমডিদের মেয়াদ পূর্তির আগেই বার বার বিদায় দিয়ে দেন যাতে তিনি নিজে নিরাপদ থাকতে পারেন। নোবেল পুরস্কারের বিশাল সফরবাহিনী থেকে তাঁর এককালের দক্ষিণ হস্ত খালিদ শামসকেও সযত্নে বাদ দিয়েছিলেন।
পুরস্কার পাওয়ার পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে (রাষ্ট্রপতির সামনেও), এবং পরে রাজনৈতিক দল গঠনে সাড়া না পেয়ে, এই দুর্বিনীত মানুষটি যে-সব সীন ক্রিয়েট করেছিলেন তা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে।
_____________________________________
পড়ুন আমলা-সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের মূল্যায়নঃ
(ইত্তেফাকঃ ৮ ডিসেম্বর ২০১০)
-----------------------------------------------------------------
ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক
হাসনাত আবদুল হাই
বিতর্কিত হওয়া মানেই মন্দ মানুষ হয়ে যাওয়া না অথবা ভাবমূর্তির বিনষ্টি না। বিতর্কিত হওয়া মানে কেউ এমন কিছু করছে বা বলছে যা সবাই মেনে নিতে পারছে না, যার ব্যাপারে সকল শ্রেণীর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন নেই। এই অর্থে নতুন কিছু করতে গেলে তা যদি সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হয় অথবা গ্রহণযোগ্য বলে মনে না করে সবাই তাহলে বিতর্কিত হবার সম্ভাবনা থাকে।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস যখন অধ্যাপনা ত্যাগ করে দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন তখন তার পেছনে সকল শ্রেণীর সমর্থন ছিল। ক্রমে সেই সমর্থন দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশে বিস্তৃত হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার কর্মসূচী পৃথিবীতে তিনিই প্রথম শুরু করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ক্ষুদ্র আয়ও সীমিত বিত্তের মানুষদের জন্য সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হয় তখন ক্ষুদ্র ঋণের সাহায্যেই স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়াস ছিল। অনেক বছর সেই কর্মসূচী খুব সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়েছে কিন্তু আকারে বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সমবায় সমিতিতে 'শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, অনিয়ম দেখা দেয় এবং গোষ্ঠী স্বার্থের তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। ফলে সমবায় সমিতি তার শক্তি হারাতে শুরু করে কিন্তু তার ওপর যবনিকা পতন হয়নি। এখনো হাজার হাজার সমবায় সমিতি গ্রামাঞ্চলে রয়েছে এবং তাদের সব না হলেও বেশ কিছু সন্তোষজনকভাবে কাজ করছে। ড. ইউনূস সমবায় সমিতির ভাল-মন্দ পরীক্ষা করে দেখেছেন। এর শক্তির দিক যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন, সাপ্তাহিক সভা, নিয়মিত সঞ্চয় করা এবং ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তা সময়মত পরিশোধ করা এসব তিনি জেনেছেন। এর দুর্বলতা যে দলের নেতৃত্বের প্রতাপশালীর ভূমিকা এবং সরকারী কর্মকর্তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ সেই সম্পর্কেও তিনি অবহিত হয়েছেন। সেজন্য তিনি যখন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের নিয়ে ছোট ছোট দল করলেন তাদেরকে সমবায় আইনে নিবন্ধিত করলেন না এবং ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব অর্পণ করলেন দলের সবার ওপর সম্মিলিতভাবে। এখানেই তার গ্রামীণ ব্যাংক 'দলের' সহজ সমবায় সমিতির তফাৎ। এছাড়া আর সবকিছুই (সাপ্তাহিক সঞ্চয়, নিয়মিত সভা ইত্যাদি) সমবায় সমিতির অনুসরণে করা।
ঋণ গ্রহীতা পরিশোধে খেলাপী হয়ে গেলে তার ওপর নানা প্রকারের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের জন্য, ঋণ পরিশোধে উচ্চ হার দেখানোর জন্য কিছুদিন পরই গ্রামীণ ব্যাংক বিতর্কিত হয়ে পড়লো। গ্রামীণ ব্যাংক একটি কৌশল অবলম্বন করলো যা বাণিজ্যিক ব্যাংকও করে থাকে। যারা ঋণ খেলাপী তাদেরকে নতুন ঋণ মঞ্জুর করে সেই ঋণের অর্থ নগদে না দিয়ে তা খেলাপী ঋণ থেকে কেটে রাখা। এর ফলে কাগজে কলমে খেলাপীদের সংখ্যা কমলো কিন্তু আসলে তারা খেলাপীই রয়ে গেলো। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো এভাবে হাল নাগাদ ঋণ পরিশোধ করেছে বলে যাদেরকে দেখানো হলো তারা আয় বৃদ্ধির জন্য হাতে নগদ টাকা পেল না। তাদের ঋণ তাই সুদে-আসলে বাড়তেই থাকলো। একেই বলা হয়েছে ঋণের ফাঁদ। এই ফাঁদ সৃষ্টির জন্য গ্রামীণ ব্যাংক বিতর্কিত হয়েছিল। এই বিতর্ক আরো শক্তিশালী হলো চড়া সুদ আদায়ের জন্য। তবু দরিদ্র ও বিত্তহীন মানুষের কাছে বিশেষ করে গ্রামের মেয়েদের কাছে ঋণ বিতরণে গ্রামীণ ব্যাংক যতটা সফল হয়েছে তেমন আর কোন সংস্থা হতে পারেনি বলে (সমবায় সমিতিও না) ড. ইউনূসকে পুওর ম্যানস ব্যাঙ্কার্স উপাধিতে ভূষিত করা হলো। তিনি দেশে-বিদেশে নন্দিত হলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজি গড়ে তুলে যে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ক্রমে ক্রমে তার কাছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সব দাতা সংস্থাই অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গ্রামীণ ব্যাংকে পুঁজির জন্য আর চিন্তা করতে হলো না। দরিদ্রদের ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া ছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংক নতুন নতুন কর্মসূচী হাতে নেয়া শুরু করলো এই চুক্তিতে যে, এদের মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচন করা যায়। এক্ষেত্রে তার সর্বশেষ কর্মসূচী হচ্ছে 'সোসাল বিজনেস' যার উদ্দেশ্য মুনাফার প্রত্যাশা না করেই পুঁজি খাটানো যেন কর্মসৃষ্টি হয়। উৎপাদন করা যায় এবং এক সময়ে বিনিয়োগকৃত পুঁজি বিনিয়োগকারীরা ফিরে পায়।
শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়াকে দেশে-বিদেশে প্রায় সবাই তার উপযুক্ত স্বীকৃতি মনে করেছে। এর দ্বারা শুধু তিনি সম্মানিত হননি বাংলাদেশের জন্যও সম্মান নিয়ে এসেছেন এমন মনে করা হয়েছে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই ড. ইউনূস ঘন ঘন বিদেশে যেতেন, সভায় যোগ দিতেন নানা ধরনের সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত থাকতেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া পুরস্কার গ্রহণের জন্য। তার অবর্তমানে বাংলাদেশে যেসব কর্মকর্তা কাজ করতেন তারা কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই কাজ করে গিয়েছেন। ড. ইউনূস নেতৃত্ব দিয়েছেন কিন্তু আসল কাজ করেছেন এই বিশ্বস্ত নিষ্ঠাবান, আন্তরিক কমর্ীবৃন্দ। ড. ইউনূস এদের পাদপ্রদীপের সামনে আসতে দেননি। এদের অনেকেই ক্ষোভে-দুঃখে গ্রামীণ ব্যাংক ত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ প্রায় বিতাড়িতই হয়েছেন বলে জানা যায়। শুধু এইজন্য নয়, তিনি নিজ জেলার লোকদের প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে সমালোচনা হয়েছে। একদিকে বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে অন্যদিকে নিজ দেশেই তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমে দানা বাধছে এটা বেশ পাজলিং বা দুর্বোধ্য বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। কয়েকদিন আগে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যতম বৃহৎ পৃষ্ঠপোষক নরওয়ে থেকে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তারপর মনে হচ্ছে দাতা গোষ্ঠীও এখন তাকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করবে। লন্ডন টাইমস লিখেছে : এখন ড. ইউনূসের সুনাম বিপন্ন। 'এটা তার জন্য খারাপ খবর'। খবরটা খারাপ বাংলাদেশের জন্যও। কেননা তিনিই তো এতদিন বাংলাদেশের অঘোষিত ব্র্যান্ড এ্যামবাসাডর ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারীর অভিযোগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই হয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ তাই হতবাক এবং উদ্বিগ্ন। তাদের এখন 'তুমিও ব্রুটাস' বলতে হবে নাকি? ভাবছে অনেকে। সরকারের পক্ষ থেকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হয়েছে, অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে তদন্তের আগেই তাৎক্ষণিকভাবে বলা হলো অনিয়ম কিছু হয়নি তা সঠিক ছিল বলা যাবে না। এখন অবশ্য তারা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে এবং মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের পর তদন্তের কথা বলছেন। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাদের পক্ষ নিয়ে একটি ইংরেজী দৈনিক প্রথম দিন সংবাদটি বস্ন্যাক আউট করার পর (দেশের সব পত্রিকায় খবরটি প্রথম পৃষ্ঠায় হেডলাইন হয়েছিল) থেকে সবিস্তারে জানাচ্ছে যে, তহবিল সরানোর ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। এই পত্রিকাটিও তদন্তের আগেই ড. ইউনূসকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অন্য সব পত্রিকার সঙ্গে তুলনায় এই পত্রিকার এই প্রসঙ্গে মনোভাব ও কার্যকলাপ অবাক করার মত। নরওয়ের সূত্রে প্রচারিত অভিযোগটি খুব সহজ এবং সংক্ষিপ্ত। এই অভিযোগ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অনিয়মিতভাবে অন্য এক সংস্থা, গ্রামীণ কল্যাণে নরওয়ে সরকারের দেয়া অনুদান থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক সূত্র থেকে বলা হয়েছে তহবিল স্থানান্তর করা হয়েছে ঠিকই তবে এটা অনিয়মিতভাবে হয়নি। কেননা বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া গ্রামীণ কল্যাণ ইতিমধ্যে স্থানান্তরিত এই অর্থের সিংহভাগ গ্রামীণ ব্যাংকে ঋণ হিসেবে ফেরত দিয়েছে।
এক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা বলার অধিকার রাখে তহবিল যারা দিয়েছে তারা। নরওয়ের কতর্ৃপক্ষ। তারা বলেছে যে, এই তহবিল দেয়ার চুক্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো সংস্থার কাছে তহবিল স্থানান্তরের উলেস্নখ এবং সুযোগ ছিল না। পরেও এর জন্য তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়নি। সুতরাং তাদের চোখে এই স্থানান্তর অনিয়মের পর্যায়েই পড়ে। নরওয়ের বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত মন্ত্রী বলেছেন, এভাবে তহবিল স্থানান্তর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নরওয়ের থেকে বিষয়টি বিশদভাবে তদন্তের জন্য একটি প্রতিনিধি দল আসছে বলে জানা গিয়েছে। তহবিল স্থানান্তর যদি নিয়ম মাফিক চুক্তি অনুসারেই হয়ে থাকে তাহলে তদন্তের জন্য প্রতিনিধি দল আসতে যাবে কেন? এর উত্তর গ্রামীণ ব্যাংক এবং ইংরেজী দৈনিক থেকে এখনও পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশীদের কাছে কৈফিয়ত তৈরি করে পরিবেশন না করে তারা নরওয়ের তদন্তকারী দলকেই সন্তুষ্ট করার জন্য দিলেই সমীচীন হয়। গ্রামীণ ব্যাংক এবং এই পত্রিকার দেয়া উত্তরে তদন্তকারী দল সন্তুষ্ট হলে বাংলাদেশীদের বলার কিছু থাকবে না। তাদের দুশ্চিন্তাও দূর হবে। বাংলাদেশ সরকারও বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দেশের মধ্যে জনমত সপক্ষে আনার চেষ্টার দিকেই এখন পর্যন্ত বেশী মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। সমস্যা দাতা সংস্থাকে নিয়ে। সুতরাং তাদেরকেই কৈফিয়ত দেয়া উচিত।
তহবিল স্থানান্তরের অভিযোগ থেকে আরেকটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। সংবাদপত্র সূত্রে জানা গিয়েছে যে, ড: ইউনূস নিজেই নরওয়ের কর্তৃপক্ষকে এক পর্বে জানিয়েছেন যে, তাদের প্রদত্ত তহবিলকে করের আওতার বাইরে রাখার জন্যই তিনি গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তর করছেন। এই বিষয়টি তিনি নরওয়ের সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে বলেছেন, কেননা তার ভাষায় দেশে ও দেশের বাইরে তার বিপক্ষে কাজ করে এমন শক্তি রয়েছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে একে সরাসরি কর ফাঁকি দেয়ার ফন্দি বলতে হবে যা দণ্ডবিধি অনুযায়ী একটি অপরাধ। চুক্তির বাইরে অন্য সংস্থায় তহবিল স্থানান্তর করে গ্রামীণ ব্যাংক যদি অনুদান প্রদানকারীর দৃষ্টিতে অনিয়ম করে থাকে, কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে এই কাজ করে গ্রামীণ ব্যাংক একটি অপরাধে অপরাধী হয়েছে যা সরকারকে আমলে না এনে উপায় নেই। তহবিল স্থানান্তরের বিষয়টি তাই গ্রামীণ ব্যাংক আর নরওয়ের কর্তৃপক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশ সরকারও এরমধ্যে জড়িয়ে পড়েছে (আইন প্রয়োগের অর্থে)। সবাই যখন আইনের চোখে সমান তখন ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত হলেও তার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হবে এই মর্মে যে, তার সংস্থা কর ফাঁকি দেয়নি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নরওয়ে থেকে পাওয়া অনুদানের টাকা গ্রামীণ কল্যাণকে দেয়া হয়েছে। গ্রামীণ কল্যাণ পরে সেই টাকার মোটা অংশ গ্রামীণ ব্যাংকে ঋণ হিসেবে 'ফেরত' দিয়েছে। যে নিজেই ঋণী সেই অধমর্ণ হয়ে উত্তমর্ণকে 'ঋণ' দেয় কী করে। এটাও কী কর ফাঁকি দেয়ার আরেক কৌশল? উন্নত দেশগুলোতে দু'বছর আগে যখন সাব-প্রাইম মর্টগেজ লোন নিয়ে একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হতে শুরু করে এবং বিশ্ব অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম হয় তখন ড. ইউনূস সমস্ত ব্যাপারটাকে 'ক্যাসিনো ক্যাপিটালিজম' বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকও যে ক্যাসিনো ক্যাপিটালিজমের ভাইরাসে আক্রান্ত সেটা কী তার অজানা ছিল? ব্যাপারটা তো একই 'দাঁড়ায় ইধার কা মাল উধার' করা কিংবা ইংরেজীতে বললে 'হুইলিং ডিনিং'।
দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের দোয়ায় ও কৃতজ্ঞতার স্পর্শে ড. ইউনূস প্রায় মহামানবের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। এখন যে দেখা যাচ্ছে তার পা মাটির তৈরি (ফিট অফ ক্লে) সেই সংবাদে হতাশায় ম্রিয়মাণ তার ভক্ত ও গুণগ্রাহীরা। যারা তাঁর সমালোচনা করে এসেছে এতদিন তাদের কথা আলাদা। তাদের কাছে তিনি এবার শুধু বিতর্কিত না, উপহাসিতও হলেন। তিনি অনেকদিন তাদের অট্টহাসি শুনতে পাবেন। দুঃখের বিষয় হলো, তিনি এটা এড়াতে পারতেন। গরীব দেশের নাগরিক হয়ে সেই দেশের কোষাগারে কর দিতে অনীহা দেখিয়েছেন, যদি এটা সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারবেন না। তিনি ধীরে ধীরে বেশ বড় মাপের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন (চরিত্রে ঔদার্যের অভাব সত্ত্বেও)। এখন তার উচ্চতা বেশ কিছু কমে গেল। তার শ্রীকাতর অনেক বাঙালী এতে খুশি হবে। কিন্তু দেশের অগণিত গরীব, দুঃখী মানুষ হতাশায় অন্ধকার দেখবে। এটা তাদের পাওনা ছিল না। তারা তার কাছে চিরদিনের জন্য আশার আলো দেখতে চেয়েছিল। এখন থেকে তিনি যাই করুন সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখবে। তারা আরো এই ভেবে অবাক হবে, যে ব্যক্তি কয়েক বছর আগে দেশের রাজনীতিকে দুনর্ীতিমুক্ত করতে যাচ্ছিলেন তাকে এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে কেন?
[লেখক: কথাশিল্পী ও সাবেক সচিব]
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





