সম্ভবত ক্লাস সেভেন-এইটের কথা। নতুন কেনা সিডি প্লেয়ারে দেখার জন্য স্কুলের ছুটি-ছাটা পেলেই একটা করে সিনেমা নিয়ে আসতাম সিডির দোকান থেকে। তখন সিনেমা বলতে বুঝি ইলিয়াস কাঞ্চন-মান্না-জসিমদের ডিসুম-ডিসুম আর রঞ্জিত মল্লিক-মিঠুন চক্রবর্তীদের হার্ডকোর ডায়ালগ। তখনও বিটিভির 'ভাত দে'-'পোকামাকড়ের ঘরবসতি' টাইপ সিনেমায় আমার আমার মন বসেনি। ব্যতিক্রমী ফিল্ম বলতে শুধুমাত্র 'দীপু নাম্বার টু' আর কিছু মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাই। তাও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ভালো লাগার কারণটাও সম্ভবত ছিলো গোলাগুলি। একদিন আগুন জ্বলছে এমন একটা কভার দেখে সিডি দোকান থেকে 'দহন' সিনেমাটা নিয়ে আসলাম। ধুমধারাক্কা টাইপের কোনো সিনেমা দেখার জন্য বসেছি। কী আশ্চর্য, মারামারি-চিৎকার কয়ে ডায়ালগ কিছুই নেই। কিছুক্ষণ দেখার পরে ফরোয়ার্ড করে করে এগোই। যে চাহিদায় কেনা, তার কিছুই নেই। নাহ্ִ, দশ টাকা ধরা খাইছি টাইপ ভাবনায় পেয়ে বসলো। বাবা ডাক্তার, মা নার্সিং সুপারভাইজার। তা হলেও তখন আমার হাত খরচের টাকা দিতো হিসেব করে, গুনে গুনে। আমার বয়সীদের তখন দোকানে গিয়ে মোস্তফা-টেকেন থ্রি ভিডিও গেমস খেলার নেশা, সেকারণেই। তাই তখনকার হাত খরচের টাকা থেকে দশ টাকা বাঁচিয়ে সিডি কেনাটা কম ছিলো না। পরে ওই দশ টাকা উশুল করতেই সিনেমাটা পুরো দেখে ফেললাম। বিরাট এক রুচি পরিবর্তনের আভাস পেলাম। পরিচালকের নাম ছিলো ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেই শুরু।
এরপর তো নেশায় পেয়ে বসলো আর্ট ফিল্মের। ঋতুপর্ণের যে কয়টা পেলাম দোকানে; 'অসুখ', 'চোখের বালি', 'তিতলি' দেখে ফেললাম পরের সপ্তাথের মাঝেই। অর্ডার দিয়ে আসলাম দোকানিকে ঋতুপর্ণের বাকি সব আর্ট ফিল্ম এনে দিতে। উনি ঋতুপর্ণের আর কোনো ফিল্ম দিতে পারেননি তখন তবে সত্যজিত রায়, গৌতম ঘোষ, অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেনদের সিনেমা এনে দিতে লাগলেন। ওই মোটামুটি কমার্সিয়াল সিনেমাকে 'আলবিদা' বলে ফেলা। এখন পর্যন্ত তাইই আছি। মাঝে মধ্যে বাংলাদেশি কিছু কমার্শিয়াল ফিল্ম দেখলেও আগ্রহ শুধুই আর্ট ফিল্মে আটকে আছে সেই থেকে। হিন্দি সিনেমা আমি সারা বছরেও দেখি কি-না সন্দেহ, কিন্তু টলিউডের আর্ট ফিল্ম আর বাংলা গানগুলো শুনি। এবং অস্বীকার করতে কোনো কার্পন্য নেই, একটা সময় এই আগ্রহটা তৈরি হয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্যেই।
এরপর হাতে আসায় 'রেইনকোট', 'অন্তরমহল', 'দোসর', 'আবহমান', 'সব চরিত্র কাল্পনিক' দেখেছি বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ দেখছি 'চিত্রঙ্গদা'। 'চিত্রঙ্গদা'য় শুধু ডিরেক্টর ঋতুপর্ণকে না, অভিনয় শিল্পী ঋতুপর্ণকে দেখলাম। মানুষের মন:স্তাত্বিক দ্বন্দ্ব সত্যজিত রায়ের পর ঋতুপর্ণের মত আর কেউ এভাবে তুলে ধরেছেন বলে আমার মনে হয়নি। অবশ্য আর কেউ নেই বলাটা ঠিক হবে না, থাকতে পারেই। আমি সিনেমাখোর না। তবে আমি যে যৎসামান্য সিনেমা দেখেছি, তাতে আমার সেটিই মনে হয়েছে। হতে পারে সেটা শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত পছন্দের জন্যেই। বাংলা সিনেমায় এত পরিশিলীত সঙ্গীতের ব্যবহারও খুব একটা চোখে পড়েনি আমার। কয়েক মাস আগে ঢাকার এক বন্ধুকে বলেছিলাম, 'বসুন্ধরায় গিয়ে দেখিস তো ঋতুপর্ণের সব সিনেমাগুলোর কোনো কালেকশন পাওয়া যায় কি-না।' ও বলেছিলো, 'এখন কালেকশন পাওয়া যায় নাকি? মারা গেলেই না সব একসাথে করে কালেকশন বের হবে।'
কিছুক্ষণ আগে জানতে পারলাম আজই ঋতুপর্ণ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। সত্যি বলছি, তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পরে যেমন বুকের মধ্যে একটা খালি খালি অনুভূতি তৈরি হয়েছিলো, তেমনটাই হচ্ছে এই মুহূর্তে। একজন বিদেশীর জন্যে এই ধরণের অনুভূতি আমার সহসা হয়নি। ভালো থাকবেন ঋতুপর্ণ। রেস্ট ইন পিস।
আরেকটা কথা, এত অল্প বয়সে কালেকশন তৈরির সুযোগ না দিয়ে গেলেও তো পারতেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু: কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ



ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।