দেশের বাইরে বাংলাদেশির সঙ্গে এক তরুণ পাকিস্তানির দেখা। বাঙালির প্রশ্ন, কেমন আছো তোমরা, মানে তোমরা পাকিস্তানিরা? পাকিস্তানি তরুণের উত্তরঃ 'একাত্তরে তোমাদের সঙ্গে যে নৃশংসতা হয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত এখন আমরা করছি নানাভাবে। মিডিয়ার মাধ্যমে তোমরা তা দেখতে পাচ্ছো।' না, সকল পাকিস্তানির বিশ্বাস এ রকম নয়। তবে তরুণদের মানসিকতা তুলনামূলক ইতিবাচক।
পাকিস্তান যে এদেশে ফাঁসি হওয়ার পরপর নানা বিবৃতি দিচ্ছে, এটা আমলে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। ওরা রাস্তায় মিছিলও করছে। তা করুক। পুরনো বন্ধুদের জন্য কিছু একটা তো করতে হয়, তাই তা করা। আবার আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক কানাঘুষা সম্পর্কে যাদের নূ্যনতম ধারনা আছে, তাদের অজানা নয় যে, অন্তত সাকার সঙ্গে পাকিদের সম্পর্ক পূর্ব থেকেই গভীর। দ্বিতীয়ত, সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি মানে একাত্তরকে খুঁড়ে তোলা, যা পাকিস্তান প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায়। পুরনো ক্ষত কেই-বা খুঁচিয়ে বেদনার্ত হতে চায়! তৃতীয়ত, হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের দহরম-মহরম সম্পর্ক। বিরোধীদের বিচারের (বিনাশের) মাধ্যমে হাসিনার হাতই শক্তিশালী হচ্ছে, যার নীট লাভ একান্ত ভারতের। তাই থেকে থেকে একটু জানান দেওয়ার চেষ্টা, মৃতপ্রায় পাকিস্তানের গোঙানি!
পাকিস্তানের কিছু করার থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে আড়ালে-আবডালেও করতে পারতো। যেমন ধরুন, সৌদি সরকারের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে পাকসেনারা। পাকিস্তানের সদিচ্ছা থাকলে সে-সূত্র ধরেই হাসিনা সরকারকে জব্দ করার চেষ্টা করতে পারতো। তা হয় নি। সৌদি সরকারের বক্তব্যও ছিল এমন যে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরা নাক গলাবে না। শীতল কানাঘুষায় ভেসে বেড়ায় যে, গো-আজমের জন্য সৌদির সামান্য একটা রেকুয়েস্ট ছিল। তা তো রক্ষা পেলই। তা না হলে অপরাধের শিরোমণি বেঁচে যায় কীভাবে?
তুরস্কও সামান্য তৎপরতা দেখানোর চেষ্টা করেছে। আমার মনে হয়, একাত্তরের ব্যাপারে, বাংলার মানুষের চেতনার ব্যাপারে তারা অসচেতন। অবশ্য, 'একে' পার্টিও তো শেষ পর্যন্ত মোল্লাদের সমাবেশ। তাই অপরিপক্ষ বক্তব্য ও আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর বাইরে যাদের আওয়াজ শোনা যায় বা গিয়েছে, তারা বসন্তের কোকিল। টাকার বাউল বাতাস আছে তো কুহু কুহু ডাক আছে, তা না হলে, সুনসান নীরবতা। তাই কারো কুহু রবে লাফিয়ে বা তেতে উঠার খুব বেশি প্রয়োজন নেই।
সাইয়েদ কুতুব ফাঁসির পরেও বেঁচে আছেন এবং থাকবেন। কারণ, তাঁর ঘিলু ছিল। তাঁর চিন্তা, চেতনা ও তৎপরতা শুধু মিশরকে ঘিরেই আবর্তিত হত না। দেশ-কাল পেরিয়ে সুদূরের অভিযাত্রী ছিলেন তিনি। আমাদের যে কয়জনের ফাঁসি হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে, তারা বাংলার আলুলায়িত আলো-বাতাসে বড়ই কাতর ছিল। স্বপ্ন ছিল যে কোনোভাবে এর রঙ-রস চিবিয়ে খাওয়া। তা পূরণ হয়েছে। এমনকি বড় রকমের রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেলেও তাদের প্রাপ্তিতে চিড় ধরে নি। আবার দেশ-কাল অতিক্রমী কোনো বিবেক ও মেধা তাদের ছিল না। তাই বিধির বিধান তাদের এই অবিমৃষ্যতাকে মেনে নিতে পারে নি। মুখ ব্যদান করে তাদের গ্রাস করে ফেলে। এখন যা হছে, দেশে এবং বিদেশে, তা খাবারের পর ঢেকুর তোলার মতো।
একে একে ফাঁসি হতে চলেছে। যাদের পক্ষে ক্ষয়, তাদের প্রতিক্রিয়াটা একটু বেশিই হবে, কথা-বার্তায়ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হতে পারে। এ নিয়ে টেনশন করার কিছু নেই। সবচে' বড় কথা হল, দীর্ঘ দিনের আবর্জনা-জঞ্জাল সরে যাচ্ছে। তাই যারা এই বিচারের প্রত্যাশী, তাদের উচিৎ আত্ম-তৃপ্তিতে না ভোগে, গঠনমূলক কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া। বিচার পরবর্তী সময়ে দেশ যেন আত্মকলহের আবর্তে না পড়ে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকা।
একাত্তরে দেশটার উপর দিয়ে বড় একটা ধকল গেছে। সে ধকল শেষ হতে না হতে নির্বোধ ও আবাল লাল ঝান্ডার উৎপাত শুরু হয়। সোভিয়েত বলয়ের সাহায্যে পাকিস্তানের জটর থেকে বের হওয়া নতুন দেশকে আমেরিকান বলয় মেনে নিতে পারে নি। আবার পুরোপুরি কব্জায় নিতে না পেরে সোভিয়েত-ভারতেরও স্বস্তি ছিল না। অভ্যান্তরীণ শত্রু তো উঁৎ পেতে ছিলই। সকল অপশক্তির সম্মিলনে ৭৫-এর শোকাবহ ঘটনা।
এরপর তো পুরনো সেই মানবরূপী দানবদের তুমুল চিৎকার! মনে হচ্ছিল, অসুররা-ই পৃথিবীতে জয়ী হয়, স্থায়ী হয়। অনেক ঘোর পথে এসে শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে, বিধির বিধানই শক্তিমান এবং জয়ী। তবে বিধির বিধানের পথ বেশ এবড়োখেবড়ো এবং বন্ধুর। সে পথে চলার জন্যে যে অনুশীলনের প্রয়োজন, তা পূর্বে যেমন কারো ছিল না; এখনও নেই। তাই ভয় হয় মাঝে-মাঝে, শঙ্কার দোলা প্রাণে ভীষণ আঘাত করে।
না, প্রাণ হরণে কোনো কৃতিত্ব নেই। কিন্তু বিচারের বেলায় দয়ালু হলে জগৎ টিকবে না। দণ্ডের কঠোরতায় যখন বিচারকের মনে বিষণ্নতা দেখা দেয়, সেটা-ই আসল বিচার। এটা কোনোক্রমেই প্রতিশোধ নয়। আজ যারা বিধির বিধানে 'স্বজন' হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, তারা একটু সেই একাত্তরের দিকে চোখ রাখুন। সে সময়ে স্বজন-হারানো মানুষদের কথা একটু ভাবুন। আর নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, তাদের প্রতি আপনার কোনো সহানুভূতি কাজ করে কি না, কখনো করেছে কি-না? আপনার হারানো (ফাঁসিকাষ্টে ঝোলা) সেই 'স্বজন' সন্তপ্ত সেই মানুষদের জন্য কী করেছেন, সে ব্যাপারে আপনাদের কী বলেছেন, একটু স্মরণ করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৯