
গত কয়েকবছর ধরেই ভারতীয় সংস্কৃতির সবই এড়িয়ে চলি। তাদের মুভি, গান, অনুষ্ঠানাদী কোন কিছুই দেখি না।
দৃশ্যম মুভিটা দেখে অনেকেই সাজেস্ট করলো এটা দেখার জন্য, মুভিটা অনেক ভালো, আমি নাকি দেখে মজা পাবো। আমার মত মানুষের জন্যই নাকি বানিয়েছে এটা।
এত এত মানুষের প্রশংসা শুনে দেখার আগ্রহ হল। একদিন ঘুম আসছিলো না দেখে মুভিটা ডাউনলোড করে দেখতে বসলাম। প্রথম দিকে দেখে খুবই বিরক্ত লাগছিল। আর ঘুমও লাগছিল। জোর করেই কিছুটা বসে ছিলাম। পরে বিরক্তির চূড়ান্ত মাত্রায় এসে যখন দেখব না সিদ্ধান্ত নিলাম, তখনই কাহিনীটা ভাল লাগা শুরু করলো।
কাহিনীটা একটু বলি,
মুভির মূল চরিত্রটি হল বিজয় সালগাওঙ্কার। চরিত্রটিতে পর্দায় ফুঁটিয়ে তুলেছে অজয় দেবগণ।
বিজয় ছোট থাকতেই তার মা-বাবা মারা যায়। পড়ালেখাও বেশি করা হয়নি। এখানে সেখানে কাজ করে গোয়ার এক এলাকায় কয়েকবছর পর নিজেই ব্যবসা শুরু করে। ক্যাবল নেটওয়ার্কের অপারেটর হয়। সিনেমা দেখার পোকা। দেশি-বিদেশী সবধরনের মুভিই দেখে। বলতে গেলে তার শিক্ষার পুরোটাই সে সারে মুভি দেখেই। মুভিগুলো থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে নিজের জীবনে খাটায়।
এলাকায় তার বেশ নাম-ডাক ছিল। এলাকার সবাইকেই সে সাহায্য করতো, নাম-ডাকটা হয়েছে সে জন্যেই। কারো সাথে ঝামেলায়ও জড়াতে যেত না। শুধু স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের এক পুলিশের সাথে সমস্যা হত। ঐ পুলিশ ছিল দুর্নীতিবাজ। আর বিজয় ছিল ন্যায়-নিষ্ঠাবান।
জীবনের শুরুর দিকে কষ্ট করে ধীরে ধীরে বেশ সুখে শান্তিতে চলার মতই সঞ্চয়ও জমিয়ে ফেলে। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে বেশ সুখেই ছিল। শুধু একটু বেশিই হিসাব মেনে চলতো। অযথা খরচটা ছিল করতে চাইতো না। যেমন - কাপড় বেশি দাম দিয়ে কিনলেও যে কয়দিন পড়বে, কম দামে কিনলেও সেই কয়দিনই - তাহলে কম দামিই তো ভাল। বড় রেস্টুরেন্টে খেলেও পেটেই যাবে, সাধারণ হোটেলে খেলেও পেটেই যাবে - তাহলে সাধারণ হোটেলই তো ভাল।
এটার জন্য স্ত্রী-সন্তানরা তার উপর একটু অসন্তুষ্টই থাকতো। অবশ্য তারা কিছুর আবদার করলে বিজয় মানা করতো না। প্রথমে যাই বলুক, পরে মেনে নিত সেও।
আসল ঘটনাটার শুরু আসলে তখন থেকেই।
তার বড় মেয়ে আঞ্জু ন্যাচার ক্যাম্পের জন্য তার স্কুল থেকে নির্বাচিত হয়। বিজয়ও শুনে বেশ খুশি হয়। কিন্তু আঞ্জুর মা নন্দিনী তাকে যেতে মানা করার কথা শুনে বলে, সত্যিকারের জ্ঞান তো বইয়েই থাকে না - বাইরে থেকেই অর্জন করতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। পরে তাকে জানানো হয় যে, এটার জন্য আলাদা ফি দিতে হবে - তখন সেও আমতা আমতা শুরু করে। পরে অবশ্য দেয়ও।
কাহিনীটার শুরু এখান থেকেই। আঞ্জু ক্যাম্পে থাকাকালীন সামির নামের এক ছেলে তার ফোনে আঞ্জুর ছবি তোলা নিয়ে যন্ত্রণা করা শুরু করে। সারাক্ষণই ছেলেটা আঞ্জুর পিছনে আঠার মত লেগে থাকতো। ঐখান থেকে আসার পর অবশ্য আঞ্জু সব ভুলেই যায়।
কিন্তু হঠাৎ একদিন সামির এসে হাজির আঞ্জুর সামনে। আঞ্জু প্রথমে অবাক হয়, পরে কুশালাদি জিজ্ঞেস করে। জবাবে সামির আঞ্জুকে একটা ভিডিও দেখায়। ভিডিওটা হল আঞ্জুর গোসল করার। ভিডিওটা দেখে আঞ্জু বলে এটা ডিলেট করে দিতে।
তখন সামির ব্ল্যাক মেইল শুরু করে। ডিলেট করবে, কিন্তু এটার বিনিময়ে সে যেটা চায় তাকে সেটা দিতে হবে। সে রাতে আঞ্জুদের বাসার পিছনে থাকবে, ওখানে দেখা করতে বলে।
আঞ্জু ভয় পেয়ে যায়। লজ্জায়ও। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে। তার মা জানতে চাইলে, প্রথম বলতে না চাইলেও পুরোটা খুলে বলে।
পরে সামিরকে বাইরে থেকে সে বাসায়ই নিয়ে আসে। বাসায় আসার পর সামির দেখে আঞ্জুর মাও দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে সে ভাবে, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু পরে নন্দিনীও তার কাছে ক্ষমা চাইলে, ভিডিওটা ডিলেট করে দিতে বললে ও তার মেয়ের ক্ষতি না করতে বললে তার মাথায় শয়তানী বুদ্ধি খেলে। সব কথাই সে মেনে নিল। কিন্তু শর্ত স্বরূপ নন্দিনীকে এক বাজে প্রস্তাব দেয়।
আঞ্জুর মাথা এটা শুনে একদম এলোমেলো হয়ে গেল। সামির হাতের মোবাইলটাই এখন বিপদ তার ও তার মায়ের জন্য। মোবাইলটাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারলেই ঝামেলা শেষ। সেটার জন্য একটা রড নিয়ে সামিরের পিছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো। যেই না রডটা দিয়ে আঘাত হানতে যাবে, তখনই সামির হাতটা উপর থেকে নিচে নামিয়ে ফেলে এবং রডের বাড়িটা গিয়ে লাগে সামিরের মাথায়। তৎক্ষণাৎ মরে যায় সামির। এরপর মা মেয়ে দুইজন মিলে সামিরকে বাড়ির উঠানে কম্পোষ্ট সারের জন্য মাটি খুঁড়ে রেখেছিল বিজয় - ওখানে পুতে দিল সামিরকে।
বিজয় আবার রাতে বাসায় থাকে না। ক্যাবল নেটওয়ার্কের অফিসেই থাকে। সকালে বাসায় এসে ঘরে মাটি ও নন্দিনী-আঞ্জুর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে জানতে চায় কী হয়েছে। সব তাকে খুলে বলা হয়। একজন ন্যায়-নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে তার এখন দায়িত্ব দুইটা - এইটা পুলিশকে জানানো, আরেকটা তার পরিবারকে বাঁচানো। পরিবারের চেয়ে তার কাছে কিছুই নেই। সে পরিবারকে বাঁচানোর সিদ্ধ্বান্তই নেয়।
এরপরই বিজয় দেখায় তার বুদ্ধির খেলা। চমৎকারভাবে অ্যালিবাই তৈরি করে। সে জানে, পুলিশ তদন্ত করতে করতে একসময় তার কাছে পৌছাবেই। কারণ, সামির হল গোয়ার আইজির একমাত্র ছেলে। বলতে গেলে, পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকেই তার সামলাতে হবে।
যে পুলিশের সাথে তার ঝামেলা ছিল, বিজয় তো তার কাছে নাম্বার ওয়ান অপরাধীই। কারণ, সে ই বিজয়কে সামিরের গাড়িতে উঠতে দেখেছিল। সাথে আরো দুইজন থাকলেও তারা দেখতে পারেনি, কে গাড়িতে উঠেছে। সব পুলিশের কাছে নিখোঁজ সামিরের ও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল নিখোঁজের আগে - এই খবর পাঠানো হলে সে বিজয়ের কথা বলে। শুরু হয় তদন্ত। অন্যান্য পুলিশরা অবশ্য বিজয়কে অপরাধী মানতে নারাজ ছিল। কিন্তু আইজির কানে খবর পৌছালে সে বিজয়কে পুরো পরিবার সহ ধরে আনতে বলে।
বিজয়ের প্ল্যান শুরু হয় তখন থেকেই। তার পুরো পরিবারকেই আগে থেকে ট্রেইনিং দিয়ে আনে যে, পুলিশের সামনে ঘাবড়ানো যাবে না - ঘাবড়ালেই পুলিশ সন্দেহ করবে। মিথ্যাও বলতে মানা করে - সবই সত্য বলবে। আর সবাইকে একই উত্তর দিতেও মানা করে। একই প্রশ্নের উত্তরে একেকজন একেকটা বললে পুলিশ বুঝতে পারবে না তারা আগে থেকে প্ল্যান করে এসেছে। পুলিশ উলটাপালটা প্রশ্ন করতে পারে - কিন্তু ঐসময় তাদেরকে স্ট্রিক্ট থাকতে হবে। পুলিশকে কখনো বুঝানো যাবে না, তারা ভয় পাচ্ছে।
পুলিশের মাথা ঘুরাচ্ছে। বিজয় একটা কাহিনী সাজিয়েছে বলে ধারণা করে - ঐটাই তাদের সামনে ভিজুয়ালাইজ করছে। একটা সময় এটার প্রমাণও পায়। শুধু পুলিশের সাথেই না - অ্যালিবাইদেরকেও একটা ভিজুলাইজেশনের মাঝে নিয়ে আসে বিজয়। কাউকেই সে আসল কথাটা বলেনি, এমনকি কাউকে অনুরোধও করেনি - স্ট্যাটমেন্টে এসব বলতে হবে; তবুও সে তার কাজ আদায় করে নিচ্ছিল ভিজুলাইজেশনের মাধ্যমে। সবাই সত্যি কথা বলেছে - কিন্তু কারো সত্যি কথাতেও সামিরের নিখোঁজের রহস্য জানতে পারে না পুলিশ।
পারফেক্ট একটা প্ল্যান ছিল। একটা সময় আইজি রেগে গিয়ে মারধরই শুরু করে বিজয় সহ তার পুরো পরিবারকে। কিন্তু বিজয় এটার জন্য সবাইকে তৈরিই করে রেখেছিল মানসিক ভাবে। যতই মারুক তারা কেউ যেন, মুখ ফসকেও কিছু না বলে। সামিরের ভিডিও করার কথাও যেন না বলে। ভিডিওটা এখন নেই, চিন্তার কারণও নেই। সেইটা বলারও দরকার নেই। বিজয়ের প্ল্যান পুরোটাই সফল হচ্ছিল, কিন্তু শেষে তার পাঁচ বছর বয়সী ছোট মেয়েটা মারের ভয়ে বলেই দেয় সত্যটা।
এরপরই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় নি। কেন হয়নি সেটা মুভিতেই দেখুন আপনারা। এটা আর স্পয়েল করবো না।
তবে মুভিতে একটা ব্যাপার বুঝানো হয়েছে, অভিভাবক মানে অভিভাবকই। সন্তান অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু শাস্তি দিয়ে তার জীবন নষ্ট করে দেওয়া অভিভাবকের কাজ না। খুব বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেললে অভিভাবককেই সাথে থাকতে হয়। তাকে বাঁচানোর পুরো দায়িত্বটাই অভিভাবকের। এটা একটা সচেতনতা মূলক মুভিও ছিল, অভিভাভকের যেমন বাঁচানোর দায়িত্ব - তেমনি বিপদে যেন সন্তান না পড়ে সেটার দিকেও খেয়াল রাখার দায়িত্ব তাদেরই।
এরকম চমৎকার একটা ক্রাইম-মিস্ট্রি থ্রিলার। ভারতে যে এইরকম কাহিনীর একটা মুভি বানানো হবে - সেইটা ভাবিনি কখনোই। তাদের সব রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ সৃষ্টিই থাকে অন্যের থেকে ধার নেওয়া বা চুরি করা। আর যেগুলো মৌলিক থাকে, সেগুলোও খুব একটা ভাল হয় না। [এমনকি থ্রি ইডিয়টসও মৌলিক মুভি না - মুভির বেশির ভাগ দৃশ্যই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফানি ভিডিও থেকে কপি করা। মেইন থিমও নিজস্ব নয়।]
সেই জায়গায় দৃশ্যমের মত মুভি - সত্যিই অসাধারণ। এত থ্রিলিং মুভি এই বছরে আর দেখি নাই।
ঘুম নিয়ে মুভিটা দেখা শুরু করে ঘুমে ঢুলঢুল করলেও, থ্রিলিং ভাবটা পাওয়ার পর - ঘুম একদমই উবে গিয়েছিল।
আশা করবো, বাংলাদেশেও এরকম থ্রিলিং একটা মানসম্পন্ন মুভি খুব দ্রুতই দেখতে পাব।
[স্পয়লার দেওয়ায় দুঃখিত আমি। আমি আসলে পুরোটা না লিখে পারছিলামও না।]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



