প্রথম ভাগ
মধ্যভাগ
একাদশ
আট বছর পর দেশে ফিরলো আনিস! একজন স্বপ্নাতুর মানব হিসেবে অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ থেকে গিয়েছিল সে, ফিরে আসলো একজন সফল মানুষ হিসেবে! রোবটিক্সের জগতের বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে সে! তার আবিষ্কৃত ফর্মুলা রোবটিক্স নামক জটিল বিষয়টাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে! নেই তৈরিতে সেই আগের মত খুব খাটুনীরও!
এয়ারপোর্টে রঞ্জু তার অপেক্ষাতেই দাড়িয়েছিল! দীর্ঘদিন পর বন্ধুকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নিল! কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো! প্রফেসর হামিদ গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগেই! কবর জিয়ারত করে রঞ্জুর মাধ্যমে কেনা বাংলাদেশে তার ফ্ল্যাটটায় উঠলো আনিস! বাংলাদেশে তার নামডাক বেশ ভালোই! প্রতিদিনই সাংবাদিকরা আসছে তার সাক্ষাৎকার নিতে! অনেকেই আসছে তাকে অভিনন্দন জানাতে! বজলু ভাইও আসলো! তাকে অভিনন্দন জানালো! আনিস তাকে যেভাবে ফুল দিয়ে ধন্যবাদ দিয়েছিল, বজলু ভাইও ফুল দিয়ে আনিসের কাছে পূর্বের ঘটা ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইলো! হাসাহাসি চলল!
বাংলাদেশে বেশিদিন থাকবে না আনিস! আবার চলে যেতে হবে! দেশটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না! কিন্তু যেতে তো হবেই! দেশে আসলো পাঁচ-ছয়দিন হল! এর মাঝে বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাকে! আজকে কিছুটা ফুসরত মিলল প্রানভরে দেশের বাতাসটা অনুভব করার! ভোরে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাড়িটাকে! নীচে একটা চমৎকার ফুলের বাগান! কিছুক্ষনের মাঝেই বৃষ্টি শুরু হল! গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি! বিরক্ত তার আগে এই বৃষ্টিটাকে! কিন্তু এত বছর পর এই বৃষ্টিটাকে তার বড়ই আনন্দময় মনে হচ্ছে! গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটায় ভিজছে সে! নীচে তাকিয়ে দেখে ফুলের বাগানে একটা দশ-বারো বছর বয়েসী বৃষ্টিতে ভিজেই হাটতে হাটতে ফুলেদের সাথে কথা বলছে! দৃশ্যটা দেখে তার আট বছর আগের এমনই এক দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল! মনে পড়ে গেল সেই দৃশ্যে থাকা মেয়েটির কথাও! সেই ছাঁদ, সেই চিলেকোঠা, সেই মানুষগুলোর কথা! সে একদমই অকৃতজ্ঞের মত ভুলে গিয়েছিল তাদের কথা! দেশ থেকে যাওয়ার আগেও বলে নি! বাইরে গিয়ে মনেই ছিল না তাদের কথা! এই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটা না পড়লে হয়তো মনেও পড়তো না কখনো! কানে একটা গানের কয়েকটা লাইন বেজে উঠল।
‘Here comes the rain again
Falling on my head like memory
Falling on my head like new emotion’
ইমোশন! মেমোরী! আবেগ! স্মৃতি!
আবেগের কারনে মনে হল মেয়েটিকে! স্মৃতিতে মনে পড়লো সেই মেয়েটি তাকে একটা ডায়েরী দিয়েছিল! ডায়েরীটা সে পড়েনি কখনও! কিন্তু কখনও হাতছাড়াও করে নি! সবসময়ই রেখেছে নিজের সাথে! রুমে গিয়ে ডায়েরীটি বের করল!
ভিতরে অনেক লিখা! অনেকদিন ধরেই ডায়েরীটি লিখছিল মেয়েটি! অবাক হল, ডায়েরীটায় শুধু তাকে নিয়েই লেখা দেখে! হাতের লিখা অনেক সুন্দর! লিখার সময় যে হাত কাঁপছিল ঐটাও বুঝতে পারলো সে! শুরুর দিন থেকে শুরু সে আসার দিন পর্যন্ত ঘটা প্রতিটা ঘটনার কথা লিখা ডায়েরীটায়! পড়তে পড়তে কখন যে আনিসের চোখের কোণে পানি এসে গেল আনিস নিজেও জানে না! ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠায় একটা আলাদা কাগজে লেখা একটা চিঠি! খুবই দ্রুত লিখেছে! কিন্তু লেখায় কোন কাঁটাছেড়া নেই! চিঠিটা পড়া শুরু করল আনিস!
‘আনিস ভাই,
নামের আগে সম্ভাষন হিসেবে অনেকেই অনেক কিছু লাগায়! কেউ প্রিয়, কেউ শ্রদ্ধেয় ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু আমি না খুবই দুঃখিত যে কিছু লাগাতে পারছি না! আশা করি কিছু মনে করবেন না এতে! তবে রোবট লাগাতে চেয়েছিলাম – কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আর লিখি নাই ঐ শব্দটা!
কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি রোবট না! জানি না কারনটা কি – তবে আপনি যে মিথ্যা বলে এই বাসা থেকে চলে যাচ্ছেন সেটা কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি! আপনি এই বাসা না আসলে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আমাকে। ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কথাটা মানাচ্ছে না! আসলে পালাতে চাচ্ছেন আমার কাছ থেকে!
রাতে আপনাকে যতগুলো কথা বলেছি সব মিথ্যা! আপনি রোবট না! আপনারও মন আছে! ভোর ছাঁদ থেকে যখন আমাকে দেখছিলেন তখনই বুঝেছি সেইটা! সেই মনটা যে আমার কথাগুলোর জন্য অনেক খারাপ হয়েছে আমি জানি! কিন্তু করব বলুন, আপনার রোবটিক আচরনটা আর সহ্য করতে পারছিলাম! সেই জন্যেই রেগে গিয়ে বলে ফেললাম! আপনি মন খারাপ করবেন জানলে ঘুনাক্ষরেও বলতাম না কথাগুলো! আমাকে ক্ষমা করবেন!
চলে যেতে যাচ্ছেন! যেতে মানা করব না! আপনার অনেক স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নগুলো সফল হোক! মনেপ্রানে এইটাই চাই!
রাতে বলেছিলাম, ‘সেই মেয়েটি কে জানেন? সেই মেয়েটি আমি!’ অনেক রাগ নিয়ে বলেছিলাম! কিন্তু কথাটা আমি বলতে চাচ্ছিলাম খুব নরম সুরে, মাথা নীচু করে, লজ্জায় গাল লাল করে! কিন্তু সবার সব স্বপ্ন তো আর পূরন হয় না! কিছু কিছু অপূর্নতা থেকেই যায়!
একটা কথা না বললে, আমি কোনদিনই শান্তি পাব না! কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না! এইটাও জানি না যে কথাটার সত্যতা কতটুক! কিন্তু এই মুহুর্তে এই কথাটা ছাড়া আমি আর কিছুই বলতে পারছি না!
‘আপনাকে ভালবাসি!’ কথাটা কত লজ্জার! কিন্তু দেখেছেন কতটা নির্লজ্জ আমি! কোনরকম কাটাকাটি না করে কত সুন্দর করে লিখে ফেললাম! এই নির্লজ্জ মেয়েটার কান্ডটায় রাগ করবেন না! আর আমি এইটার জন্য ক্ষমাও চাইবো না!
ভালো থাকবেন! ভাল করে পরীক্ষা দিবেন! নিজের শরীরের যত্ন নিবেন! ওষুধের কোর্স এখনো শেষ হয়নি, সময়মত খেয়ে নিবেন!
ইতি,
ম আকার দ হ্রস্ব ই কার হ আকার! মাহিদা!
উহু! মাদিহা!
নিজের নাম নিজেই ভুল করলাম!’
চিঠিটা পড়ার চোখের পানি গাল বেয়ে নামা শুরু করল আনিসের! পুরুষদের কাঁদতে নেই, কিন্তু এই মুহুর্তে চোখের পানি যে আঁটকাতে পারছে না!
বৃষ্টি কমে নি! বরং আগের চেয়ে বেড়েছে! এই বৃষ্টির মাঝেই যত দ্রুত সম্ভব গেল ‘মাহিদা ভিলা’য়! গেটের দারোয়ান পাল্টেছে! এখনের দারোয়ানটা তাকে চিনছে না! নিজের পরিচয় দেওয়ার পর চিনেছে! দারোয়ানের সাথে আলাপ করতে করতেই একটা মেয়েকে দেখল গেটে! মেয়েটাকে পরিচিত লাগছে অনেক! মস্তিষ্ক একটু হাত বুলাতেই মনে পড়ল মেয়েটা কে? জরি! যাকে মাদিহা ডাকতো অপ্সরী বলে!
‘অপ্সরী?’ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো আনিস!
‘আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আর আপু ছাড়া এই নামে সবাই ডাকেও না আমাকে!’ মেয়েটার মুখের ভাষা একদম স্পষ্ট! আগের মত উচ্চারনে সমস্যা হয় না! অবাকও হয়েছে অনেকটা!
‘আমাকে চিনলে না? মনে করে দেখো তো!’
‘উহু চিনলাম না!’ মাথা নাড়ালো অপ্সরী! একটু পর আবার তার চোখে আলোর ঝিলিক দেখা গেল! মনে করতে পেরেছে! ‘চিনেছি! আপনি রোবট ভাইয়া!’
‘হাহাহা! এইতো চিনেছো!’ আনিস হাসলো!
অপ্সরীর সাথে অনেকক্ষন কথা হল আনিসের! মোবারক সাহেবের মৃত্যুর কথা, মাদিহা কিভাবে তাকে এমন আধুনিকা বানিয়েছে সেটার কথা! আরো অনেক কথাই! শুধু দুইটা কথা জানতে পারে নি! মাদিহা এখন কোথায়! আর তার বিয়ে হয়েছে কিনা! জিজ্ঞেসও করতে পারছে না! অপ্সরী একটানা বক বক করেই যাচ্ছে! একটা সময় আনিস না পেরে মাদিহা এখন কোথায় আছে তা জিজ্ঞেস করেই বসলো! অপ্সরী জানানোর পর একমুহুর্তও দেরী না করে চলে গেল মাদিহার ঠিকানায়!
দ্বাদশ
অর্ধেক পথে গিয়ে থেমে গেল আনিস। এখন গিয়ে কী বলবে সে মাদিহাকে?
আটবছর আগে মেয়েটা তাকে অন্ধভাবে ভালবাসতো। তখন যদি সে সেটা ধরতে পারতো তাহলেই তো আজকের এই দিনটি তৈরি হত না। কিন্তু পারে নি।
আটবছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সে নিজেও পাল্টেছে আগের থেকে। মাদিহাও তো পাল্টাবে। সময়টা তো অনেক বড় ছিল। মাদিহা তাকে এখনও ভালবাসে কিনা সেটাও জানেনা।
মনে একটা ক্ষীণ আশা আছে। কিন্তু সে যে মেয়েটাকে এত কষ্ট দিয়েছে, তারপরও তাকে কী করে ভালবাসবে মেয়েটা?
হয়তো বাসে এখনো ভালই, কিন্তু সমাজের গতির সাথে তাল মিলিয়ে তো তাকেও আগাতে হবে। এখন হয়তো বিবাহিতা সে অন্য কারও? অপ্সরীকে এইটা না জিজ্ঞেস করে ভালই করেছে। জিজ্ঞেস করলে একটা নির্দিষ্ট উত্তরই জানতো। এখন দুটোই জানে। তার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে ভেবে নিতে পারবে। জানলে তো আর পারতো না। বিয়ে করে ফেললে, এখন তাকে গিয়ে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিলে - তারই কষ্ট বাড়বে। এটা আনিস চায় না। বিয়ে না করে থাকলেও তার সামনে যাওয়াটা উচিৎ হবে না। মাদিহা আনিসকে এখন বিস্মৃতির একটা মানুষই ভাবে। এতেও তার পুরোনো দুঃখটাই বাড়বে।
মাদিহার প্রতি ভালবাসা আনিসেরও আছে। হয়তো মাদিহার ভালবাসার শক্তির কাছে তারটা কিছুই না। যতটুকুই হোক, সে চায় না মাদিহাকে নতুন করে আবার কষ্ট দিতে।
আটটা বছর যেভাবে চলেছে, চলুক না সেভাবেই। এতদিন মাদিহা তার জন্য কষ্ট পেয়েছে, এখন কষ্ট পাওয়ার সময়টা তার।
ফিরে গেল আনিস।
*
অপেক্ষায় আছে এখনো মাদিহা। সে জানে, আনিসও তাকে ভালবাসে। কিন্তু ফিরবে না কখনোই। মানুষটাকে সে চিনে ভাল করেই। উপরে উপরে লোকটা যেমনই হোক, ভিতরের দিকটা অন্যরকম। মাদিহাকে আগে বুঝতে না পারাটাকে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে মেনে নিবে। নিজের উপর দায় নিয়ে নিজেকেই কষ্ট দিয়ে রাখবে। তবুও ফিরবে না।
অপেক্ষা তার কখনো ফুরোবে না - জানে মাদিহা। মেনে নিয়েছে এই জীবনটাকেই। ভালবাসলে সবসময় তার সাথেই থাকা লাগবে এমন কিছুই নেই। তাকে শুধু ভালবাসলেই হবে। সাথে থাকুক বা না থাকুক। মাদিহা তা ই করে যাবে আজীবন - এটাই পণ করে রেখেছে। আগের কথা ভাবতে ভাবতে কাজল দেয়া চোখ থেকে পানি পড়ে কখন যে মুখটা কালো হয়ে গেল সেটাও টের পেল না।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



