somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিউ ল্যাং ও ঝি নু (প্রাচীন চীনের প্রেমময় রূপকথা)

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
এটি প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। ধারণা করা হয় খ্রিঃপূঃ ৬ সালের।



নিউ ল্যাং ও ঝি নু দুইজনেই ছিল আকাশের দুই তারা। নিউ ল্যাং ছিল অলটায়ার ও ঝি নু ভেগা। তারা দুইজনে একে অপরকে গভীর ভাবে ভালবাসতো। অবশ্য প্রেমে পড়া ও ভালবাসা সবই নিষিদ্ধ ছিল স্বর্গের সম্রাজ্ঞী কর্তৃক। ঝি নু ছিল স্বর্গের সম্রাজ্ঞীর সাত নাতনীর মাঝে সবচেয়ে ছোটজন।

একদিন সম্রাজ্ঞী জানতে পারে তাদের প্রেমের কথা। জেনে খুব রাগান্বিত হয় ও ঠিক করে তাদেরকে আলাদা করে দিবে।

নিউ ল্যাংকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং পৃথিবীতে রাখাল বালক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঝি নুকে পাঠানো হয় মেঘ বুননের জন্য। আকাশের অপরূপ মেঘগুলো ঝি নুই বুনতো।

যদিও মেঘ বুননে ঝি নু আনন্দই পেত, কিন্তু তার ভালবাসার থেকে দূরে থাকার কষ্টও পেত। চোখ দিয়ে সবসময়ই অশ্রু ঝড়তো। অনেক চেষ্টা করেও সে তার একাকীত্ব দূর করার কোন উপায় পেল না। কাজের মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে গেল। আর আশা করতে লাগলো, একদিন হয়তো নিউ ল্যাং স্বর্গে ফিরে আসতে পারবে।

তাদের আলাদা হওয়ার অনেক বছর পর একদিন, স্বর্গের সম্রাজ্ঞীর নাতনীরা পৃথিবীর পদ্মবাগানে স্নান করার অনুমতি চাইলো। সম্রাজ্ঞীও ঐদিন বেশ ভাল মেজাজে ছিল, তাই তাদের অনুমতি দিল। স্বর্গ থেকে যাওয়ার সময় মেঘ বুননে ব্যস্ত থাকা ঝি নুকে দেখলো তারা। বেচারীর জন্য মায়া হল তাদের। তাকেও তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলো। সম্রাজ্ঞীও দেখছে তার এই নাতনীটা আগের মত নেই, তার থেকেও অনেক দূরে দূরে থাকে - সব ভেবে ঝি নুকেও অন্যদের সাথে পদ্মবাগানে যাওয়ার অনুমতি দিল।

পৃথিবীতে নিউ ল্যাং এর জীবনটা খুব একটা আনন্দের ছিল। গরীব বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে বড় হয়। খুব কষ্টই করতে হয়েছে, সেটা আরো কষ্টকর হয়েছে যখন তার বাবা-মা মারা যায়। তাকে থাকার জন্য যেতে হয় বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই তার সাথে অনেক বাজেভাবে আচরণ করে, তার সমস্ত সম্পদও কেড়ে নেয়। তাকে নিজেরটা নিজে অর্জন করে থাকার জন্য বাড়ি থেকে বেরও করে দেয় একটা সময়। সাথে দেয় একটা ষাঁড় ও একটি ঠ্যালাগাড়ি।

ষাঁড়টা এবং নিউ ল্যাং - বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়। তারা মিলে একটা ছোট কুড়ে ঘর তৈরি করে এবং একাকী সেখানেই থাকে। যতটুক ভালভাবে সম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল তারা। ঐ ঘরটাতে থেকেই অনেকগুলো বছর পার করলো। একদিন নিউ ল্যাং এর ষাঁড়টা কথা বলে উঠলো।

'আজকে তুমি পদ্মবাগানে যাবে। সেখানে দেখবে অনেকগুলো পরী স্নান করছে। তুমি লাল পোশাকটি খুঁজে বের করে চুরি করে এনে লুকিয়ে রাখবে।'

নিউ ল্যাং জিজ্ঞেস করলো কেন তাকে চুরি করতে হবে। ষাঁড়টি বলল, 'ঐ লাল পোশাকটি এমন একজনের পোশাক যে তোমার বধূ হবে।'

নিউ ল্যাং পদ্ম বাগানে যায়, এবং ঘাসের মাঝে পোষাকটি লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। ষাঁড়টি যেভাবে বলেছে, সেই অনুযায়ী - পরীরা স্বর্গ থেকে এসেছে এবং তারা পানির প্রবাহেই স্নান করবে। নিউ ল্যাং বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। যদিও সে ষাঁড়টির নির্দেশনামতই কাজ করেছে। কিন্তু পানির প্রবাহ যেদিকে সে লাল পোশাকটি নিয়ে সেদিকে লুকিয়ে ছিল। আরো একবার ভালভাবে লুকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পরীরা তাকে দেখে ফেলল এবং স্বর্গে ফিরে যাওয়ার জন্য পোশাক পরে নিল। শুধু একটা পরীই বাকি ছিল, কারণ নিউ ল্যাং আগেই তার পোশাক লুকিয়ে রেখেছিল। ঝি নুরটা। নিউ ল্যাং ঝিনুকে বলল, সে তার পোশাক ফিরিয়ে দিবে যদি ঝি নু তার বধূ হবে - এই কথা দেয়।

ঝি নু শুনে বেশ অবাক হল। সে তার বন্দীকারীকে ভালভাবে দেখে নিল কারণ সে নিশ্চিত ছিল বন্দীকারীটি তার পরিচিত। তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল, কিন্তু সে চিনতে পারলো এটাই তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা, নিউ ল্যাং।

তারা বিয়ে করলো এবং সুখে শান্তিতেই ঐ ছোট ঘরটাতে তাদের দুই সন্তান নিয়ে বাস করতে লাগলো। ঝি নু কাপড় বুনতো আর নিউ ল্যাং জমিতে তার বিশ্বস্ত ষাঁড়ের সাথে মিলে চাষাবাদ করতো। এভাবেই চলছিল। একদিন নিউ ল্যাং মাঠ থেকে ফিরে এসে শুনলো তার ষাঁড়টি মারা গেছে। মরার পূর্বে ষাঁড়টি নিউ ল্যাংকে বলেছিল, 'আমি মারা যাওয়ার পর আমার চামড়া দিয়ে একটি চাঁদর বানাবে। এই চাঁদরটা তোমাকে উড়ার ও ঝি নুর কাছে পৌছানোর জন্য লাগবে।'

তখন নিউ ল্যাং বুঝতে পারলো যে, তার বিশ্বস্ত ষাঁড়টিও আগে স্বর্গের আকাশেরই এক তারা ছিল। নাম ছিল টারাওস। বহু বছর আগেও তারা খুব কাছের বন্ধু ছিল। টারাওসই দেবী সম্রাজ্ঞীকে অনুরোধ করেছিল নিউ ল্যাংকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত না করার। এতে সম্রাজ্ঞী রেগে যায়, তাই তাকেও ষাঁড়ে পরিণত করে এবং স্বর্গ থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। পৃথিবীতে এসেও টারাওস তার বন্ধুর প্রতি নজর রাখে। এখন সে মৃত, এবং নিউ ল্যাং কে নির্দেশনা দিয়ে গেছে তার চামড়া দিয়ে চাঁদর বানানোর জন্য। নিউ ল্যাং তার পুরোনো বন্ধুর নির্দেশনা মতই কাজ করে।

পরদিন সম্রাজ্ঞীর নির্দেশে এক দমকা হাওয়া আসে ঝি নু ও তার সন্তানদের আকাশে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বন্ধুর কথা স্মরণে রেখে, নিউ ল্যাং চাঁদরটায় চড়ে বসে ও ভাসতে ভাসতে তার ভালবাসা ও সন্তানদের ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগেই সম্রাজ্ঞী তার সোনালী চুলের পিনটা খুলে আনলো এবং এক ঘায়েই স্বর্গের মাঝে নদী তৈরি করলো যেটা ঝি নু ও নিউ ল্যাংকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলল। ঐ সময়টায় তারা দুইজনই চিৎকার করে তাদের ভালবাসার জন্য কাঁদছিল। সম্রাজ্ঞী তাদের ভালবাসা দেখে একটু নড়ে গেল - তাই সে নিউ ল্যাংকে স্বর্গে থাকার অনুমতি দিল। কিন্তু সে তার বধু ও সন্তানদের সাথে থাকতে পারবে না।

বছরে শুধু একদিনই দেখা করতে পারবে তারা। দিনটি চন্দ্রের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন। এভাবেই নিউ ল্যাং - ঝি নু ও তার সন্তানদের সাথে পুনর্মিলিত হল। ম্যাগপাইয়ের একটি দল ভেগা ও অলটায়ার দুইটি তারার মাঝে একটি ব্রীজ তৈরি করে ঐদিন। যেটা দিয়ে নিউ ল্যাং নদী পার হয় এবং তার ভালবাসার মানুষের সাথে এক হয়। এই ব্রীজটি রাতের আকাশে দেখা যায়।


জাপানী চিত্রকর Tsukioka Yoshitoshi এর আঁকা নিউ ল্যাং ও ঝি নু র একটি ছবি।


ম্যাগপাই হল কাক গোষ্ঠীর একজাতের পাখি। এরা খুবই বুদ্ধিসম্পন্ন পাখি।


ম্যাগপাই


ম্যাগপাইয়ের সেই ব্রীজ


এই রূপকথা নিয়ে আসলে অনেক রকমের লেখাই প্রচলিত আছে। অনেকটা ঘেটে আমি আমার মত করে লিখলাম। অনেকেই আগে পড়েছেন হয়তো। এটা চীনের শ্রেষ্ঠ প্রেমময় রূপকথার মাঝে অন্যতম একটি।
খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে একেক জায়গায় একেক সময় ধরা হয়। তবে জুলাইয়ের সাত তারিখটাই বেশি প্রচলিত। ঐদিন আবার চীনের ভ্যালেন্টাইন'স ডেও।
এই দিনটাকে বলা হয় ম্যাগপাই ডে অথবা ডাবল সেভেনথ ডে বা ইভিনিং অফ সেভেনথ বা কি জি (Qi Xi)

ঐদিন চীনের মেয়েরা ভালোবাসার উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বলেও শোনা যায়। :P
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:১৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×