somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিকটক - পর্ব এক

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রায় একবছর পর আবার থ্রিলারে হাত দিয়েছি। বরাবারের মতই গল্প অতিদীর্ঘ আকৃতি ধারণ করছে।
পর্ব করে দিতে ভাল না লাগলেও তাই করতে হবে। গল্পের অনেক কিছুই উদ্ভট। একবছর পর লেখার কারণে লেখার আকৃতিও অনেক পালটে গেছে। ১ম পর্ব হলেও এটা বেশ বড়ই। গল্পটা এখনো শেষ করিনি। কত বড় হবে নিজেও জানিনা। গল্পের সমীকরণ আমি নিজেই মিলাতে পারছি না। জানি না গল্পটা উপভোগ্য হবে কিনা আসলেই। যারা পড়বেন - আশা করবো - পুরোটা পড়ার ইচ্ছা রাখবেন।


সূচনা

ফারহানকে কখনোই ভাল করে বুঝতে পারে না নিমমি। মানুষটাকে তার মনে হয় চমকে দেওয়া একজন। এই চমকটা সে পেয়ে আসছে ফারহানের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একদিন তার দিকে এক লাল গোলাপ বাড়িয়ে দেয় ফারহান। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া নিমমি তখন বুঝতেও পারেনি যে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। লোকটাকে কি মানা করবে, না জিজ্ঞেস করবে সে কী চায় তার কাছে।

সে কিছু বলার আগেই ফারহানই বলে উঠে, ‘আমি তোমাকে চিনি না। তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না। তোমার নামও জানি না। কিছুক্ষণ আগে তোমাকে দেখলাম ঐ কোচিং-এ যেতে। তোমার বের হতে ঘন্টা দেড়েকের মত বাকি ছিল শুনে লাল গোলাপটা যোগাড় করে আনলাম। কাউকে লাল গোলাপ দেওয়ার অর্থ যদি জেনে থাকো তাহলে আমাকে আর সরাসরি কিছু বলতে হচ্ছে না।’

ফারহানে কথা শুনে একদম হাঁ হয়ে গিয়েছিল নিমমি সেইদিন। একটা কথাও বলতে পারেনি। কাঁপাকাঁপা হাতে শুধু ফুলটা নিয়েছিল ফারহানের হাত থেকে।

সেই শুরু চমকের। ফারহানের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো সেইদিনই সে। তবুও একটা শঙ্কা ছিল। তার বাবা-মা কী তাদের সম্পর্ক মেনে নিবে কখনো? তার বাবার মত কড়া একজন মানুষকে তো মানানো যাবে না কখনোই। কিন্তু, অদ্ভুত ভাবে তার বাবা বিনা বাক্য ব্যয়েই মেনে নিয়েছিল তাদের ব্যাপারটাকে। ফারহান চমকে দিয়েছিল তাকে সেই সময়ও। কারণ, তার বাবা কারো কথাই কখনো শুনতো না।

বিয়ে হল। বিয়ের পর আড়াই বছরও রইলো এই চমকের মাঝেই। বিয়ের পর ফারহানকে সে কাছেই পায়নি অতটা। মাঝে মাঝে ক্ষনিক সময়ের জন্যই তার দেখা পেত নিমমি। এমনকী তাকে পড়ে থাকতে হচ্ছিল তার বাবার বাড়িতেই। সে চাইতো শুধু ফারহানের সাথে থাকতে। কত অভিযোগ করেছে এই নিয়ে সে! কিন্তু তার কোন অভিযোগ গ্রাহ্য করেনি ফারহান। শুধু বলতো, ‘আগে পড়ালেখাটা ভালভাবে শেষ করো, তারপর তো জীবনের পুরোটা পড়েই আছে স্বামীকে কাছে পাওয়ার।’ নিমমির মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিল। সত্যি কথা বলতে, তার এই একটা অভিযোগ ছাড়া ফারহানের প্রতি আর কোন অভিযোগ ছিলও না। তাই, অপেক্ষা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হওয়ার।

অবশেষে ছয়মাস আগে সে তার নিজের বাসায় উঠার লাইসেন্স পেয়েছে। লাইসেন্সই তো এটা। বিয়ের পর আড়াইটা বছর তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে এখানে আসার জন্য। বাবার বাড়ি ত্যাগ করে নিজের বাসায় এসে আরো একবার চমকে গিয়েছিল সে। কারণ সে এতদিন ধরে যেভাবে নিজের বাসাকে সাজাবে বলে কল্পনা করে রেখেছিল, ফারহান তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত করে রেখেছে। ফারহান প্রতিনিয়তই তাকে চমক দিয়ে গেছে।

তবে, এখানে আসার পর থেকে সে ফারহানকে এক অন্যরকম মানুষ হিসেব দেখছে। কেমন যেন নিরব থাকে ফারহান। ঘর থেকে কাজে যাওয়া ছাড়া বেরই হয় না। ছুটির দিনগুলোও ঘরে বসে থেকে কাঁটায়। নিমমির ইচ্ছা ফারহানকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার। কিন্তু, ফারহান রাজি হয় না। শুধু বলে, ‘সময় হোক।’ নিমমি জানে না যে এই সময় আসলে কবে হবে। তবুও তার অভিযোগ নেই। এতদিন ধরে ফারহানকে দেখে সে বুঝে গেছে, তার এরকম করার মানে নিশ্চয় তার জন্য কোন চমক অপেক্ষা করছে।

তবে, সামনে চমক তার জন্য একটা অপেক্ষা করছে। ফারহান নিজেই তাকে আগে থেকে বলে রেখেছে এটার কথা। আগে কোনবারই ফারহান ঘোষণা দিয়ে তাকে চমকে দেয়নি। এইবার এরকম করার মানে বড়সর কোন পরিকল্পনা করছে সে। কী হতে পারে সেটা! ভেবে পায়না নিমমি। সে অপেক্ষা করছে শুধু। আর দুই দিন পরেই তাদের অদ্ভুত প্রথম দেখার পঞ্চম বর্ষপূর্তি। চমকটা যে সে ঐদিনই পাবে তাতে মোটামুটি নিশ্চিত সে।

পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে হুট করে ঘড়ির দিকে নজর পড়লো নিমমির। রাত এগারোটার অনেক বেশি। ইদানীং ফারহান ওভারটাইম করছে সেটা জানে সে। কিন্তু কখনোই রাত দশটার বেশি বাজেনি ফিরতে। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন দিল তাকে। ফোন ধরছে না ফারহান। কয়েকবার ফোন দিল। একবারও ধরেনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ফোন দিল। দুইবার রিং হতেই অপর পাশ থেকে জবাব ভেসে আসলো।
‘হ্যালো!’ ফারহানের ক্লান্ত গলা শুনতে পাচ্ছে সে।
‘কোথায় তুমি? এত রাত করছো কেন? কোন বিপদ-আপদ?’ চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো নিমমি।
‘বিপদ না। জ্যাম।’
‘এখন কোথায়? জ্যামেই আটকে আছো?’
‘না। এসে পড়েছি। বেশিক্ষণ না দশ মিনিটের মাঝেই হাজির হচ্ছি।’ তাকে আশ্বস্ত করে বলল ফারহান।
‘তাড়াতাড়ি আসো। খাবার নিয়ে বসে আছি কখন থেকে। সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে এখন।’ আবার কন্ঠে স্বস্তি ফিরে এসেছে নিমমির।
‘আহারে! দশটা মিনিটই তো। কট্টুকই বা আর ঠান্ডা হবে এইটুক সময়ে।’ হাসতে হাসতে বলে ফোন রেখে দিল ফারহান।

নিমমিও হাসছে। আসলেই তো দশ মিনিটে আর কট্টুকই বা ঠান্ডা হবে! তবুও, আবার খাবার গরম করায় লেগে গেল সে। একটু পরই আবার ফোন বেজে উঠলো তার। ফারহান ফোন করেছে। একটু অবাক হল। মাত্রই তো কথা হল তাদের। অতশত না ভেবে রিসিভ করলো কলটা। সে বলার আগেই ঐদিক থেকে আসলো।
‘শুনো! আমার আসতে একটু দেরী হতে পারে হয়তো। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’ বলে ফোন রেখে দিল ফারহান।

শঙ্কা জেগে উঠলো নিমমির মনে। এমন তো কখনোই করে না ফারহান। অজানা এক শঙ্কায় কেঁপে উঠলো সে।

অধ্যায় - এক

সারাটা দিন খুবই বাজেভাবে কেঁটেছে ফারহানের। একে তো ফ্যাক্টরিতে এক দুর্ঘটনা। তার উপর রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। সাথে নিজের একটা কাজ করতে গিয়েও অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়েছে তাকে। সে জানে নিমমি তার জন্য দুঃশ্চিন্তা করছে।

মাওনা চৌরাস্তার মোড়ে বাস থেকে নামলো মাত্রই। বাসায় পৌছুতে আর পনেরো মিনিটের মত। যদি সে হেঁটে যায় তাহলে। আর রিকশা নিয়ে গেলে সময় আরো কম লাগবে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীরে কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। রিকশা নিয়ে যাওয়াই ভাল। তবুও, হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিল সে। রিকশায় করে গেলে ক্লান্তি ঝেঁকে বসতে পারে। তার উপর বাসে করে এতক্ষণ বসে বসেই এসেছে। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই হাঁটাই ভাল।

হেঁটে অল্প কিছুটা এগুতেই নিমমি ফোন করলো তাকে। তার সাথে কথা বলে ফোন কাঁটতেই দেখে ফোনে দশটা মিসড কল ভেসে আছে। সবগুলোই নিমমির। মেয়েটা যে তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছে তার বড় প্রমাণ এটাই। তার এর জন্য নিজেকেই দোষছে ফারহান। প্রথমবার ফোন ধরে বলে দিলেই এতটা দুঃশ্চিন্তা করতে হত না তাকে।

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে যাবে, ঠিক এমন সময়ই আবার বেজে উঠলো। মোবাইলটা সামনে এনে দেখে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। একটু অবাক হচ্ছে সে। তার নাম্বারটা পরিচিত গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেনা। কিছুক্ষণ নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করে বললো, ‘হ্যালো! কে বলছেন?’
‘কেমন আছো, ‘ওয়ান্ডার’ ফারহান?’ গমগমে একটা পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেস এল। কন্ঠটা শুনেই জমে গেল ফারহান। এই মুহুর্তে সে এই মানুষটার থেকে ফোন একদমই আশা করেনি। শুধু এই মুহুর্তে না, কোন সময়েই এই মানুষটার থেকে ফোন আশা করেনি।

কন্ঠটা শুনেই মনে পড়ে গেল বাম পায়ের আঘাতটার কথা। এই লোকটার কাজ করতে গিয়েই সে তার বাম পা প্রায় হারাতেই বসেছিল। ভাগ্য ভাল থাকায়, পা টা টিকে গেলেও স্বাভাবিক ভাবে আর হাঁটতে পারেনি সে কখনোই। ঐ ঘটনার পর থেকেই এই লোকের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফারহান।
ইচ্ছা করে অবশ্যই না, লোকটাই তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। লোকটার কথা শুনে তার পুরোনো জীবনের কালো অধ্যায়টার কথা মনে পড়ে গেল। যে কোন মূল্যেই সে তার এই কালো অধ্যায়টাকে মুক্তি পেতে চায়। নিমমিকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। এই জীবনটা নিয়েই থাকতে চায় সে।

‘ফারহান?’ ফোনের অপর পাশ থেকে কথা শুনে হুঁশ ফিরলো যেন ফারহানের। আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিল, তবে লোকটাই তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় কিছু বলা থেকে বাঁচিয়ে দিল। ‘তোমাকে স্মরণ করছি অনেকদিন থেকেই। আমার সবচেয়ে দক্ষ লোকটা ছিলে তুমি। তোমার অভাবটা পূরণ করা যাবে না।’

লোকটার এই স্বগোতোক্তি করার মানে জানে ফারহান। তাকে স্মরণ করছে মানে তাকে আবারো তার কালোজগতে পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। সে জানে লোকটাকে এখন মানা করে কোন লাভ নেই। তবুও সাহস সঞ্চার করে বললো, ‘আমি ঐ পথ থেকে ফিরে এসেছি।’

‘আহা! আগেই কেন দুঃশ্চিন্তা করছো? ফিরে এসেছো তো জানিই। তাই বলে চায়ের আমন্ত্রণ রাখতে পারবে না?‘ কন্ঠের সাথে বিদ্রুপাত্নক হাসির শব্দও ভেসে আসলো অপর পাশ থেকে।

এইবার ফারহান সত্যিই চমকে গেছে। এটা অসম্ভব লাগছে তার কাছে। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আবারও তাকে বাঁচিয়ে দিল লোকটা। অপর পাশ থেকে বলে উঠলো, ‘তোমার ওয়াইফের কথাও তো ভাবা লাগবে তোমার। তুমি আমন্ত্রণ না রাখলে যদি ওর......’

লোকটাকে পুরোপুরি কথাটা শেষ করতে দিল না ফারহান। তার আগেই ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলো, ‘ওর যদি কিছু হয়......’ সেও কথাটা শেষ করতে পারলো না। লোকটা বাঁধা দিল তাকে।
‘যেন কিছু না হয় – তাই তো চায়ের দাওয়াত দিচ্ছি।’

কিছু বলছে না ফারহান। চুপ করে আছে। অবশ্য সে কিছু বললেও তাতে কোন লাভ হবে না। এখন থেকে ঐ লোকটার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত কথা। এর উপর সে কিছুই বলতে পারবে না। তবুও চেষ্টা করতো বাঁধা দেওয়ার। কিন্তু নিমমির বিপদের আশঙ্কায় কিছু করছে না। নিমমিকে নিরাপদে রাখতে হলে তাকে এখন ঐ লোকটার কথা মতই চলতে হবে।

‘চৌরাস্তার মোড়ে দেখো, একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেটায় গিয়ে উঠে পড়ো।’ লোকটা বলে যাচ্ছে।

মোড়ের দিক তাকালো ফারহান। আসলেই একটা পুরোনো ভাঙাচোরা দশার গাড়ি দেখতে পাচ্ছে সে। ফোন কানে রেখেই সেটার দিকে এগুনো শুরু করলো ফারহান। অপরপাশ থেকে লোকটা বলেই যাচ্ছে, ‘গাড়িতে আমার দুইজন বিশস্ত লোক আছে। বাকিটা যা করার তারাই করবে। আর, তোমার ওয়াইফকে যদি আরেকবার দেখার ইচ্ছা থেকে থাকে তোমার, তাহলে লোক দুটোর সাথে ভদ্র আচরণ করার উপদেশই দিব আমি।’ অপর পাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসলো। ফারহানের শরীর জ্বলছে ক্ষোভে। তার ইচ্ছে করছে গাড়িতে থাকা লোক দুটোকে খতম করে দিয়ে নিমমিকে নিয়ে নিরাপদ কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু, তাতে ঝুঁকি অনেক। কোন ঝুঁকিকে সে কখনোই পরোয়া করেনি। এর চেয়ে আরো বিপদজ্জনক অবস্থাও সে ভালভাবেই পাশ কাঁটিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু, এইখানে ঝুঁকিটা নিমমির জীবনের।

তাই, শান্তভাবেই গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতরের লোকদুটোর মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভিতরের আলোটা বন্ধ করে রাখা। আলো কেন বন্ধ করা সেটাও ভাল করেই জানে সে। তাদের কারো চেহারাই তার সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছে না।

গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে গেল শুধু। ঈঙ্গিতটা পরিস্কার। গাড়ির ভিতরে চড়ে বসলো ফারহান।

অধ্যায় - দুই

গাড়িতে উঠতেই ফারহানের হাত বেঁধে ফেলা হল। সেই সাথে তার চোখও কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। ফারহান তাতে অবাক হয়নি। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে বাঁধাও দেয়নি কোন।

যেই লোকটা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে সর্বদাই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। এমনকী দীর্ঘদিন ধরে লোকটার অধীনে কাজ করার সময়ও কখনো এই লোকটার দেখা পায়নি সে। কোথায় থাকে লোকটা সেই সম্পর্কেও কেউ জানেনা। তার চক্রের হাতে-গোণা দুই থেকে তিন জন ছাড়া আর কেউ সেই তথ্য জানেনা। সেই দুই-তিনজনও যে কারা সেটার সম্পর্কেও ধারণা নেই কারো। লোকটার সাথে তার যোগাযোগ হত বেশির ভাগ সময়ই ফোনে। আর, পরবর্তীতে কিছুদিন ভিডিও কলে। ভিডিও কলেও লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখা যেত না। ভিডিও কলগুলোয় সে সব সময়ই দেখেছে গভীর অন্ধকার থেকে লোকটার ভেসে আসতে। আলো যাও বা দুয়েকবার ছিল – তবে তা এতই ম্রিয়মাণ ছিল যে তা থেকে চেহারার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

লোকটা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এটা শুনে বেশ চমকেই গিয়েছিল সে। কারণ, লোকটা কাউকেই আমন্ত্রণ জানায় না। কিছু গল্পও প্রচলিত আছে এই নিয়ে। এই লোকটা সাধারণত কাউকে আমন্ত্রণ না জানালেও, যাকে আমন্ত্রণ করে সে পরবর্তীতে পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষগুলোকে আসলেই মেরে ফেলে কিনা সেটাও সংশয়ের। কারণ, কখনো কারো লাশের, এমনকী হাড়গোড়েও চিহ্নও পাওয়া যায়নি। এটা মনে হতেই একটু কেঁপে উঠলো ফারহান। তাকে ডেকেছে, তারমানে তার সাথেও এমন কিছু ঘটার জোরালো সম্ভাবনা আছে। শুধু তার সাথেই না, নিমমির সাথেও। এখন হোক আর পরেই হোক – সে ধরেই নিয়েছে এটাই তার শেষ যাত্রা। এখন বাঁধা দিলেও যা, বাঁধা না দিলেও তা। তবুও কিছুটা সময় তো পাওয়া যাবে। ততক্ষণে কি পারবে বাঁচার কোন উপায় বের করে নিমমিকে উদ্ধার করতে?

আর, ভাবতে পারছে না ফারহান।

অবশ্য গাড়িতে উঠে তার হাত বাঁধার আগেই সে তার ছোটখাট একটা কাজ ঠিকই সেরে ফেলেছে। সে যে পাশে বসেছে সেই পাশের জানালাটা খুলে রেখেছে। গাড়ির লোকগুলো এটা দেখলেও তারা এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবেনি। কিন্তু এটার গুরুত্বটা অন্যরকম। ফারহান নিজেও নিশ্চিত না এটা কতটা কাজে লাগবে। তবুও, সম্ভাবনা যখন – তাই পরীক্ষা করে দেখছে।

এই গাড়িতে করে তাকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে সে তা জানে না। চোখ ঢাকা থাকায় রাস্তা দিয়ে দেখে চিনতেও পারবে না। সেটার জানার একমাত্র উপায় এখন গাড়ির গতিবেগ। সেই সাথে খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করতে থাকা বাতাসের প্রবাহ। সে এখন বসে আছে গাড়ির বাম দিকে। বাম দিকে খোলা জানালার বাতাসের দিক প্রবাহেই তাকে জায়গাটা চিহ্নিত করতে হবে।

এখনো চলতে শুরু করেনি গাড়িটা। দাঁড়িয়ে আছে চৌরাস্তার মোড়ের কাছেই মাওনা-শ্রীপুরের সড়কের মুখে। গাড়িটার সামনে এখন তিনটা রাস্তা খোলা আছে। যদি বামে ঘুরে তাহলে সেটা ঢাকার দিকে। ডানে ময়মনসিংহ। সোজা গেলে কালিয়াকৈর। যদি ঢাকা যেতে হয় তাহলে এখান থেকে সরাসরি বামে বাঁক নিতে হবে। যেটা বাতাসের প্রবাহ ছাড়াই গাড়ির গতির উপর আন্দাজ করেই ধরা যাবে। ডানে গেলে রাস্তার অপর পাশে গিয়ে বাঁক নিতে হবে। যেটার জন্য বাঁক নেওয়ার আগে অল্প কয়েক সেকেন্ড সোজা চলে পরে বাঁক নিতে হবে। বাতাসের দিক বিবেচনা ছাড়াই সেটা সম্ভব বুঝা। কারণ বাঁকের সময় গাড়ির গতি কমে যাবে কিছুটা। আর, কালিয়াকৈর সড়কে উঠলে সরাসরি চলে গেলেই হবে। তাতে বাতাসের ঝাঁপটা সরাসরি এসে লাগবে তার মুখে।

গাড়ির ইঞ্জিন চালু করেছে চালক। বামে মোড় নেয়নি। সোজাসুজি রাস্তা পার হচ্ছে। তার মানে কালিয়াকৈর বা ময়মনসিংহ – এই দুই দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। গাড়ির গতির দিকে মনোযোগ রেখেছে ফারহান। গতি এখনো বাড়ায়নি গাড়ির চালক। গাড়ির ভিতরে বসে বাতাসের প্রবাহে কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে তা বুঝা বেশ কঠিন লাগছে ফারহানের। প্রথমে ভাবেনি, তবে এখন বুঝতে পারছে – ডানে-বামে যেদিকেই ঘুরাক বাতাসের ঝাঁপটা একই রকম থাকবে দুই দিকে। যেহেতু বামে বাঁক নেয়নি তার মানে এখন ঘুরলে ডানেই ঘুরবে নয়তো সরাসরি যাবে। তবে, তাকে এত ভাবনা চিন্তা থেকে বাঁচিয়ে দিল গাড়ির লোকগুলোর একটা। ‘মোড় ঘুরাইতে সারা রাইত লাগাইবি নাকি? তাড়াতাড়ি ডাইনে ল।’ এই অভূতপূর্ব সাহায্যে চমকে গেল ফারহান। যে মানুষটা নিজেকে আত্নগোপন রাখতে বদ্ধ পরিকর – তারই সাগরেদরা কিনা সরাসরি তাদের যাত্রার দিক বলে দিচ্ছে! বেশি ভাবলো না অবশ্য এটা নিয়ে। এটা নিয়ে তার ভাবার কিছুই নেই। একটা তথ্য অন্তত সে জানতে পেরেছে, সেটা হল – তাকে এখন ময়মনসিংহের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে, মূল ময়মনসিংহ শহরেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নাকি এই রাস্তাতেই থাকা দুই উপজেলার কোন একটাতে যাচ্ছে তা নিশ্চিত না।

যাত্রা শুরু হল। গাড়িটা দেখতে মলিন হলেও এটা চলছে বেশ ভাল গতিতেই। গভীর রাত হওয়ায় গতি বাড়াতেও কোন বাঁধা নেই। ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়িটা। যদি মূল শহর হয়ে থাকে তাহলে যেতে সোয়া এক থেক দেড় ঘন্টার মত লাগবে বড়জোর। যেহেতু রাস্তাও এখন খালি। গাড়িতে উঠার সময় সে ঘড়িতে দেখেছিল, ঠিক বারোটা বাজে। সময়ের হিসাবটাও মিলিয়ে দেখতে হবে তাকে। খোলা জানালা দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস কেঁটে যাচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় রীতিমত শীতই লাগছে ফারহানের। জানালাটা সে যে কারণে খুলে রেখে তা সফল হয়নি। বরং এখন সেটাই তার বড় বাঁধা হয়ে আছে। লোকগুলোকে জানালাটা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলবে কিনা ভাবছে। পরে কী ভেবে যেন আর বলতে ইচ্ছে হল না তার। শীত সহ্য করেই পড়ে রইলো। মাথায় এখন নিমমির চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েটা এখন আসলেই নিরাপদে আছে কিনা সেটাও জানেনা সে। হয়তো এখনো তারই অপেক্ষা করছে খাবার নিয়ে। এই মেয়েটাকে চমকে দেওয়ার জন্যই তো সারাদিন এতটা ক্লান্তির উপরে থাকতে হয়েছে তাকে। এত ক্লান্তির সব বিফল হয়ে যাবে হয়তো লোকটার চায়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে।

গাড়ি সোজা এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের আন্দাজে এইটুক বুঝতে পারছে গাড়িটা মূল শহরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যে পৌছাতে হয়তো আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে।

তাকে কেন লোকটা আমন্ত্রণ জানিয়েছে সেটা বুঝা যাবে আর কিছুক্ষণ পরই।

অধ্যায় - তিন

গাড়িটা তার গন্তব্যে এসে থেমেছে। থামার পর একটা গেট খোলার শব্দ পেল ফারহান। কোন বাড়ির গ্যারাজে ঢুকছে। এটা সহ দুইটা সূত্র পেল ফারহান। প্রথম সূত্র হল মিনিট তিন-চারেক আগে পাওয়া ময়লার গন্ধ। যদিও গন্ধের তীব্রতা অতটা বেশি ছিল না। তবে গন্ধের স্থায়িত্ব থেকে ফারহান এইটুক নিশ্চিত যে ময়লার বড়সর একটা স্তুপই ছিল। গন্ধের তীব্রতা অতটা না থাকার কারণ স্বরূপ ধারণা করছে ময়লার স্তুপটা ছিল রাস্তার অপর পাশে। আর, এখন দ্বিতীয় সূত্র এই গ্যারেজ। সাথে আরেকটা সূত্রও আছে। সেটা হল এই লম্বা পথে গাড়িটা কোন বাঁক নেয়নি। একদম সোজাসুজিই এসেছে। আর, ময়লার গন্ধটা পেরুবার পর গাড়ির গতি আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছিল। সেটার অর্থ গাড়িটা সরাসরি এসে কোন সরু রাস্তায় ঢুকেছে। এবং সেই গতিতে তিন-চার মিনিট দূরত্বে এই গ্যারেজে এসে পৌছেছে।

গ্যারেজে আসার পর টের পেল তাকে নিয়ে আসা লোকদুটো ছাড়াও আরো কয়েকজন আছে। কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে তারা। তবে কী বলছে তা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে না ফারহান। গাড়িতেই বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।

কিছুক্ষণ পর, তার পাশের দরজাটা খুলে গেল। তাকে টেনে বের করলো কেউ একজন। একটা গাড়ির বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলো। বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে আসা গাড়িটা তাকে পৌছে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তারপর তাকে ঠেলে নিয়ে আরেকটা গাড়িতে ঢুকিয়ে দিল কেউ একজন। এই নতুন গাড়িতে কয়জন লোক আছে তা বুঝতে পারছে না। আন্দাজ করে নিল হয়তো দুইজন। টের পেল গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। তবে এইবারের যাত্রাটা অত দীর্ঘ হল না। আগের গাড়িতে করে বেশ কিছু আন্দাজ করতে পারলেও এইবার কিছুই ধরতে পারেনি। গাড়ির গতিও কম। তাকে কোন দিক থেকে কোন দিকে নিয়ে গেছে সেটাও তার ধারণার বাইরে। সবমিলে এখন একদম অজানা কোন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।

গাড়ি থামিয়ে বাকিটা পথ তাকে হাঁটিয়েই নেওয়া হল। হেঁটে যেতে যেতে টের পেল যে তার পায়ের নিচে অনেক পরিমাণ ইটের টুকরো বা পাথর পড়ে আছে। এরকম ভাবে মিনিট-দুইয়েকের মত আগানোর পর, বাকি রাস্তাটুকুকে বেশ কর্দমাক্ত মনে হল তার। আর আশেপাশের ঘাসগুলোও বেশ বড় বড়। শরীরে খোঁচাও দিচ্ছে কিছু ঘাস। মিনিট তিন-চারেকের মত আগানোর পর তাকে থামতে বললো সাথের লোকগুলো বা লোকটা। এখনও সে জানেনা তার সাথে এখন কয়জন লোক আছে। এরপর সিঁড়ির মত কিছুতে করে তিন-চার ধাঁপ উপরে চড়তে হল। কোন আবদ্ধ কক্ষে আছে সেটা বুঝতে পারছে ফারহান। তবে যাত্রা তখনই থামলো না তার। ঐ আবদ্ধ কক্ষের ভিতরেই আরেকটা সিঁড়ি বয়ে নিচে নামতে হল তাকে। একটা চেয়ারে বসিয়ে তার হাত এবং চোখের উপরের কালো কাপড় সরিয়ে দেওয়া হল।

লম্বা সময় চোখের উপর কালো উপর থাকায় দৃষ্টি কেমন যেন অন্ধাকারাচ্ছান্ন হয়ে আছে ফারহানের। কক্ষটায় স্বল্প আলো থাকলেও চোখ পিটপিট করছে। ধীরে ধীরে আলো সয়ে যাওয়ার পর সামনে চেয়ে দেখে তার দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে মিস্টার টাটা।

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষগুলোর একজন মিস্টার টাটা। তাঁর অর্থের পরিমাণ কত সেটা নিয়ে নিজেও জানেন না তিনি। এই অর্থের নব্বই ভাগ এসেছে অস্ত্র ব্যবসায়ের মাধ্যমে। আড়ালে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি। অবশ্য তাদের কেউই তার সম্পর্কে জানেনা। এমনকী চেহারাটাও চিনেনা। ফারহানের সাথে ভিডিও কলের মতই বাকিদের সাথে যোগাযোগ করতেন তিনি। তাঁর নাম আসলে মিস্টার টাটা কিনা সেটাও নিশ্চিত না কেউ। অস্ত্র ব্যবসায় যখন প্রথম আসেন তখন তার নাম ছিল ‘টিএ’। নামটা উচ্চারণ করা কঠিন হত বলে আস্তে আস্তে নামটা বদলে যায় ‘টা’ তে। সেটা থেকে উচ্চারিত হতে হতে এখন ‘টাটা’ নামেই বেশি পরিচিত। মিস্টার টাটার মত ধুরন্ধর কোন ব্যবসায়ী আজ পর্যন্ত ফারহানের চোখে পড়েনি। বিশ্বের প্রায় সব জায়গায়ই তার নিযুক্ত ব্যক্তি থাকার পরও – এসব ব্যক্তিদের একজন আরেকজনকে চিনতো না। কোন ডিলিং-এ কখনোই সামনে থেকে থাকেননি, সবই পরিচালনা করেছেন আড়ালে থেকে। এমনকী উনি কখনো নগদ ক্যাশ টাকায় লেনদেন করেননি। শুধু চেকই গ্রহণ করেছেন। আর, এসব চেকের টাকা গিয়ে জমা হয় তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তবে, এত টাকার মালিক হয়েও উনি ছিলেন খুবই মিতব্যয়ী। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা একদমই খরচ করতেন না। এমনকী উনার হয়ে কাজ করা লোকগুলোকেও খুব বেশি অর্থ প্রদান করতেন না। যতটা দিলে একদম চলে যায়, ঠিক ততটাই দিতেন। এর জন্য মাঝে মাঝেই উনার লোকেরা উনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইতো। তখনই প্রয়োজন পড়তো ফারহানের মত পেশাদার খুনীদের। এসব খুনীদের কাউকেই তিনি বেশিদিন সাথে রাখেন না। উটকো ঝামেলা এরা। তাই কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টের পরেই খুনীদের দলকে সরিয়ে দেওয়া হত।

অবশ্য ফারহানকে প্রফেশনাল খুনী বলাও যায় না সেইভাবে। ফারহানকে মিস্টার টাটা নিজ হাতেই তৈরি করেছেন। উনার অনেক নিয়মও উনি ভেঙ্গেছেন ফারহানের জন্য। অন্যান্যরা উনার থেকে ঠিক মত পারিশ্রমিক না পেলেও ফারহান সবসময়ই বেশি পেয়েছে। যেখানে অন্যান্য খুনীদের সরিয়ে দেওয়া হত কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টের পরই, সেখানে ফারহান টিকেছিল প্রায় ছয় বছর। এমনকী লোকটার সংস্পর্শ থেকে সরে আসার পরও ফারহান এখনো জীবিত আছে। এতদিন চলা তার সুসময়টার ইতি ঘটতে চলেছে হয়তো এইবার।

‘অনেকদিন পর দেখা হলো আবার তোমার সাথে, ফারহান,’ গমগমে গলায় বলে উঠলেন মিস্টার টাটা।
এখনও চোখে আলো পুরোপুরি সয়ে আসেনি ফারহানের। চোখ ডলতে ডলতে শান্ত গলায় বলল, ‘দেখা আসলে এই প্রথমবারই হচ্ছে আমাদের।’
‘হাহাহা, একই তো কথা।’ বলে আবার হাসা শুরু করলেন মিস্টার টাটা।

রুমটা পরীক্ষা করে দেখছে ফারহান। মোটামুটি আয়তনের রুম। খুব একটা বড় না। রুমটার আলোও খুব একটা উজ্জুল না। মাথার উপর স্বল্প ক্ষমতা একটা বাল্ব ক্ষীণ লাল আলোর যোগান দিচ্ছে। রুমটায় সে আর মিস্টার টাটা ছাড়াও আরো দুইজন আছে। তাদের কারো চেহারাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না আলোর স্বল্পতার কারণে। মিস্টার টাটাকে অতটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবে অন্য দুইজনের থেকে অনেকটা পরিষ্কার। লোকটার আত্নগোপনে থাকার ধরণ দেখে ফারহান অবাক না হয়ে পারলো না। সামনাসামনি বসে থেকেও নিজেকে লুকিয়ে রাখছে যেন। ঘরের লাল আলোক উদ্দেশ্য রেখেছেন, যাতে তাঁর সামনাসামনি বসা মানুষটার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটেই থাকে। তবুও, ফারহান যথেষ্ট পরিষ্কার ভাবেই চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে মিস্টার টাটার। উনি যে এই কক্ষে বসেই উনার সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন সেটা বুঝতে পারছে। ভিডিও কলেও সে এমন পরিবেশটাই দেখতো।

‘চা নাও! আমন্ত্রণ তো চায়েরই ছিল।’ হাসতে হাসতে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন মিস্টার টাটা।
ফারহানও কোন উচ্চবাচ্য করেনি আর। সারাদিন পরিশ্রমে এমনিতেই ক্লান্ত, তার উপর চোখে ঘুম – এই মুহুর্তে চা-টা একটা টনিক হিসেবে কাজ করবে। নিঃশব্দে সামনে থাকা কাপটা তুলে চুমুক দিল।

‘তো কেমন চলছে তোমার দিনকাল?’ জানতে চাইলেন মিস্টার টাটা।
‘সেটা তো আপনার ভাল করেই জানার কথা।’ কটু স্বরে জবাব দিল ফারহান।
‘হ্যাঁ, তা জানি। বিয়ে করেছো, ফ্যাক্টরিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরী করছো। সুখেই তো কাটাচ্ছ জীবন।’
‘কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনার ফোন পাওয়ার থেকে মনে হয় না আর কাটানো যাবে।’
‘হাহাহা! এখনো রাগ করে আছো আমার উপর। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে......,’ বলে শেষ করতে পারলেন মিস্টার টাটা। তার আগেই বাঁধা দিল ফারহান।
‘আমি চলে যাইনি। কী হয়েছিল সেটা আপনি ভাল করেই জানেন।’ তিক্ত গলায় বলে উঠলো ফারহান।
‘সে যাই হোক! ওসব ভুলে যাও। তোমার দুর্ঘটনার পর...’
‘দুর্ঘটনা? সত্যিই?’
‘বললাম তো ওসব ভুলে যাও।’
‘গেলাম। এখন বলুন আমাকে নিমন্ত্রণ জানানোর কারণটা কী?’

হাসলেন মিস্টার টাটা। এইজন্যই ফারহানকে তিনি বেশি পছন্দ করেন। আর বিলম্ব না করে কাজের কথা বলা শুরু করলেন।
‘তৈমুরকে তো তুমি চেনোই।’
‘হ্যাঁ।’ তাকে না চেনার কোন কারণ নেই ফারহানের। এই অন্ধকার দুনিয়ায় তার একমাত্র বন্ধু ছিল ঐ তৈমুরই। যদিও দুইজনের মাঝে বয়সের ব্যবধানটা অনেক। তবুও বন্ধুত্ব গড়ে উঠায় সেতা বাঁধা হতে পারেনি। সে আজকের ফারহান হয়ে উঠার পিছনে তৈমুরের গুরুত্ব অনেক বেশি। সে না থাকলে হয়তো তাকে মিস্টার টাটার অন্যান্য খুনীদের মতই অবস্থায় পড়তে হত।

‘তুমি তো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা লোকদের সম্পর্কে জানোই। কয়েকদিন পরপরই কিছু কিছু মানুষ আমার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করা শুরু করে। এদের কয়েকটাকে তো তুমি নিজের হাতেই দমন করেছো।’
পূর্বের কথা শুনতে ভাল লাগছে না ফারহানের। তাই তাড়া দিয়ে বলল, ‘এসবের সাথে তৈমুরের সম্পর্ক কী?’
‘তৈমুরও ওদের মতই হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা তুমি সরে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই ঘটে। তবে, অন্যদের থেকে সে অনেকটা বেশিই এগুতে পেরেছে।’ মিস্টার টাটার কথায় গম্ভীর ভাব ফুঁটে উঠেছে।
‘ভেঙ্গে বলুন।’ বুঝতে না পেরে বলল ফারহান।
‘অন্যরা যেখানে শুধু ভাবতো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার, তৈমুর সেখানে সফলই হয়েছে। রাশিয়ায় ইউক্রেনের এক গুপ্ত সংঘের একটা মোটা অংকের ডিল হওয়ার কথা ছিল আমার। বড় বড় কাজগুলো সবসময়ই তৈমুর সামলায়। সেটা তুমি জানোই। এগুলোর সাথে তুমিও থাকতে। তুমি যাওয়ার পর ঐটাই প্রথম বড় কাজ ছিল আমাদের। তো, ডিলের দিন – ইউক্রেনের ঐ সংঘের হাতে তৈমুর অস্ত্রের শিপমেন্ট তুলে দেয়।’
‘এটাই তো হয় সবসময়। এখানে তৈমুরের সফল হওয়ার ব্যাপারটা আসলো কোথা থেকে?’
‘ঐ শিপমেন্টে অস্ত্রের প্রায় তিনভাগের দুই ভাগ ছিল নকল। এতে শুধু আমার বড় অঙ্কের টাকাই লোকসান যায়নি, সাথে গিয়েছে আমার বিজনেস রেপুটেশনও। ইউরোপের ঐ দিকটায় আর কখনোই ব্যবসা সেইভাবে দাঁড় করাতে পারিনি আমি।’ বলে থামলেন মিস্টার টাটা।

ফারহান চুপ করে আছে। মিস্টার টাটা এখনো সব বলে শেষ করেননি। ‘এরপর থেকে তৈমুরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে সে। সেই সাথে আমার অস্ত্রের সেই দুই ভাগও ফিরে পাইনি কখনো। তিনটা বছর ধরে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমার লোকগুলো, কিন্তু তার কোন অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু……’

নড়েচড়ে বসলো ফারহান। মিস্টার টাটা বলে যাচ্ছেন, ‘চার-পাঁচদিন আগে এদেশেই তাকে দেখতে পেয়েছিল আমার এক লোক। তবে তার কাছে পৌছানো সম্ভব হয়নি। এর আগেই সে আবার গায়েব হয়ে যায়। এর একদিন পর থেকে আমার ঐ লোককেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিশ্চিতভাবেই তৈমুর তাকে সরিয়ে দিয়েছে। ঠিক তার পরেরদিন মানে দুইদিন আগে আমার আরেকটা লোক তাকে ঠিক একই জায়গায় দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু সেও পৌছাতে পারেনি তার কাছে। প্রথমজন তবুও তার ছবিটা তুলতে পেরেছিল। দ্বিতীয়জন সেই সুযোগটাও পায়নি। সেও নিখোঁজ হয়ে আছে। তবে এইটুকু নিশ্চিত যে সে এখনো কাছে ধারেই আছে। কেন আছে, সেটাও ভাল করেই জানি। এজন্যই তোমাকে ডেকে আনা।’

একটু শিউরে উঠলো ফারহান। তৈমুরের সাথে তার অনেকদিন যোগাযোগ নেই ঠিকই, তবে তৈমুর তার ভাল বন্ধু। সে তার জন্য যা করেছে সেটার জন্য আজীবন ঋণী ফারহান। মিস্টার টাটা তাকে কেন ডেকেছেন সেটা সে ভাল করেই বুঝতে পারছে। ‘কাজটা কী আমার?’

‘তৈমুরকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ধরে আনতে হবে। তারপর, তুমি যেই কাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলে তাই করতে হবে।’ হেসে বললেন মিস্টার টাটা।

বন্ধুকে এইভাবে ঋণ পরিশোধ করতে হবে তা কল্পনা করেনি কখনো ফারহান। তার ভিতরের স্বত্তা তাকে কাজটা করতে মানা করছে। ‘আমাকেই করতে হবে? এসবের জন্য তো আপনার লোকজনই আছে।’
‘আছে। কিন্তু তারা কেউই ফারহান না। তুমি সেরাদের একজন। সেই সাথে তৈমুরের সাথে তোমার সম্পর্কও ভাল। আমার অন্যান্য লোকজন যেখানে তার কাছেও ঘেষতে পারবে না, তুমি সেখানে সহজেই মিশে যেতে পারবে। সেজন্যেই তোমাকে প্রয়োজন।’

কোন কিছু বলতে পারছে না ফারহান। স্তব্ধ হয়ে আছে। কাজটা করায় কোন আগ্রহ নেই তার।

তাকে ইতস্তত করতে দেখে মিস্টার টাটা বলে উঠলেন, ‘তোমাকে তো তোমার স্ত্রীর কথাও ভাবা লাগবে ফারহান।’ বলে বিদঘুটে ভাবে হেসে উঠলেন মিস্টার টাটা।
রাগে গর্জে উঠলো যেন ফারহান। ‘ওর এর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। ওর যেন কিছু না হয়।’
‘তুমি কাজটা করলেই আর কিছু হবে না।’

শেষমেশ ফারহান মেনে নিতে বাধ্য হল। ‘আচ্ছা।’

‘ও হ্যাঁ, তুমি কাজটার জন্য খুব বেশি সময় পাচ্ছো না। আজ রাত বারোটার আগেই তৈমুরকে খুঁজে বের আমার কাছে আনতে হবে। তৈমুর শুধু আমার ব্যবসায় ধ্বস, অস্ত্র লুকানো এসবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সে ঐ ডিলে পাঁচশো মিলিয়ন ইউরোও তার কাছে। আজকের দিন পার হলে ঐ টাকা আমি আর ফিরে পাব না। এখন রাত তিনটার মত। তাই যা করার তোমাকে এই বাকি একুশ ঘন্টার মাঝেই করতে হবে।’

‘একুশ ঘন্টা?’ ফেটে পড়লো ফারহান। ‘আপনার লোকজন যেখানে তিনবছর ধরে খুঁজে পায়নি, সেখানে আমি একুশ ঘন্টায় কীভাবে পারব?’
‘তোমাকে পারতেই হবে। তোমার স্ত্রীকে আরেকবার দেখতে চাইলে এই সময়ের মাঝেই করতে হবে কাজটা। দায়টা আমার যতটুকু, তোমারও ঠিক ততটুকুই। যদি বারোটার থেকে সময় এক মিনিটও বেশি সময় নাও, তাহলে তোমার স্ত্রীকে দেখার আশা ছেড়ে দাও।’

একদম বাকশূণ্য হয়ে পড়েছে ফারহান। কথা বলার কোন শক্তিই অবশিষ্ট নেই আর তার। মিস্টার টাটার ফাঁদে ভাল মতই আটকে পড়েছে। মুক্তির একমাত্র উপায় সময়ের মাঝে কাজ শেষ করাটা। সেটাও যদি মিস্টার টাটা তার কথা ঠিকমত রেখে থাকেন।

‘তৈমুরকে যেখানে দেখা গিয়েছিল, তোমাকে সেখানেই ছেড়ে দেওয়া হবে। এরপর থেকে কাজটা তোমার। দরকারী যা যা লাগে সেগুলোও তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে। তবে, সারাদিনের পরিশ্রমে তুমি বেশ ক্লান্ত। মাইন্ড শার্প রাখার জন্য তোমার ঘুমের প্রয়োজন।’ বলে হাসলেন মিস্টার টাটা।

এতক্ষণে ফারহানের নজর পড়লো চায়ের কাপের দিকে। চোখে তুলে তাকালো মিস্টার টাটার দিকে। তাঁকে হাসতে দেখছে সে।

ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হওয়া শুরু করলো ফারহানের। ঢলে পড়লো সে।

(চলবে)

** বানানে কিছু কিছু জায়গায় ভুল রয়েছে। ভুলগুলো কেউ ধরিয়ে দিলে মন্দ হবে না। ***
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৮:৩৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×