somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রঙিন পাহাড় আর স্ফটিক জলের দেশ (ভ্রমণ পোস্ট)

২৮ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার স্বল্প অভিজ্ঞতা বলে- ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করা যায়ঃ

১. ক্যামেরায় এদের ছবি আসে মারাত্মক, কিন্তু বাস্তবতার সাথে সেটার পার্থক্য থাকে আকাশ- পাতাল। উদাহরণস্বরূপ জাফলং এর কথা বলা যেতে পারে। ইন্টারনেটে জাফলং এর ছবি দেখে যে কেউ খুব আশা নিয়ে জাফলং ঘুরতে যাবে- স্বচ্ছ জলের খরস্রোতা নদী, স্ফটিক রঙা পানিতে সূর্যের ঝিকিমিকি আর নীচে রঙ বেরঙের পাথর; নদী আগলে রাখা গাঢ় সবুজ পাহাড়শ্রেণী- দূরের উচুনীচু অপূর্ব ভূমিরূপ পেছনে ফেলে কি এক ইন্দ্রজালের জগতই না আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে....
অথচ বাস্তবে সেখানে পৌছে দেখা যাবে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ার মত করেই কোন ট্রাক্টর হয়তো 'চেগায়া' কালো ধোয়া ছাড়ছে, ঠাস ঠাস শব্দে কোন যন্ত্র ভাংছে সাদা, গোল পাথর; স্বচ্ছ নদী আছে ঠিকই-তবে সেখানে দুনিয়ার মানুষ বসে গোসল করছে, হয়তো ক্যালাস কেউ সবুজ পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডটাকে পেছনে নিয়ে নৃশংস মুখে মেজে চলেছে তার উন্মুক্ত দুই বগল ....

২. এরা উপরে বর্ণিত ক্যাটাগরির বিপরীত। এসব জায়গায় মানুষ কোন আশা নিয়ে যায় না- সেটা ঐ জায়গা সম্পর্কে কম জানার কারণেই হোক, আর ঐ স্পটের 'জনপ্রিয়তা' কম থাকার কারণেই হোক। কিন্তু গিয়ে মুগ্ধ হয়; দ্যাখে- সৌন্দর্যের ঝাপি খুলে প্রকৃতি সেখানে মানুষের জন্য অপেক্ষা করে আছে। যাবার সময় শূণ্য প্রত্যাশা নিয়ে যাওয়া মানুষগুলো ফেরার সময় ফেরে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে, আর স্বপ্নের মতন সেই স্মৃতি বয়ে বেড়ায় সারাটা জীবন। (এ রকম স্পট হিসেবে সিলেটের লোভাছড়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমি যদিও সেখানে যাই নি, কিন্তু আমার ছোটভাই ইতোমধ্যে ঘুরে এসেছে। তার কাছেই অদ্ভূত সে স্বপ্ন-জগতের গল্প আমি শুনেছি)
ঘোরাঘুরির ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা ফিলসফি আছে, আর সেটা হোল- উপরের ১ কিংবা ২- যেটাই হোক না কেন আমি সব ক্ষেত্রেই মুগ্ধ হই (কিংবা অন্ততঃ মুগ্ধ হবার ভান করি)। কারণটাও খুব সহজ- কোন গ্রুপের সাথে ট্যুরে গেলে একটা স্পট সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য নিঃসন্দেহে অন্য সবার মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে। তাই শুধু শুধু কি দরকার....

এত দীর্ঘ ভূমিকার কারণটা হোল- ২৬ মার্চের ছুটিতে আমি বন্ধু-বান্ধবসহ গিয়েছিলাম নেত্রকোনা এবং সুনামগঞ্জ বেড়াতে। সে ভ্রমণের আনন্দটাই আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য বসেছি আজ; আর তাই এতো ভণিতা, এতো পকপক!

নেত্রকোনায় ঘোরাঘুরিটা হয়েছে মূলতঃ দুর্গাপুর উপজেলায়। বিরিসিরি পৌছে সকালের নাস্তা সেরেই আমরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি- প্রথমে চীনামাটির পাহাড়, নীল পানির লেক, রাশমণি মাতার স্মৃতিসৌধ। তারপর সোমেশ্বরী নদী, কমলাবাগান ইত্যাদি ইত্যাদি।

টংক বলতে এক প্রকার খাজনা বোঝানো হয়ে থাকে। অত্যন্ত কঠিন এবং কঠোর এই খাজনার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে বৃটিশ আমলেই প্রথম আন্দোলন শুরু করেন কমরেড মণি সিং। একসময় টংক প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের সাথে সাথে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ আন্দোলনও শুরু হয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় বৃটিশ পুলিশ কুমুদিনী নামের এক যুবতী হাজংকে ধরে নিয়ে যবার সময় তাতে বাধা দিলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান হাজং মাতা রাশমণি। তাকে এবং সুরেন্দ্র নামের আরেক ব্যাক্তিকে টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসবে আজো মানুষ স্মরণ করেন গভীর শ্রদ্ধা আর অনিঃশেষ ভালোবাসায়।


হাজং মাতা রাশমণি স্মৃতিসৌধ

চৈত্রের সোনালী রোদে সকালের চীনামাটির পাহাড় দেখে ভালো লেগেছে। ধবধবে সাদা, গোলাপি আর হলুদ পাহাড়ের সারি। মাঝে দিয়ে তার সবুজ দুঃখের মতন পানি জমে আছে। হঠাত হঠাত চৈতালি রোদে সে জামরুল-রঙ্গা পানি ঝিকমিক-ঝিকমিক করে জ্বলে। মনে হয় যেনো হাজার বছর ধরে এই হ্রদের বুকে তিল তিল করে জমা হয়েছে অমূল্য কোন রত্ন। আর সেটারই ক্ষণিক ঝলক বুঝি নির্বাক করে তোলে আমাদের মতন 'নীল পানি' দেখতে যাওয়া পর্যটকদের!






জায়গার নাম যদিও নীল পানি, কিন্তু আমরা পানির সে নীল রঙ পাই নি। 'নীল ফানি দেকছুইন?' 'না দ্যাক্লে আইয়ুইন আমরার লগে'- বলে বলে দুই পিচ্চি আমাদের প্রায় পাচ/ছয়শ' মিটার হাটালো। কিন্তু সেখানেও নীল পানি ছিলো না। সব থেকে গাঢ় রঙটা ছিলো সবুজ, সেরকমই এক লেকের পাশে গাছের ছায়ায় আমরা কিছুক্ষণ বসে রইলাম। সম্ভবতঃ টলটলে সে সবুজ লেকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই এক বন্ধু গাঢ় আবেগে গান ধরলো- "ও আমার হাসের ছাও রে....."




সেখান থেকে গেলাম সোমেশ্বরী নদী আর মেঘালয়ের গারো পাহাড় দেখতে। সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানিতে গা ডুবিয়ে বসে ছিলাম প্রায় দুই ঘন্টা। জমাট হাওয়ার মতন পরিষ্কার আর প্রশান্তির সে জল; সূর্যের আলো অপার্থিব দ্যুতিময় হয়ে সে নদীর তলদেশ পর্যন্ত পৌছে যায়। ঢেউ বদলের সাথে সাথে সোনালি রোদে চকমকিয়ে ওঠে নদীর নরম বুকের সাদা বালি-মাটি-নুড়ি। কবিদের জন্য রীতিমত মাথানষ্ট এক জায়গা !




শরীর জুড়ানো একটা স্নান সেরে এরপর গেলাম কমলা বাগান দেখতে। ঐটা তেমন আহামরি কিছু না (তার ওপর এটা কমলার সিজন ও না), তবে সেখানে একটা টিলার ওপরে উঠে দূরে গারো পাহাড়ের ছবিটা খুব দারুণ মনে হয়।





মনে হয়- আহা! যেনো কি এক অপার রহস্য আড়াল করে আছে দূরের ঐ সবুজ নিমগ্ন পাহাড়শ্রেণী!

পরদিন আমরা গেলাম নেত্রকোনা থেকে সুনামগঞ্জ। প্রায় পাচ ঘন্টার এক মটরসাইকেল যাত্রা। সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত না লিখে শুধু এটুকু বলি- শেষ এক ঘন্টা বাদে প্রথম চার ঘন্টার পুরোটুকুই ছিলো অপ্রত্যাশিত, অনন্য আর পরাবাস্তব!

এই ট্যুর নিয়ে এতো আহা উহু করার একটা গুঢ় কারণ আছে, আর সেটাই এখন বলবো! আব্বুর চাকরির সুবাদে আমার শৈশব পুরোটাই কেটেছে নেত্রকোনায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার বাবা-মা'র কাছে আমার শৈশব নিয়ে যত গল্প আমি শুনেছি- তার পুরোটাই প্রায় নেত্রকোনা কেন্দ্রিক। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে এই সোমেশ্বরী নদীর সামনেই আমার একটা ছবি আছে- আমাদের পরিবার এবং আব্বুর আরেক কলিগের পরিবারের সাথে একটা গ্রুপ ফটো! পরবর্তীতে কলেজে ওঠার পর আমার শৈশবের সেই বন্ধু, ছবির সেই ছোট্ট ছেলেটার সাথে আমার আবার দেখা হয়- তবে সেটা আরেক গল্প....

তাই নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদী, মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা স্ফটিক জলের কেবল একটা নদীর নাম নয়- সে নদীর বুকের জল গাঢ় মমতা নিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছে আমার শৈশব- বহু বহু বছর আগে। ওপারের গারো পাহাড় কেবল শান্ত, সমাহিত অপূর্ব কোন পাহাড়ই নয়। বরং এ পাহাড় ধারণ করে আছে আমার মতই অসংখ্য বঙ্গ সন্তানের ছেলেবেলা আর সে সময়ে শোনা গল্প, আমাদের শৈশবের রূপকথা!

ভালো থাকুক মায়াবী সোমেশ্বরী, ভালো থাকুক গারো পাহাড়।
আদর-মমতার স্মৃতিতে মাখামাখি হয়ে থাকুক আমাদের সকলের শৈশব !

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ রাশমণি স্মৃতিসৌধ এর ছবিটা বাদে আর বাকি সবই আমার সহযাত্রী বন্ধুদের তোলা। রাশমণি স্মৃতিসৌধের ছবিটা নেট থেকে নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:০২
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×