somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ৮ম)

২০ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৫

নীলাদের বাড়িতে হঠাৎ আতরের সুবাস ধাক্কা দিল। সবাই যেন নাক খাড়া করে অপেক্ষায় ছিল। নীলাদের ওখান থেকে শুধু পিন্টু, ছবিকাকি, সোহেলসহ মোট ছয়জন নীলাকে সাজিয়ে দিপুর বাড়িতে ঢুকল। এদিকে দিপুকে কিছু সময় পূর্বে গোসল করিয়ে জামাইসাজে প্যান্ট-ফতুয়া পরিয়ে, খাটে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে, বসিয়ে রাখা হয়েছে। লম্বা রোগ ভোগের ফলে দীর্ঘদেহী মানুষটা খানিক কুঁজো হয়ে গেছে। দিপু কোনও কাজ না পেয়ে, ফোন টেপাটেপি করছে। এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। যেন এখুনি সুমির দজ্জাল মুখটি দেখতে পাবে। রাত হয়ে যাওয়ায় বিয়ের পর্বটি খুব দ্রুত ঘটে গেল। মঙ্গল বারান্দায় গিয়ে সুমিকে জানাল, ‘সতিনের সালাম গ্রহণ করতে, রাতেই আসবে কি না? সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, আমি এখন শুতে যাব।’

১৬

নীলা ঘরে প্রবেশের পর, দিপু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সে ফাঁকে নীলা কোলের ওপর একটা বালিশ নিয়ে, চারপাশটা নখ দিয়ে খুঁটতে লাগল। যেন রেলস্টেশনের ওয়েটিং-রুমে দেখা অপেক্ষিত কেউ। পরিচয় করবে কি না বুঝে উঠতে পারছেনা।
দিপু এতক্ষণ নীলাকে লক্ষ করছিল। নীরবতা ফেলে দিল এবার, ‘আচ্ছা নীলা, তুমি হঠাৎ এ-সিদ্ধান্ত নিলে কেন?’
নীলা নিরুত্তর।
দিপু ইতস্তত করে আবার প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি আমাকে পছন্দ করেতে? না, জেদের কারণে?...’
‘হুঁ।’
‘কী হুঁ— জেদে পড়ে?...’
‘পছন্দও করতাম।’
‘কবে থেকে?’
‘ছোটবেলা থেকেই। আপনাকে ভাললাগত...’
‘ভাললাগলেই কি কেউ এমন?...’
‘ভালবাসতেও শুরু করছিলাম যে!’
‘তাই! কত দিন?’
একটু সময় নিল। দিপুর চোখে চোখ রেখে রাঙা হল। হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমার ব্যথা আমার হয়ে জাগল যেদিন মনে...’
‘কবে, কবে? কবে থেকে ঘটল এটা, আমি তো একবিন্দু বুঝতেও পারলাম না। বা তোমার মধ্যে এমন কিছু প্রকাশও পায়নি।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল দিপু।
‘যেদিন আপনাকে প্রথম দেখতে আসি।’
‘আবার আপনি কেন?’
নীলা হেসে বলল, ‘তুমি কি খুশি হওনি?’
‘কী বলো, খুশি হব না-? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
‘তুমি আমাকে পছন্দ করতে?’
‘না-গো, না, পাড়াত ছোট বোনের মতোই দেখতাম। কিন্তু তোমার সাথে খোলামেলা কথা বলার পর, আমার কেবলই মনে হতে লাগল— এমন একটা মেয়ে— যার সাথে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করা যায়, জানালা ধরে বৃষ্টি দেখা যায়, যদি স্ত্রী হিসাবে পেতাম, কী-না ভাল হত।’
‘এবার হল তো?’
দিপু হাত বাড়িয়ে দিল। নীলা হাতটা ধরে ফেলল, আর দিপুর গা ঘেঁষে বসল। নীলা দিপুর ডান কাঁধে মাথাটা রেখে, ওর আঙ্গুল নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল।

‘নীলা একটা গান শোনাবে? তুমি তো গান গাইতে পারো। অনেক দিনের আশা...
‘চুপ করে রইলে যে?’
‘কী গান?’
‘শোনাও একটা, যেটা ভাললাগে।’
‘তোমার কোনটা পছন্দ, ব-লো-ও?’
দিপুর চোখে চোখ রেখে, নীলা ঘার কাত করে এমনভাবে বলল, যেন ঢলে পড়বে।
‘যা গাইবে তাই শুনব।’
‘তাহলে নীরব-সঙ্গীত গাই?’
দু-জনেই হেসে উঠল, আরও ঘনিষ্ঠ হল। ভাষাহীন এক সংগীতের মূর্ছনা বয়ে গেল। দুটি প্রাণ একই সাথে গেয়ে উঠল। অনেক সময়, কতটা সময় জানা নেই। কথা নেই, নড়াচড়া নেই, শুধু অনুভবের সময়।
‘নীলা?’
‘হুঁ।’ দিপুর কাঁধের মধ্যে মুখ গুঁজে উত্তর দিল।
‘গান শোনালে না?’
‘কোনটা?’
‘মনে কী দ্বিধা... বা ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী... গাও যে কোনও একটা।’
‘ছিন্ন পাতারটাই আজকে শোনাই আরেক দিন মনে কী দ্বিধা শোনানো যাবে।’

‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা—
আনমনা যেন দিকবালিকার ভাসালো মেঘের ভেলা।।
যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্ খেয়ালির কোন্ আনন্দে
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা।।
যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
তার হাতে দিই আমার ছন্দ—কোথা যায় কে জানে সে।
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
চিরদিন আমি পথের নেশায় পথেয় করেছি হেলা।।’

‘তোমার কণ্ঠ বেশ, গাইলেও সুন্দর করে। এখনও কি গান শেখো?’
‘না; তবে নিজেই চেষ্টা করি।’
‘আমি তোমাকে গানের মাস্টার রেখে দেব। পড়া-লেখা করবে আর গান শিখবে।’
নীলা গদগদ হয়ে দিপুর কোলের মধ্যে শুয়ে পড়ল। কী ভেবে আবার উঠে বসল।

দিপুর অনেক কথা জমে ছিল। কিছুদিন অসুস্থ থাকলে যা হয়। তবে অসুস্থতা নিয়ে কোনও কথাই হল না। দিপুর তো প্রায়ই মনে হচ্ছিল শরীরের সব ব্যথা ফুরিয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হল— এই ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিষয়ের মূল্যহীন কথাগুলো কি কখনও সুমিকে সে বলত? বলার মতো তেমন পরিবেশই তো কখনও তৈরি হয়নি। অথচ এগুলোই যেন কাউকে বলার জন্য, জমিয়ে রেখেছিল কত যুগ ধরে। নীলার আগ্রহ আর মনোযোগ দেখে, একটু অবাক হলেও খুশি হল অসম্ভব রকমের। এই সব এলোমেলো কথাগুলোর কী গুরুত্ব থাকতে পারে, যা নিয়ে দু-টি মানুষ রাত শেষ করে দিচ্ছে। জীবনের কোনটি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটি নয়, তা সব সময় সকলের কাছে এক রকমভাবে আসে না। মূল্যায়নটা পূর্বেই ঠিক করে রাখা হয়, তাই ঘটনা আর আমাদের সামনে ঘটনা হয়ে দেখা দেয় না।
‘তোমার কোলে একটু মাথা রা-খি-য়ি?’
মুচকি হেসে দিপু মাথা কাত করল।
অঞ্জলি ভরে নীলার মুখটা তুলে ধরতে নিয়ে, উঃ করে আর্তনাদ করে উঠল।
‘আঃ কী হল, ব্যথা দিলাম? নীলা সাৎ করে মাথা তুলল।
‘তেমন কিছু নয়। নিচু হতে গিয়েছিলাম... তুমি শুয়ে থাক, একটু দেখি।
‘হাসছ যে?’
‘না, এমনি।’ নীলা বলল।
নীলা দিপুর কোলে মাথা রেখে, দিপুর হাত দু-টো নিজের গালে চেপে ধরে, কয়েকদিন আগে দেখা স্বপ্নটা বলতে লাগল।
কোন সময় নীলার দু-চোখ বেয়ে ঘুম নামল টের পেল না। দিপু বুঝতে পেরেছে বে-ঘোরে ঘুমোচ্ছে, রইল আগের মতোই। ঘুমনোর সময় সব মানুষকেই কেমন যেন অসহায় দেখায়, আর চেহারার একটা আদুরে-ভাব চলে আসে। এ জন্যই কি, ঘুম থেকে বাচ্চারা জাগলে গদগদ হয়ে বড়রা চুমু খায়? দিপু ভাবতে লাগল, ‘কী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমচ্ছে। নীলা এতটা নিশ্চয়তা পেল কোথায়? আমাকে সে কতটুকু চেনে? প্রেম কি মানুষকে নির্বোধ করে তোলে? নাকি এটা সাহস? শুধু প্রেম কেন, যখন একটি মেয়ে বৌ হয়ে অপরিচিত স্বামীর কাছে যায়, তখন মুহূর্তের মধ্যে তাকে বিশ্বাস করে নিজেকে সমর্পণ করে। কেমন করে এটা হয়? ঘুমের মধ্যে যে আক্রান্ত হবে না— এই ভরসা সে কোথা থেকে পায়? মানব-জিনই কি সেভাবে বিবর্তিত? সামান্য কয়টি কথাকে ভর করে, যে মেয়েটি তার চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে, নতুন একটি মানুষের সাথে চলে আসে, নতুন বিশ্বাস বুকে করে, আমরা, পুরুষরা তা কি ভেবে দেখেছি কখনও? তবে কেউ কেউ বেড়াল মারতে ভুল করিনি।’

কিস্তি - ৭ম

কিস্তি - ৯ম
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৫১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×