কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের বক্তব্য দিয়েই শুরু করি। তিনি ৩/৬/১৪ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই ভালো। কোথাও কোন সমস্যা নাই। আগামী ১০ জুন ডিসি পর্যায়ে একটা বৈঠকের কথা রয়েছে। আশা করছি পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রি বলেছেন, ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে।
আহা! কি সুন্দর বক্তব্য! প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সেদিনও সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে। উনি সে খবরও শোনেননি। (১)
সীমান্তে কোন সমস্যা নাই এটিও ভুল বক্তব্য। মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত বিজিবি মিজানুর হত্যা ছাড়াও বেখেয়ালে আর গাফলতিতে সরকার স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে একদিকে ছিটমহল উদ্ধারে তৎপরতা নেয়নি; অপরদিকে মায়ানমারের জবরদখলে থাকা ২ হাজার একরেরও বেশি ভূমি সম্পর্কেও সরকারের কোনো খবর নেই। উদ্ধারের জন্য কোন কূটনৈতিক তৎপরতা নাই। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের দেড় হাজার একর জমি মায়ানমার দখল করে রাখার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি প্রথম উদঘাটন করেন হ্নীলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তৎকালীন তহশীলদার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমানা, নদীসীমানা এবং আলোচিত ভূমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। তাছাড়া তুমব্রু রেজু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে নাসাকা কর্তৃক বিডিআর হত্যা, ২০০০ সনে টেকনাফের উলুবনিয়া ডাব ফাঁড়িতে মায়ানমার নাসাকা কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ নিয়ে চরম উত্তেজনা, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ ও ১৯৯১ সনে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী হয়ে আসা নিয়ে দু’দেশের সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধাবস্থা, ২০০৮ সনের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় মায়ানমারের গ্যাস তেল ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান নিয়ে চরম বিরোধের পর মায়ানমার কর্তৃক সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে কাঁটাতারের বেড়া দেয়াসহ সীমান্ত বিরোধ ছাড়াও নাফ নদীতে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার অভ্যন্তরে ঢুকে নাসাকা কর্তৃক মাছ ধরার জাল জেলে নৌকা অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, সীমান্ত বাণিজ্যের পণ্যবাহী ট্রলারে গুলিবর্ষণ অপহরণ ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারনে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার সুযোগ থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ফলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।
সীমান্তে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ প্রস্তুতি চালালেও উত্তেজনা নিরসনে বিজিবি মিয়ানমারের মংডুতে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। যেখানে বিজিবি বিনা উস্কানিতে গুলি খেয়ে হত্যার শিকার হয়েছে সেখানে আলাপ আলোচনার কথা বলবে তৃতীয় পক্ষ। যে সংগ্রামরত দুই পক্ষের মিমাংসা করার ভূমিকা নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাবের অর্থ হল আমরা তোমাদের মান্য ও বাধ্য! তোমরা আমাদের গুলি করে মারলেও আমরা কবুতর নিয়ে তোমাদের সাথে দেখা করবো! আর রুটিন অনুযায়ী প্রতিবাদ জানাব। কিছুদিন পর মিজানুরের লাশের মাতম থেমে যাবে। আবার যখন আরেকটা লাশ পড়বে তখন আবার একইভাবে কির্তন শুরু হবে। এর নাম কি পররাষ্ট্রনীতি না নতজানু বাধ্যনীতি। যেখানে সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন দুর্বল করে দেখা হয়। আমাদের মনে হয় গা সয়ে গেছে। ভারতের কাছে গুলি খেয়ে মরতে মরতে অভ্যাস হয়ে গেছে! তাই সীমান্তে লাশ পড়লে আমাদের গায়ে বিঁধে না। আমি তো ভালো আছি। দ্যাটস এনাফ। তাই মিয়ানমার এরকম আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রচারণাটা এরকমঃ-
By 2020 Myanmar will beat Bangladesh in Economically. We already beat them in military. We are now more powerful than Bangladesh. (২)
(১)
(২)
(৩)
ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, "Myanmar Navy sent just 3 FAC-gun boats, and one OPV. 1FAC in the Natt-rivers and other 3-s near border. Next time we send our Frigates Liar Bangladeshi"(১)
"Come Bangladesh and test this bullets of Myanmar"(৩)
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে খুবই নাজুক তা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, মিয়ান্মারের কি করে এত সাহস হয় যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার মত ধৃষ্টতা দেখায়। তারা গুলি করছে বাংলাদেশ সীমানায়। আবার তারা এসে আমাদের সীমানায় ঢুকে সেই লাশ নিয়ে গেছে। এটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের চরম লঙ্ঘন (৩)। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এতে কোথায় গিয়ে ঠেকল এবার দেখেছেন। যদিও ভারতীয় বি.এস.ফ এই লঙ্ঘন প্রতিনিয়তই করে। কিন্তু আমরা তো কড়া জবাব দিতে পারতেছি না। আমরা ভারতের ক্ষেত্রে যেরকম নতজানু ছিলাম মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও সেই নতজানু রূপই দেখাচ্ছি। এর কারণ ঐ যে আমি তো ভালো আছি! আর কি চাই জীবনে আমার!
এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মিয়ানমারের এই বর্তমান অবস্থান কিভাবে হল। তারা এত দুঃসাহস দেখানোর সাহস কোথায় পেল। একটু পেছনে ফিরে যাই।
১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল মায়ানমারের। মায়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি)-এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন। ১৯৭৮ সালে চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং মায়ানমার সফরে আসেন। ১৯৮৬ তে সিপিবির ওপর থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন তুলে নেয় চীন। বৈরী সম্পর্ক দারুণভাবে সহযোগিতার দিকে নতুন মোড় নেয়। তারা তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগসহ বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। এ সময় চীন সামরিকভাবে মায়ানমারকে সহায়তা করতে থাকে। ১৯৮৯ সালে মায়ানমার চীন হতে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। ভারতের ওপর ভূরাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা বাড়াতে মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় চীনের। মায়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে মায়ানমারকে বহুমুখী সাহায্যের হাত খুলে দেয় চীন। চীনের সমর্থন মায়ানমারের সামরিক জান্তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে। তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে দেশের মধ্যে যেমন তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি একটি শক্তিশালী সমরশক্তির দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চীনের সর্বোচ্চ সহায়তা পেতে থাকে। (৪)
এছাড়া দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ায় জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো মার্কিন পন্থী হওয়ায় চিনের এই অঞ্চলে বন্ধুর দরকার পড়ে। যাতে চিন এই অঞ্চলে তার আধিপত্য ধরে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও গুরুত্বপুর্ন বলে বিবেচিত। তাই তারা মিয়ানমারের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ায়।
আবার এই অঞ্চলে ভারতও আঞ্চলিক লিডার হয়ে নেতৃত্ব দিতে চায়। নিজেকে সুপার পাওয়ার হিসেবে দেখতে চায়। তাই দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ায় ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে মিয়ানমার বন্ধু হওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত। এছাড়া মিয়ানমারের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। যেখানে ভারতীয় কোম্পানিগুলা কাজ পায়। মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু অভিজাত ও সামরিক জান্তার কাছে। তাই সামরিক জান্তাকে খুশি করাতে ও বন্ধুত্ব গড়তে পারলে মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদে ভারত কিছু ভাগও পাবে। তা সম্ভব হবে তাদের অর্থনৈতিক বাজারে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। এছাড়া চাইলে বন্ধুরাষ্ট্রে ঘাঁটিও করতে পারবে। এই সুযোগ ভারত হাতছাড়া করতে চায় না। আবার আমেরিকাও চায় এই অঞ্চলে চিনকে টেক্কা দিতে ভারত উঠে আসুক। এজন্য আমেরিকার পলিসি হল ভারতের পক্ষে। ফলে চিন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মিয়ানমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়ক শক্তি। এজন্য ভারত, চিন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হলেও কড়া কোন কথা বলেনি। অবৈধ সামরিক জান্তা সব পক্ষকে ম্যানেজ করেছে। রোহিঙ্গা বিতারন প্রজেক্ট সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ফলাফল হচ্ছে বর্তমান এই ধৃষ্টতাপুর্ন ব্যবহার।
বর্তমানে মিয়ানমার যে ঔদ্ধত্ব দেখিয়েছে তার জন্য তাদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে হবে। মিয়ানমারের সাথে যে সমস্ত অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে তার দ্রুত সমাধান না করতে পারলে তারা আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। আজকে বিজিপি মিজানুররে হত্যা করছে সামনে আরও এরকম করবে যদি না তার রাশ টেনে না ধরা হয়। সামনে তারা বাংলাদেশী হত্যা করে KSO বলে চালিয়ে দেবে। তাই মিয়ানমারকে কোন ছাড় নয়। একশন এর পাল্টা সমান রিএকশন দেখাতে হবে। আমরা দুর্বল নই যে সবাই আমাদের ঘাড়ে উঠে কান টানতে থাকবে। তাই জন দাবি একটাই দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি বাদ দিতে হবে।
লিংকঃ
(১) Click This Link
(২) Click This Link
(৩) http://www.youtube.com/watch?v=JUonLmsWsPI
(৪) Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪