somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেই তিমিরের রজনীঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল ট্র্যাজেডি

২৩ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০২ সালের জুলাই মাসের আজকের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পেটোয়া পুলিশ বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় যে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিল এবং সেই হামলা মামলায় আহত ও গ্রেফতার হওয়া সকল প্রতিবাদী, আন্দোলনে যোগ দেওয়া সকল সহযোদ্ধার স্মরনে আজকের এই লেখা। পাশাপাশি নন্দিত কথাসাহিত্যিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষক যিনি সবসময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে গর্ববোধ করতেন এবং সর্বদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চাসনে তুলে ধরেছেন সদ্যপ্রয়াত ড হুমায়ুন আহমেদ'র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ঘটনার সুত্রপাতঃ শামসুন্নাহার হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক সুলতানা শফির দায়িত্বের মেয়াদ তখনও শেষ হয় নি। শুধুমাত্র পূর্ববর্তী সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত বলে তাঁকে পদত্যাগের চাপ দেয়া হয়। অপরদিকে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া হল শাখা ছাত্রদলের সেইসময়ের সভাপতি লুসি(বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত), সাধারন সম্পাদক শান্তা(বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার), শেলী(হল শাখা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি), তানজিন চৌধুরী লিলি(পরবর্তীতে হল শাখা ছাত্রদলের সভাপতি, বর্তমানে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ) নেত্রীদের হলে থাকার সুযোগ দেওয়া নিয়ে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে হল প্রশাসনের মতবিরোধ চলছিল। ছাত্রদল নেত্রীদের ভাষ্যমতে ভিসি তাদের হলে থাকার অনুমতি দিয়েছিল, কিন্তু হল প্রশাসন ও সাধারন ছাত্রীদের অবস্থান ছিল ছাত্রত্বহীনদের হলে থাকার সুযোগের বিপক্ষে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড সুলতানা শফিকে তার মেয়াদ পর্যন্ত হলের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া এবং না দেওয়া নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসন চাইছিল তাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরিয়ে দিতে। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। খোদ উপাচার্য পদের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। রাতের আধারে অধ্যাপক ড এ কে আজাদ চৌধুরীকে সরিয়ে রীতিমত দখল করে নেয়া হয়ছিল উপাচার্য পদটি। গদিনসীন হয়েছিলেন অধ্যাপক ড আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী। তিনি ক্ষমতায় বসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বে তার ও বিএনপি-জামায়াতের পছন্দের ব্যক্তিদের পদায়ন শুরু করেছিলেন। শামসুন্নাহার হলেও সেই পদায়নের ধারাবাহিকতাই চালাতে চেয়েছিল। সেজন্য প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ নানান অনিয়মের অভিযোগও আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রাধ্যক্ষ সাহসের সহিত সেসব অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং হলের সাধারান ছাত্রীরাও প্রাধ্যক্ষকে সহযোগিতা করেন। এতেই শুরু হয় হল শাখা ছাত্রদল নেত্রীদের সঙ্গে সাধারন ছাত্রীদের বাগবিতন্ডা। এই বাগবিতন্ডাকে ছাত্রদলের নেত্রীরা ক্রমেই হুমকী ও শারীরিক নির্যাতনের মতো ন্যাক্কারজনক পর্যায়ে নিয়ে গেলে গুটিকয় ছাত্রদলের নেত্রীর বিপরীতে প্রাধ্যক্ষসহ হলের বিপুল সংখ্যক ছাত্রীদের একীভুত করে। চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে হল প্রশাসনের ঠান্ডা লড়াই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের যেখানে রয়েছে সরকারের সকল সহযোগিতা, পুলিশসহ ছাত্রদলের সশস্ত্র ক্যাডার মাস্তান, বিপরীতে হল প্রশাসনের প্রাধ্যক্ষ ও সাধারন ছাত্রীদের ছিল শুধু সততা ও সাহস। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসন বিশেষ ক্ষমতাবলে হলের প্রাধ্যক্ষে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে চাইলে সাধারন ছাত্রীরা নিরুপায় ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। কারন ইতিমধ্যে সাধারন ছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্রদলের মাস্তান নেত্রীদের বৈপরীত্য অবস্থান সুষ্পষ্ট হয়েছিল। যে কারনে সাধারন ছাত্রীরা অনন্যেপায় হয়ে প্রাধ্যক্ষের পক্ষে অবস্থান নেয়।

বর্বরোচিত নির্যাতনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসন উদ্ভুত সংকটের সমাধান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর ও সহকারী প্রোক্টরদের হলে পাঠায় আলোচনার জন্য। কিন্তু তারা হলে এসেই ছাত্রদল নেত্রীদের সঙ্গে পূর্ব পরামর্শ অনুযায়ী সংকটের একপক্ষীয় সমাধানের চেষ্টা চালায়। যার ফলে সাধারন ছাত্রীরা তাদের নিরাপত্তাহীনতা আরো বেশি অনুভব করে। এসব কারনে শামসুন্নাহার হলের ছাত্রদলের নেত্রী লুসি, শান্তা, শেলী ও লিলিসহ অন্যান্য বহিরাগত ছাত্রদল নেত্রীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ ছাত্রীদের নাভিশ্বাস চরমে ওঠে। এর মধ্যেই হলের চারপাশ পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে সাধারন ছাত্রীদের রীতিমত হুমকী দেওয়া হয়। কতিপয় আবাসিক শিক্ষকসমেত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরিয়াল বডি ছাত্রদল নেত্রীদের কক্ষে গিয়ে আলোচনা করলে সাধারন ছাত্রীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। এই নিরপরাধ ছাত্রীদের জানা ছিল না যে, স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্থানী প্রেতাত্মারা এখনো বেচে আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের দিবাগত রাতে পাকবাহিনী অসহায় বাঙালির উপর যে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছিল সেটার পুনরাবৃত্তি যে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বংলাদেশেও ঘটতে পারে এটা ছিল অকল্পনীয়। তাই তো প্রতিবাদে সকল ছাত্রী নিজ নিজ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে। স্লোগানে, প্রতিবাদে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। রাত যত গভীর হতে থাকে ছাত্রীরাও অধিক প্রতিবাদী হতে থাকে। অপরদিকে হায়েনার দল রাতের গভীরতার অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে। অবশেষে ২২ জুলাই দিবাগত রাত ১ টার পরে(২৩জুলাই) কিছুটা শান্ত হলে প্রাধ্যক্ষ তারা বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হলের গেইট ভেঙে সাধারণ ছাত্রীদের উপর নজিরবিহীন বর্বরোচিত হামলা চালায় তৎকালীন সরকারের পুলিশ। হামলাকারী পুরুষ পুলিশদলটির নেতৃত্ব দেয় ঢাকার (দক্ষিণ) তখনকার এডিসি আব্দুর রহীম। সে রাতে পুলিশের অশ্লীলতা, নিষ্ঠুরতা আর অবিবেচনার শিকার হয় শত শত সাধারণ ছাত্রী। রুমে ঢুকে, বা করিডোরে, যাকে যেখানে পেয়েছে, নির্বিচারে পিটিয়েছে পুলিশ। এরপর ফৌজদারি মামলার আসামীর মতো ধরে নিয়ে রেখেছে হাজতে। অথচ যে মেয়াদোত্তীর্ণদের নিয়ে ঝামেলার শুরু সেই ছাত্রদল নেত্রীরা ছিল বহাল তবিয়তে। ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্থান আমলে এমনকি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পাকবাহিনীর হামলাও এতটা বিভতস ও ভয়ংকর ছিলনা বলে অনেকেই পরবর্তীতে মত প্রকাশ করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীও যেখানে একটি ছাত্রী হলে এভাবে হামলা করতে সাহস করেনি, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে খালেদা-নিজামী জোট শাসনের আমলে ঘটলো সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি। এই হামলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর রোকেয়া হলে সংগঠিত একটি হামলা-ডাকাতির ঘটনার কথা তখনকার হলের সুপার জাহানারা বেগম উল্লেখ করেছেন ঠিক এইভাবে, “রং বেরঙের অদ্ভুত পোশাক পরা কয়েকজন লোককে এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে দেখলাম। সবাই মুখোশ পরিহিত। গায়ে গেঞ্জি, পরনে জাঙ্গিয়া হাফ প্যান্ট, হাতে পিস্তল আর উন্মুক্ত-উদ্যত ছুরিকা, এর সাথে আবার স্টেনগান ও হকিস্টিক, সবাই উর্দুতে কথাবারতা বলছিল। এই লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডারা হলের বাইরে সুরক্ষিত বেষ্টনি সৃষ্টি করে হলে ঢোকে। তারা মেয়েদের কক্ষে ঢুকে সবার রুম থেকে সোনার গহনা, নগদ টাকা-পয়সা, কাপড় চোপড় নিয়ে যায়।” ২০০২ সালেও অনুরুপ হামলা, নির্যাতন ও গ্রেফতারে হতবিহব্বল হয়ে পরে ছাত্রসমাজ তথা দেশবাসী। সাধারণ ছাত্রীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে অপ্রত্যাশিতভাবে বর্বরোচিত পুলিশি হস্তক্ষেপ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পুরুষ পুলিশ দিয়ে ছাত্রী নির্যাতনের প্রথম নিদর্শন। অব্যবস্থা আর অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নিরাপরাধ ছাত্রীরা সেদিন পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক রাতে হামলা হওয়ায় পরেরদিনের সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশ পায়নি। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যানে দেশবাসী সকালেই জানতে পারে। সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের অবিভাবক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। প্রতিবাদের ঢেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সমগ্র দেশেই ছড়িয়ে পড়ে আপন গতিতে।

আন্দোলন, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধঃ পরদিন ২৩ শে জুলাই সকাল থেকেই সমগ্র ক্যাম্পাসে ক্রীয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠন ব্যাপক প্রতিবাদী হয়ে উঠে। সরকারের পেটোয়া বাহিনী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ব্যতিত সকল ছাত্র সংগঠন তাদের নিজ নিজ ব্যানারে আন্দোলন সংগ্রাম চালানোর ঘোষনা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি সচেতন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদী মিছিলের উপর নানা রকমের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন চালানো হয় শুরু হয় ২৩ জুলাই থেকেই। সমগ্র ক্যাম্পাস পরিনত হয় রণক্ষেত্রে। পরেরদিন ২৪ জুলাই প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, রাবার বুলেট চালনা ও লাঠি চার্জ করে পুলিশ। অনেক ছাত্র আহত হয় তাদের নিজেদের ক্যাম্পাসে। অথচ তখনকার ব্যর্থ উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর সাহসী আন্দোলনকে ‘বহিরাগতদের আন্দোলন’, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ইত্যাদি উপনামে আখ্যায়িত করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। ২৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্র-ছাত্রীদের অবিলম্বে হল ত্যাগের নির্দেশ দেন। পুলিশ এবং ছাত্রদলের মাস্তানদের দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। এ যেন সেই একাত্তরকেই মনে করিয়ে দেয়। একাত্তরের সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র অধ্যাপক ড রফিকুল ইসলাম বলেছেন এভাবে, “গনহত্যার পর হলগুলো ছাত্র-ছাত্রী শুন্য হয়ে পড়ে। অনেকে আবাসিক এলাকা ছেড়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ আবাসিক এলাকাগুলো পরিত্যক্ত, ভুতুড়ে ও জনমানবহীন বিরানভুমিতে পরিনত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আকাশে তখন শুধু চিল, শকুন আর মাটিতে মাংস লোলুপ কুকুর আর বিহারি রাজাকারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। ইপিআর(ইষ্ট পাকিস্থান রাইফেলস) এর বদলে তখন ‘ইপিকাফ’ বা ‘ইষ্ট পাকিস্থানি সিভিল আর্মড ফোর্স' গঠিত হয় শুধু বিহারিদের নিয়ে। শুন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই ফোর্স এবং পরে রাজাকার বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্পাসে মোবাইল পেট্রোল বজায় রাখে।” তেমনি অবস্থা দেখা গেছে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতার ৩১ বছর পরে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০০২ সালের সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ জন্মের বিরোধীতা কারীদের একাংশ। মন্ত্রীসভায় ছিল তাদের অংশীদারিত্ব।
এতসব হামলা-মামলা পরেও হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী তাদের স্বঘোষিত ‘মুক্তাঞ্চল’ (রোকেয়া হলের সামনের রাস্তা) এবং শহীদ মিনারে অবস্থান করে আন্দোলন এবং অনশন চালিয়ে যেতে থাকে। ২৯ তারিখে আবার চলে পুলিশি হামলা । আহত হয় অর্ধশত ছাত্র, শিক্ষক আর সাংবাদিক। সারাদেশের জেলায় জেলায় অবিভাবকগন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীগন বিক্ষোভ করে, অনশন করে। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াতের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমন চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পাহারা বসায় যাতে কোনো ছাত্র আন্দোলনে শরিক হতে না পারে। কিন্তু গনজোয়ারের আন্দোলন তার নিজ গতিতে সফলতার দিকপানে এগিয়ে যায়। আন্দোলন আর প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় ঘটনার দীর্ঘ আট দিন পর ০১ আগস্ট উপাচার্য আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোন কূলকিনারা না পেয়ে তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে পদত্যাগে করাতে বাধ্য হন।

সরকারের পদক্ষেপঃ সরকারের উচ্চ মহল থেকে কয়েকটি তদন্ত কমিটি করা হয়। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও করা হয়। দিনের পর দিন তদন্তের নামে সময়ক্ষেপন ও স্বাক্ষ্যপ্রমান নিয়ে যে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয় সেগুলো আজও অন্ধকারেই। সে সময়ের সরকার এখন বিরোধী দলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন মামলায় জেল খেটেছেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবর বিভিন্ন মামলায় এখন কারাগারে। স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালনকারী সে সময়ের মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড সা’দত হুসাইন অবসর গ্রহনের পরেও পিএসসি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে কিছুদিন আগেই পুনঃঅবসরে গেলেন। পুলিশের আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী এখন অবসরে, এডিসি আব্দুর রহীমসহ আক্রমন চালানো অন্যান্য অফিসারদের অনেকেই এখনো হয়ত চাকুরীরত রয়েছেন। আন্দোলনের বিরোধীতাকারী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাদের যারা প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের মারধোর ও হুমকী প্রদান করেছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে সরকারী চাকুরী বা ছাত্রদলের বড় নেতা হয়েছেন। সে সময়ের আন্দোলনকারীদের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগসহ অনেকেই ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুগত সংগঠন। বর্তমানে ক্ষমতাসীন সকল রাজনৈতিক দলই তখন আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষনা করেছিলেন। সেই ঘটনার সঠিক বিচার কী হবে বাংলার মাটিতে?

আন্দোলনের নতুনত্ব ও আমার মুল্যায়ন সেই আন্দোলন থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। একমাত্র সরকারের পেটোয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ব্যতিত ক্যাম্পাসে ক্রীয়াশীল সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে জোরালো ভুমিকা রাখে। তারমধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ(জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, প্রগতির পরিব্রাজক দল(প্রপদ), ছাত্র সমিতি, ছাত্র ফোরাম উল্লেখযোগ্য। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সমুহ একত্রিত হলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ কয়েকটি সংগঠন তাদের নিজস্ব ব্যানারে আন্দোলন করলেও সম্মিলিত আন্দোলনের অগ্রভাগে কোনো ছাত্র সংগঠন ছিলনা। নির্যাতন বিরোধী ছাত্রছাত্রী’দের ব্যানারে প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত নেতাকর্মী্রাই সম্মিলিত ফ্রন্টে যোগ দেয় সংগঠনগুলোর কৌশল হিসেবে। যে কারনে এই আন্দোলনের সফলতা কোনো ছাত্র সংগঠনই একক বা যৌথভাবে দাবী করতে পারেনা। কেননা, এই আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জোরালো ভুমিকা রাখে। উপরন্তু শিক্ষক সমিতি সহ ক্যাম্পাসের সকল কর্মচারীরাও যোগ দেয় আন্দোলনে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ অপরাপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল আন্দোলনেই রাজপথের আগ্রভাগে সরাসরি রাজনৈতিক দল এবং দলের নেতা-করমীরা নেত্রত্ব দিয়েছে। সাধারন মানুষ যে কোনো সংকটে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের স্মরনাপন্ন হয়েছে। হয়ত এখনো হয়। কিন্তু পার্থক্য হলো আগে নেতারা নিজেরাই অগ্রভাগে থাকতো কিন্তু শামসুন্নাহার হলের আন্দোলন থেকে দেখা গেছে রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্রিশ্যপট বদলিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন এবং নেতারা নিজেরাই আন্দোলন ও প্রতিবাদের অগ্রভাগে সুশীল ও সাধারন শ্রেণীকে এগিয়ে দিয়েছে। এর অন্যতম কারন, সবসময়েই ক্ষমতাসীন দলগুলো যেকোনো যৌক্তিক দাবীর আন্দোলনকেও শুধুমাত্র বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলনের সিড়ি হিসেবে মুল্যায়নের কারনেই এমনটি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আন্দোলন, তথাকথিত সেনা-তত্বাবধায়কের সময়ের আগস্টের আন্দোলন এবং সাম্প্রতিককালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের আন্দোলন প্রণিধানযোগ্য। এসবের একটি আন্দোলনেও রাজনৈতিক দলসমুহ আড়ালে সহযোগিতা করলেও প্রকাশ্যে যেতে পারেনি। দলের অপেক্ষাকৃত অপরিচিত মুখগুলো আন্দোলনে সরাসরি জড়িত হলেও অতি পরিচিত বা নেতারা নিজেদের বরাবরই আড়াল করে রাখছেন। ভাবীকাল হয়ত এই বিষয়টির সঠিক মুল্যায়ন করতে পারবে। আমার ভাবনাটুকুই শুধু উল্লেখ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১:৫৬
৫৭টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×