
(এক)
আজকে যেন টাকাটা দিয়ে দেয়, স্নেহা মনে মনে প্রার্থনা করে। এই মাসে টিউশনির টাকাটা দিতে কেন যে এত দেরি করছে ওরা(?)। অথচ এই মাসেই ওর দরকার বেশি। নিবিড়ের জন্মদিনের জন্য সেই কবে থেকে ভেবে রেখেছে। একটু একটু করে প্রতিমাসের টাকা থেকে বাঁচিয়েছে। ‘মিস এটা বুঝতে পারছি না’, টুপুলের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে স্নেহার। টুপুল আগামী বছর ক্লাস ফাইভে উঠবে। কঠিন পিইসি পরীক্ষা দিতে হবে, তাই ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলেও ওর মা টিউশন বন্ধ করেননি। স্নেহা দেখে নিয়ে হালকা একটা ধমক দিল, ‘কেন এটা তো তিন নাম্বার অঙ্কটার মতই, আরেকটু চিন্তা করো’। এমনিতে টুপুল বুদ্ধিমান ছেলে, দ্রুত বুঝে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে মাথা খাটাতে চায় না। মিস আছে করে দেবে; এমন রেডিমেড চায়। টুপুলের একটা ছোট বোন আছে ঝুপুল। তিন বছর বয়স। এটা কোন নাম হল (!), স্নেহার খুব হাসি পায়। ওদের বাবার বিশাল বপু দেখে স্নেহা মনে মনে ছড়া বানিয়েছে,
বাবা হলেন বপুল,
ছেলের নাম টুপুল,
কন্যা নাকি ঝুপুল,
হাহা হেসে মরি দুকূল।
ঝুপুল কেন জানি স্নেহার কাছে জামা পড়তে খুব ভালোবাসে। পানি দিয়ে গা ভিজিয়ে দিনে কয়েকবার জামা বদলানো ওর অভ্যাস। আর স্নেহা পড়াতে গেলে ওর গায়ের জামা শুকনো থাকলেও সে আরেকটি জামা নিয়ে স্নেহার কাছে যাবে আর নাকি স্বরে বলবে, ‘ জামাটা একটু পরায় দ্যাও তো’। এই দুটি বাচ্চার প্রতি স্নেহার অনেক মায়া জন্মে গ্যাছে। তাই টাকা বেশ কম পেলেও স্নেহা টিউশনিটা ছাড়ে না। টুপুলের মা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন। কলা, বিস্কিট, পানি আর চা। স্নেহা বুঝল আজ টাকাটা পাবে, কারণ, একমাত্র যেদিন সম্মানী দেয় সেদিনই টুপুলের মা নিজ হাতে ট্রে নিয়ে ঢোকেন। মহিলা বললেন, ‘স্নেহা, এই মাসে আমার শরীরটা খারাপ হল- তুমি তো সবই জানো, অর্ধেক এখন রাখো, বাকিটা কিছুদিন পরে নিও’। স্নেহার মন চট করে খারাপ হয়ে গেলো, কিন্তু হাসি মুখ করে টাকাটা নিয়ে নিল। অন্য সময় হলে ওর এত মন খারাপ হতো না। এই বিশেষ মাস বলেই হল, নিবিড়ের সাথে সম্পর্কের পর এটাই ওর প্রথম জন্মদিন হবে। কি আর করা, বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্নেহা ভাবতে লাগলো কি করা যায়। ডিসেম্বরের বিকেলের হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ায় কোথাও একটি কোকিল ডেকে উঠলো। স্নেহা অবাক হল, এই সময় কেন কোকিল ডাকছে ! প্রকৃতি বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছে।
(দুই)
রফিক সাহেব তাঁর রিভলভিং চেয়ার ঘুড়িয়ে নিবিড়ের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এত বড় হয়ে গেছেন এখনো কি সব জন্মদিন বলেন, এসব তো বাচ্চাদের ব্যাপার । আর এখন বছর শেষে ক্লোজিং টাইমের কত কাজ ভালো করেই জানেন, এই সময় আপনার কাছে এমন দায়িত্বহীন আবেদন মোটেই প্রত্যাশা করিনি’। নিবিড় একটা ঢোঁক গিললো। জীবনে কোনদিনই তার জন্মদিন পালন করা হয়নি। বন্ধুদের কখনো তারিখ জানায়নি আর আগের দুটো প্রেমের একটাও ছয়মাসের বেশি টেকেনি। জন্মদিন পালনের সুযোগই আসেনি। এবার স্নেহার উচ্ছলতা ওর মনেও জন্মদিন পালনের যথেষ্ট আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছে। কিন্তু বসকে কিছু বলার সাহস ওর নেই। মুখ কাঁচুমাচু করে নিবিড় উঠে দাঁড়ালো। রফিক সাহেব সেটা লক্ষ করলেন। একটু করুণা হল বোধহয়। দরোজার কাছে যেতেই নিবিড়কে ডাক দিলেন, ‘এক কাজ করুন, আজকে দুই ঘণ্টা ওভার টাইম করে যান, কালকে এসে দুপুর দুইটায় চলে যাবেন। এর বেশি ছুটি দেয়া যাবে না’। যাক, তবু তো পাওয়া গেলো। নিবিড় একটু আশ্বস্ত হয়ে নিজের ডেস্কে ফিরলো। কিন্তু আজ দুই ঘণ্টা ওভার টাইম মানে স্নেহার সাথে দেখা না হওয়া, মনটা খচখচ করতে লাগলো। ওর আগের দুটো প্রেমই সময় দিতে না পারার জন্য ভেঙ্গেছে। স্নেহা অবশ্য একটু আলাদা, ওর ব্যস্ততাটা বোঝে। তবে নিবিড়ও এবার ভীষণ মনোযোগী, অফিসের বাইরে বাকি সময়টা স্নেহাকেই দিতে চেষ্টা করে। ভাবতে ভাবতেই স্নেহার ফোন এলো। নিবিড় কেটে দিয়ে ব্যাক করলো। ‘স্যরি সোনা, আমি কালকে পুরো ছুটি পাইনি, কিন্তু অর্ধবেলার ছুটির জন্য আমাকে আজকে ওভার টাইম করতে হবে, তুমি বাসায় চলে যাও’। স্নেহা শুধু বলল, ‘ও’। আর বেশি কিছু না বলে ফোন কেটে দিল সে। একটু মন খারাপ করেছে স্নেহা; এটা বুঝতে পারলেও নিবিড় কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ওদিকে স্নেহা ভাবল, আজকের দিনটাই বাজে, এই নিয়ে ছয়দিন হল ওদের দেখা নেই। তবে কালকের দিনটা কোনভাবেই বাজে হতে দেয়া যাবে না। নিবিড়কে একটু কড়া করে বলতে হবে ও যেন কোনভাবেই দেরি না করে। কারণ ওদিকে দেরি করলেই এদিকে সময় কমে যাবে আর স্নেহাও নিবিড়কে বেশি সময় কাছে পাবে না। স্নেহাকে যে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতেই হয়।
(তিন)
সোহেল আর পলাশ মিলে নানা পরিকল্পনা করছে কি করা যায়। সোহেলের বয়স দশ, পলাশের নয়। ওরা ধানমন্ডি লেকে কাগজ আর প্লাস্টিক কুড়ায়। দুজনের মা-ই আশেপাশের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে। ওদের এক বান্ধবী আছে, জুঁই । জুঁই এর বয়স পাঁচ বছর, আগামীকাল ছয়ে পড়বে। জুঁই এর জন্মদিন কিভাবে করা যায় তাই নিয়েই দুই বন্ধু ভাবছে। জুঁইকে ওরা দুজনেই খুব ভালোবাসে। জুঁই টোকাই এর কাজ করে না, কিন্তু ওদের সঙ্গেই লেকে ঘুরে বেড়ায়, খেলে। আসলে ওরাই জুঁইকে কাজ করতে দেয় না। জুঁই এর মা সেটা জানলেও মেয়ে এখনো বেশি ছোট বলে তেমন কিছু বলেন না। জুঁইয়ের জন্মদিন পালনের জন্য সোহেল আর পলাশ অনেক দিন থেকেই একটাকা দুটাকা করে জমিয়েছে। সোহেল বলল, ‘জুঁই একবার আমারে কইছিল ওর খুব পেস্টি কেক খাইতে ইচ্ছা করে’। পলাশ বলে, ‘পেস্টি কেকের যেই দাম, ক্যামনে কিনবি’। সোহেল ওর পকেট থেকে পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের একটা টিউব বের করে যার মাথার দিকে সামান্য টুথপেস্ট আছে। দুদিন আগেই সে সেটা কুড়িয়ে পেয়েছে। ওরা ছাই দিয়ে দাঁত মাজে, কিন্তু টুথপেস্ট ওদের তিনজনেরই খুব পছন্দ। সোহেল বলল, ‘তর আর আমার যেই টেকা আছে হেইডা দিয়া এমনি কেক লইয়া আমু, এরপর পেস্ট দিয়া হেইডার উপরে সাজায়া দ্যামু’। শুনে পলাশ বলল, ‘আমারও মনে অয় জুঁই বুঝতেই পারতো না’। বলেই পলাশ হাসল, সাথে সোহেলও। এরপর ওরা দুজন মাটি দিয়ে বেদি বানাতে বসলো। জুঁইকে খুশী করার আরও নানারকম চিন্তা করেছে ওরা।
(চার)
দুপুর বারোটা বাজে।পল্টন থেকে একটি কার্ড কিনে স্নেহা শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে আসলো। গিফট কিনতে না পারলেও নিবিড়কে চমকে দেয়ার প্ল্যান করেছে সে। দশ টাকা পিস ধরে গুণে গুণে তিরিশটি গোলাপ কিনল স্নেহা। নিবিড়ের অবশ্য এবার ২৮তম জন্মদিন। বাকি দুটো ফুল নিজের জন্য কিনেছে। বেশ বেছে বেছে বড় সম্পূর্ণ পাপড়ি খোলা এবং আধখোলা গোলাপ মিলিয়ে নিয়েছে সে। বাসা থেকে শাড়ি পড়ে বেরুতে পারেনি মায়ের সামনে পড়ে যাবার লজ্জায়। আর শাড়ীতে অভ্যস্ত নয় বলে স্বস্তিও লাগে না। তবে খুব সাজগোজ করেছে স্নেহা। হলুদ সবুজ যে জামাটা নিবিড়ের পছন্দ সেটা পরেছে। মিলিয়ে পরেছে টিপ, চুড়ি, কানের দুল। এখন আবার খোলা চুলে ক্লিপ দিয়ে ফুল গুঁজলো। যেন একটা উত্তেজনাময় আনন্দ ওর শরীরে মনে ছেয়ে আছে। এত সাজগোজ করা অবস্থায় বাসে চড়তে ভালো লাগে না। তাই সবসময়ের কমন বাহন বাদ দিয়ে এখন একটা রিকশা নিল স্নেহা। গন্তব্য ধানমন্ডি লেক।
(পাঁচ)
দুটো বাজতে আর আধা ঘণ্টা বাকি। নিবিড় অন্যদিনের চেয়ে বেশ দ্রুত কাজ করেছে আজ । এমনকি বারোটার দিকে চায়ের বিরতিও নেয়নি। সর্বশেষ ফাইলটা হাতে নিতেই সিনিয়র জুলহাস ভাই পড়িমরি করে ওর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আরেকটু হলেই মনিটরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। নিবিড় উঠে দাঁড়ালো, ‘কি হয়েছে জুলহাস ভাই, এমন করছেন কেন’? প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে জুলহাস ভাই বললেন, ‘তোমার ভাবীর লেবার পেইন উঠেছে, বাসায় কেউ নেই, আমাকে এখনই যেতে হবে। আমি রফিক স্যারকে বলেছি, তুমি একটু আমার কাজগুলো দেখো ভাই’। এই বলে নিবিড়ের সিনিয়র কলিগ জুলহাস ভাই হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন। নিবিড়ের মনে মনে ভীষণ একটা গালি আসলো, ‘সালা তোমার বউয়ের আর পেইন ওঠার সময় পেলো না, আর এমন একটা অবস্থায় বউকে একা বাসায় রেখেছ কেন’। এসব ভাবলেও নিবিড় জানে আজকালকার এই ব্যস্ত সময়ে নাগরিক জীবন কত কঠিন, আগের মত অফুরন্ত সময় এখনকার মা-বোনদের নেই। যাক, এমন একটা অবস্থায় বসের কাছে আর ছুটির কথা বলা যায় না। তাই মুখ শক্ত করে নিবিড় আবার কাজে মনোযোগ দিল। সিসিটিভিতে পুরোটাই দেখলেন রফিক সাহেব।
(ছয়)
ধানমন্ডি লেকের একটি ব্রিজের পাশে পাকা বেঞ্চে স্নেহা বসে আছে। ফুলগুলো একটা একটা পাশাপাশি সাজিয়ে পুরো বেঞ্চটাই দখল করে রেখেছে সে। আর প্রতিটা ফুলের জন্য একটা করে বাক্য সাজাচ্ছে মনে মনে। নিবিড়ের হাতে একটা করে দেবে আর বলবে,
“১) আমি হিমালয়ের চূড়ায় তোমার জন্য গোলাপের চাষ করবো।
২)তোমার জন্য চন্দন কাঠের ঘর বানিয়ে সে ঘর গোলাপের ঝাড় দিয়ে মুড়ে দেবো।
৩) তোমার মন কখনো শুকিয়ে গেলে সে মন মরু গোলাপে ভরিয়ে দেব।
৪) রোজ গোলাপের পাপড়ি ভরা জলে তোমার আমার স্নান হবে। ...........................................................................................
………………………………………………………………………………………………
২৬) আমাদের রান্নাঘরে, পড়ার টেবিলে, বিছানার পাশে- আটপৌরে ঘরের সব জায়গায় একটি করে গোলাপ থাকবে।
২৭)প্রতিদিন তোমার লাঞ্চ বক্সের সাথে একটি গোলাপ দিয়ে দেব।
২৮) আমাদের ভালোবাসায় গোলাপের মত কাঁটা থাকবে, তবুও তীব্র আকর্ষণ থাকবে। ভালবাসবো, ভালবাসবো।
রোম্যান্টিক এসব বাক্য ভাবতে ভাবতে কখন যেন সময় কেটে গেল। ঘড়িতে দুটো বেজে কুড়ি। দুপুর সময় বলে খুব বেশি লোকজন নেই।তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু মানুষজন। নিবিড়ের অফিস থেকে এখানে হেঁটে আসতে দশ মিনিট লাগে। ইতিমধ্যে বিশ মিনিট পেরিয়েছে, স্নেহা আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। এরপর নিবিড়কে ফোন দিল।
বাকিটা আগামীকাল-
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




