somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিবনের প্রথমপাঠ

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবার সাথে আমার সম্পর্ক টা অনেক মধুর ছিল। আমার বাবাকে বেশিরভাগ লোকজন আড়ালে টাইগার বলে ডাকতেন তার বদরাগি স্বভাবের কারনে। আমার বাকি ভাই বনেরা সবাই তাকে যমের মতই ভয় পেত। কিন্তু কি এক অজানা কারনে আমাকে উনি কখনই বকাঝকা করতেন না। অথচ আমি ছিলাম ভাই বোনদের মাঝে সবচেয়ে ডানপিটে । মারামারি , ঝগড়াঝাটি , একে তাকে উতাক্ত করা , এর কথা তার কাছে লাগিয়ে দু পক্ষের মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে মজা পাওয়া এই সব কিছুতেই আমার আগ্রহ আর উৎসাহের কমতি ছিল না। তারপরও আমার বাবা তথাকথিত মেধাবী ( সুজগ পেয়ে কিঞ্চিত চাপা মারলাম ) সন্তান ভেবে আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। ভাইয়া আর আপু প্রায়ই ফন্দি ফিকির করত কি ভাবে আমাকে মার খাওয়ান যায় কিত্ত আগেই বলেছি ওদের কোন ষড়যন্ত্রই আমাকে ঘায়েল করতে পারে নি । এভাবেই আস্তে আস্তে একদিন আমি বড় হয়ে গেলাম।

প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমাকে আমার আদরের আব্বু রেখে আসেন, আমি একটু পর পর চোখ মুছতে থাকি যদিও আমি জানতাম সপ্তাহের মাত্র পাচঁ দিন আমাকে হলে থাকতে হবে ছুটির দিনগুলি বাসায় থাকব তাও কোনদিন বাড়ির বাইরে একা একা থাকতে হয়নি সেই প্রথম , নিজের ঘর,ছোট বোন, মা,ভাইয়া,আপু সবাইকে ছেরে একদম অন্নরকম একটা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে প্রথম দিকে অনেক কষ্ট হত।

সেই সময় মোবাইল ফোন বাংলাদেশে আসেনি তাই যখন তখন বাসায় কল করবার সুজগ ছিল না। হলের দুইটা ফোন সবসময় ব্যস্ত থাকত আপুদের প্রেমালাপের জন্য। মাঝে মাঝে আববু অফিস ফিরতি পথে দেখে যেতেন তার দ্যসি মেয়েটাকে। তখন ক্যাম্পাসে বসা জোড়ায় জোড়ায় লোকজন দেখে বলতেন মামনি খবরদার এইসব কোরো না কখনো কেমোন,আমিও বাধ্য মেয়ের মত বলতাম প্রশ্নই উঠে না আববু। ডুবে ডুবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবার আগেই প্রেমের প্রথম পাঠ নিয়ে ফেলেছি সেই কাহিনি তো আর বাবা জানেন না। মনে মনে বলতাম আললাহ তুমি কোনদিন আমাকে ধরা খাওয়ায়ো না আমার টাইগার বাবার কাছে।

একবার হলো কি প্রথম বর্ষে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল প্রোগ্রামে নাটক করলাম সবার ভুয়োসি প্রশংসা, নাটকের সবাই মিলে একদিন পিকনিকে গেলো আমাকে যেতে দেয়া হলনা, আমি যাই নি বলে সবাই সেদিন রাতেই আমার বাসায় বেরাতে আসে, যথারিতী এক গাদা নানা বর্ষের ছেলে মেয়ের মাঝে আমার বাবা , মা আর আমি ড্রইং রুমে বসে বসে গল্প করলাম। আমার দুই পাশে আমার মা বাবাকে বসে থাকতে দেখে ওদের উৎসাহে ভাটা পরলো বেশিক্ষণ বসে আর সময় নষ্ট না করে সবাই কেটে পরল। হাহাহাহাহা..........।:D

এই হলো আমার বাবা । সেদিন আমাদের রাত্রে মামার বৌভাতে যাবার কথা ছিল। আমার দুপুরে প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা।এমন সময় দেখি আমার আববুর গাড়ীরর ড্রাইভার আমার হলে এসে হাযির। আমি উনাকে বললাম আমার তো দুপুরে পরীক্ষা যাব তো রাতে , আপনি আমাকে বিকেলে নিতে আসেন, আববু মনে হয় ভুলে গাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছে। উনি কিছু না বলেই চলে গেলেন। পরীক্ষা শেষ, রুমে এসে অগোছালো বইখাতা গুছাচ্ছি, এমন সময় দেখি আমার রুমে আমার এক খালা আর মামী এসেছেন। আমাকে বললেন চল একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আমি আকাশ থেকে পরলাম । কার জন্য কেন হাসপাতালে যাব ? বললেন তোমার বাবা একটু অসুস্থ তোমাকে হাসপাতালে নিতে এসেছি। আমি বললাম তাই বুঝি ড্রাইভার আন্কল এসেছিল দুপুরে আমাকে নিতে ?উনারা বললেন হা তুমি পরীক্ষা দিতে যাবে বলে তোমাকে আর বলেনি। এখন চলো আমাদের সাথে।


আমি তখনো বুঝিনি আমার জন্য নিয়তি কি লিখে রেখেছে ।আমি পথে যেতে যেতে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছি ,আববু কেন হাসপাতালে, হুট করে কি হলো ? আমাদের তো আজকে মামার বৌভাতে যাওয়ার কথা, দুই দিন আগেও তো ফোনে কথা হল বললেন শালার বিয়েতে অনেক মজা হয়েছে । তবে হাসপাতালে কেন ? হাসপাতালে যেয়ে দেখি আমার সব আত্বীয় স্বজন দাড়িয়ে আছেন ,আমার আমমু কোথা থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন মা তোমার আদরের আববু আর পৃথিবীতে নেই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সবার দিকে। মনে হচ্ছিল বহু দূর থেকে কারা যেন কথা বলছে । আমি ওদের ঠোট নড়তে দেখছি কিন্ত্ত এক ফোটা চোখের পানি ও পরেনি চোখ দিয়ে। দেখলাম আমার বাবার নিথর শরীর ,আমি ফ্যাল ফ্যাল করে দেয়াল পিঠ ঠেকিয়ে ওদের কান্না দেখছিলাম। আমার বড় ভাইবোন কে খবর দেয়া হয়েছে , আর কি কি সব জানি। আমার মনে হচ্ছিল আমি সিনেমা দেখছি। একের পর এক দৃশ্য আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে আমি নিরবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।আমার খালু আমাকে বললেন যেহেতু তোমার ভাইবোন দের জন্য অপেক্ষা করতে হবে লাশটা mortuary তে সংরক্ষন করতে হবে। আমি কয়েকজনের সাথে গাড়ীতে উঠলাম, পিছনে আমার বাবার লাশ বহনকারী ট্রাক। CMH যখন পৌছালাম রাত তখন প্রায় ১২ টা , সব কিছু ব্যবস্হা করে আমাকে ডাকা হলো প্রয়োজনীয় পেপার sign করতে , আজীবন আমি আমার নাম লিখে নিচে c/o আমার আব্বুর নাম লিখেছি সেই প্রথম আমি আমার আব্বুর নাম লিখে তার নিচে c/0 আমার sign দিলাম। তারমানে এই লাশটির অধিকারী আমি। নিজের sign দিতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছিলো , আমি সেই প্রথম চিৎকার করে ডুকরে কেদে উঠলাম , নাকে তুলা দেয়া লাশটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হোল এই সেই আব্বু যাকে আমি আর কোনদিনো আব্বু বলে ডাকতে পারবো না ,যার কোলে বসে আবদার করতে পারবো না, যে আমাকে আম্মুর উপর রাগ করলে জোর করে আর কোনদিনো নলা দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিবে না।


আমার ২০ বছরের জিবনে এত বড় আঘাত আমি সেই প্রথম পেলাম। মনে হলো পুরো পৃথিবী আমাকে এক টানে বড় বানিয়ে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আমার শৈশব ,কৈশর, আমার আবদার , আদর,আহলাদ সব কিছু। সেই থেকে ভুলেও আমি কারো কাছে কিচু চাই না, কোন আবদার করি না। এতটা দিন কেটে গেলো আজো সেই দিনের কথা মনে হলেই আমার চোখ ভিজে যায়। মনে মনে বলি আববু তুমি যেখানেই থাকো না কেনো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১১ সকাল ১১:২০
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন-হাদিস অনুযায়ী তারা পাকিস্তান এবং অন্যরা অন্যদেশ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২১



সূরাঃ ৮ আনফাল, ৬০ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬০। তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে, এছাড়া অন্যদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×