আমার মা’র প্রতি আমি কোনোদিনই অন্যরকম কোন টান অনুভব করি নি। কোনোদিনই তাকে মুখে বলিনি “মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” সবসময় তার প্রতি একটা ক্ষোভ কাজ করত। অনেক ছোটবেলায়, আমার বয়স পাঁচ কী ছয় হবে কিংবা হয়ত আরও কম আমার মা মাসের শুরুতে বাবার সাথে শপিং এ যেতেন। আমাকে অধিকাংশ সময়ই বাসায় রেখে যেতেন বিরক্ত করব বলে; এই ক্ষোভ।
আমার মা আমাকে বাসায় রেখে নানার বাড়িতে যেতেন সেখানে বাগানে লাগানো কয়েক হাজার বনজ-ফলজ গাছের তদারকি করতে; সেই ক্ষোভ।
অসুখ হলে আমার মা কখনো পরম যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি; সেই ক্ষোভ। অসুখ-বিসুখে সবসময় পাশে থাকতেন আমার বাবা। তিনিই জ্বর হলে মাথায় পানি ঢালতেন, জলপট্টি দিতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
ছোটবেলায় বাচ্চাদের কাকে সবচাইতে ভালবাসো জিজ্ঞেস করলে সবাই যেখানে উত্তর দেয় মা, আমি সেখানে উত্তর দিতাম বাবা। পরীক্ষার সময় ভোর রাতে ঘুম থেকে আমি একাই উঠতাম। ফজরের নামাযের পর এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে হাজির হতেন আমার বাবা।
বড় হওয়ার পরও আমার মায়ের হাতে মার খেয়েছি। অথচ আমার বাবা আমাকে শেষ কবে মেরেছেন তা আমার মনেই পড়ে না। এস.এস.সি পরীক্ষা দেওয়ার পরও একবার কী একটা বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করায় রান্না করতে করতে হাতের গরম ছুন্নি আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন আমার মা।
আমার মা অনেক রাগী। সামান্য কিছু হলে ব্যপারটা না বুঝেই চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তোলেন। বাবা ঠিক উল্টোটা করেন।
মা’কে এস.এস.সি’তে পাওয়া বোর্ড বৃত্তির টাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিয়েছিলাম। ঈদের দিন সেই শাড়ী পড়ে আমার মা পাশের বাসার আন্টির কাছে গর্ব করে বলেছিলেন, “আমার ছেলে বৃত্তির টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছে।” এইচ.এস.সি’তে পাওয়া বোর্ড বৃত্তির টাকা দিয়ে গতবার চাঁদনী চক থেকে মা’র জন্য থ্রি-পিস কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা’কে বলেছিলাম,”তুমি তো ফর্সা তাই সবুজ রঙ তোমাকে ভালোই মানাবে”। আমার মা আজও সেই থ্রি-পিসের জামা তৈরী করেন নি, সযত্নে তুলে রেখেছেন আলমারিতে।
কিছুদিন ধরেই ব্যক্তিগত কারণে মনটা একটু খারাপ। সেদিন মা ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কেমন আছি। ভালো না জবাব দিতেই মা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন আমি কাল সকালের বাসেই আসছি ।অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করি। আজও মনটা অনেক খারাপ ছিল। রাত দু’টোর দিকে চা-সিগারেট খেতে গিয়েছিলাম রাস্তার পাশের দোকানে। একমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম ও সমস্যার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল মা’র কথা। আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার মন সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গিয়েছে। জীবনে প্রথম বারের মত হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে অনুভব করলাম আমি আমার মা’কে অসম্ভব ভালবাসি।
কুড়ি বছরের জীবনে আমি আমার মা’কে কখনও ভালবাসার কথা বলতে পারিনি, ভবিষ্যতেও হয়ত বলতে পারব না। তাই এই উপলব্ধিটুকুকে বন্দী করে রাখার প্রয়াসে এই পোস্ট। থাক না এই উপলব্ধিটুকু আমার সাথেই, মন্দ কী ?
পুনশ্চঃ এই পোস্টটি আমার মা’কে উৎসর্গ করলাম।
ধ্রুবমেঘ
৩০ মে, রাত ০৩.৩৫ মিনিট
গাজীপুর।