somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাদাত হোসাইন
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

বোধ (২)

২০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২.
বৃষ্টিটা কমে এসেছে।

কিন্তু দখিনা বাতাসে হু হু করে বাড়ছে নদীর পানি। সেই পানি নদী উপচে ভাসিয়ে দিয়েছে খাল, বিল, মাঠ, ফসলের জমি। পানির উপর ভেসে আছে সবুজ ধানের কচি ডগা। উঁচু রাস্তাও ডুবি ডুবি। ডুবে গেছে উঠোনের অর্ধেক। সেই পানিতে টুপটাপ লাফিয়ে ওঠে খলসে পুঁটির দল। আমাদের ছনের ঘরখানার করুণ দশা। কিন্তু বাবা মা ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। সমস্যা যত আমাকে নিয়ে। এই স্যাঁতসেঁতে ভেজা ঘরে আমার মন বসে না। আমি চুপি চুপি বড় চাচাদের ঘরে চলে যাই। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেতে না পারলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকি আর গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদি।

সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বড় চাচা তার লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে দাঁড়ালেন আমাদের ঘরের সামনে।

তারপর বাবাকে ডাকলেন, ‘মকবুল, মকবুল।’

বাবা তখন চৌকির উপর বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। তড়িঘড়ি করে বিড়িখানায় শেষ টান দিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলেন বাইরে। তারপর এসে দাঁড়ালেন বড় চাচার সামনে।

বাবার পাশ দিয়ে উঁকি দেয়া ভাঙা বেড়ার দিকে আঙুল তুলে বড় চাচা বললেন, ‘তোর গোয়ার্তুমি কি এই জনমে কমবো না? এই ঘরে তুই ওই রোগা বউ আর এট্টুক পোলাডারে লইয়া থাকস কোন সাহসে? ওগো কি মাইরা ফেলতে চাস?’

বাবা কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মোছেন। তারপর ভাঙা বেড়ার দিকে মাথা ঘুড়িয়ে তাকান। আবার মুখ ফেরান। কিন্তু কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন।

‘কি, কথা কস না কেন? কিছু একটা ক। এমনে মুখে কুলুপ আইটা কয়দিন থাকবি?’ বাবা এবারো চুপ করে থাকেন। কথা বলেন না। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন।

বড় চাচার যেন এবার বাঁধ ভাঙে। তিনি চেঁচান, ‘জীবনে কোনদিন একটা কথাও হুনছোস? হুনোছ নাই। যেইডা কইছি হেইডার উল্টাটা করছোস। এইজন্যইতো আইজ এই দূর্দশা।’ একটু থামেন বড় চাচা। তারপর বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান বড় চাচার কালো গাইটার সামনে। ‘দ্যাখ, গাইডারে দ্যাখ।’ বড় চাচা কালুর পেটে হাত বুলান। পেটের আকার বিশাল। আজ-কালের মধ্যেই বিয়োবে কালু।

‘এই একটা গাই, অবলা প্রাণী, এই প্রাণীডা আমারে কোনদিন ঠকায় নাই।’ বড় চাচা থামেন। থুক্ করে একদলা থুথু ফেলেন ভেজা মাটিতে। তারপর ঘুরে দাঁড়ান, ‘অবলা এই প্রাণীগুলা কাউরে ঠকায় না। অরা সব বোঝে, সব।’

বড় চাচা আমার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলেন, বাবা যখন মারা যায়, ওই অর চেয়ে একটু বড় আছিলাম আমি। এক ফোডা জমি-জিরাতও আছিলো না। এক বেলা খাওনের আছিলো না। তুই তহন মা’র পেডে। বড় মামায় আমারে একটা লাল বাছুর দিয়া কইছিলো, এইডা হইলো লক্ষ্মী। এই লক্ষ্মী দেইখা শুইনা রাখিস। আমি আমার সারা জীবন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। হেই বাছুর থেইকা আমার কতগুলা গাই বাছুর যে হইছে! তোরে এতো কইরা কইলাম, আথালের গাইডা বেঁচিস না। ঘরের লক্ষ্মী। তুই গাভীন (গর্ভবতী) গাইডা টেকার লোভে হারু কসাইয়ের কাছে বেচলি! কেমনে বেচলি? হারু কসাইতো মানুষ না। ও আসলেই একটা কসাই। কিন্না (কিনে) নিয়া গাভীন গাইডার ঠিক মতো যত্ন-আত্মি করে নাই, রাখছে ভিজা চুপচুইপা ঘরে। একটার পর একটা রোগ হইছে গাইডার। শেষমেশ গাইডা যদি মইরা যায় হেই ডরে কাউরে কিছু না জানাইয়া গাইডারে জবাই দিয়া গঞ্জে গোসত বেচছে! গাভীন গাই। গাইডার পেডের মইধ্যে আরেকটা জান আছিলো! অবলা গাইডা কোন কথা কইতে পারে নাই। আল্লাহ! ওহ আল্লাহ!’

বড় চাচার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। হাতের আঙুল মুঠো পাকিয়ে যায়। পাথরের মতো শক্ত চোখেও জল ছল ছল করে, ‘আল্লাহ কেমনে সইবো!, আল্লাহ তুমি মাফ করো। মাফ করো ইয়া মাবুদ।’ বাবা এখনও চুপ করে আছেন। পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ভেজা মাটিতে বুড়ো আঙুল দিয়ে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন। এক পা সামনে এগিয়ে বাবার একদম মুখোমুখি দাঁড়ান বড় চাচা। তারপর আবার বলেন, ‘তুই এই ঘরে থাকবি থাক। তোর বউডারে এই ক্যাদা-বিষ্টিতে মারবি মার। কিন্তু আনু এই বংশের রক্ত। অরে আমি এই ভেজা ঘরে এই বিষ্টি বাদলায় থাকতে দিমুনা।’

বড় চাচাকে আমি পছন্দ করি, খুব খুব পছন্দ করি। কিন্তু বাবাকে যখন বড় চাচা বকেন তখন আমার খারাপ লাগে। বড় চাচাকে মনে হচ্ছিলো একটা খারাপ মানুষ। আর বাবা কি অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন! কিন্তু বড় চাচা যখন বললেন যে তিনি চান না আমি এই ঘরে থাকি তখন মুহূর্তেই আমার মনে হলো, জগতে বড় চাচার মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই। যত ইচ্ছা বকুক বাবাকে। বাবাতো আমাকে ওই ঘরে যেতে দিতেই চায় না। মা-ও না।

কিন্তু আমাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বললেন, ‘আনু, তোর বালিশ আর জামা-কাপুড় লইয়া ওই ঘরে যা। বাইস্যাকালের (বর্ষাকাল) কয়ডাদিন ওই ঘরেই থাক।’
আমি আর বড় চাচা, দুজনই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি।

বড় চাচা বাবাকে আর কিছু বলেন না। তিনি আমার দিকে তাকান। তারপর দরজার সামনে দড়িতে শুকাতে দেয়া আমার কোঁচকানো হাফপ্যান্ট আর শার্টখানা আমার দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলেন, ‘নে, জামা-কাপুড় লইয়া আয়। কাইল বেয়ান বেয়ান উঠতে হইবো। তোর শফিক ভাই আইবো ঢাকারতন। নাও লইয়া হেরে গঞ্জে আনতে যাওন লাগবো। তুই যাবি আমার লগে।’

বড় চাচা কথাগুলো আমাকে বললেও উদ্দেশ্য ছিলো মূলত বাবা। কিন্তু বাবা কোন উত্তর দেন না। তিনি গভীর মনোযোগে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেজা মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন।

আঁকতেই থাকেন।
(চলবে)
'বোধ' গল্পের এটি দ্বিতীয় অংশ,বাকী অংশগুলো পড়তে ক্লিক করুনঃ

প্রথম অংশঃ
Click This Link
তৃতীয় অংশঃ
Click This Link
শেষ অংশঃ
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:৫২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×