somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাদাত হোসাইন
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

থুঃ মানুষ

২১ শে মে, ২০১৪ সকাল ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাজারে গেছি, পকেটে ৫ টাকার নোট।
সেকালে ৫ টাকার নোট পকেটে নিয়ে ভাগ দেয়া পুঁটি মাছের বাজারে ঘোরা যেত, মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেসও করা যেত, 'পুঁটি মাছের ভাগা কত?'
মাছওয়ালা উদাস নয়নে আকাশ দেখতে দেখতে বলতো, 'বড় ভাগা ১০ টেকা, ছোড ভাগা ৫ টেকা'।

৫ টাকায় এক ভাগ পুঁটি মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরাযেত। সেই মাছ কুটতে গিয়ে বের হত আসল কাহিনী। মাছ মোটামুটি পচে কাদা, পেটের ভেতর চাপ দিতেই নাড়ি ভূরি বের হয়ে আসে। এই মাছ খাওয়া অসম্ভব। রান্না করাতো বটেই! আম্মা অবশ্য উপায় বের করে ফেলতেন। খাঁটি সরিষার তেলে সেই নরম তুলতুলে, প্রায় পচা পুঁটীমাছ, কড়কড়ে করে ভেঁজে ফেলতেন! খেতে বসে দেখতাম, কোথায় গন্ধ কিসের কি? আমরা ভাতের থালার একপাশে কড়কড়ে ভাঁজা পুঁটিমাছ নিয়ে খেতে বসতাম।

আহা, সে কি স্বাদ! পোড়া পোড়া করে, কড়া ভাঁজা পুঁটীমাছ যারা নিজের জিভে একবার হলেও চেখে দেখেছেন, তারামাত্রই বলতে পারবেন সেই স্বাদের কথা।


দুপুরে ইশকুল থেকে ফিরেছি, পেটের ভেতর রাজ্যের খিদে। এসে দেখি ভাত রান্না হয় নি। বাড়ি মাথায় তুলে চেঁচানোর আগেই আম্মা একমুঠো চাল নিয়ে চুলার ধারে বসে পড়লেন। খানিক লবণের ছিটা দিয়ে সেই চাল ভেঁজে দিলেন। বেতের বাটিতে গরম চাল ভাঁজা নিয়ে আমি বসে গেলাম ঘরের দাওয়ায়। দুই কোয়া রসুনের সাথে সেই চাল ভাঁজার কামড়ে কামড়ে অমৃতের স্বাদ।

শ্রেফ অমৃতের স্বাদ!


কুরবানীর ঈদে আম্মা মাংস কাঁটাকুটির কাজ করতে পারেন না। আম্মার হাতে প্রবল বাতের ব্যথা। কাজ করি আমরা তিনজন। আমি, আব্বা আর আমার ছোট ভাই জামান। মাংস কাটাকুটি থেকে রান্না অবধি। অবশ্যই নেতৃত্বে থাকেন আব্বা। সেবার একটা তাওয়ার ভেতর তেল ঢেলে থইথই করে ফেললেন আব্বা। গনগনে চুলার আছে টগবগ করে ফুটছে তেল। আব্বা সেই তেলে চাকা চাকা করে কাঁটা গরুর মাংসের টুকরো ফেলে দিলেন। হলুদ মরিচ লবণ মাখানো গরুর মাংস। যতক্ষণে তাওয়া থেকে মাংস তোলা হল, ততক্ষণে মাংস হয়ে গেছে কড়কড়ে ভাঁজা।
আহা, এর কামড়ে কামড়েও অমৃতের স্বাদ।


সেদ্ধ মিষ্টি আলু যারা খেয়েছেন, তাদের জীবনের বারো আনাই মিছে। বাজী ধরে বলতে পারি। মিষ্টি আলু খেতে হয় চুলার গনগনে আগুনে পুড়িয়ে, গরম খোসা ছাড়িয়ে সেই আধপোড়া মিষ্টি আলু যখন মুখে পুড়বেন, জিহ্বার বাদ বাকী স্বাদ বিস্বাদ হতে বাধ্য!

আমাদের কালে আমরা চুলার আগুনে পুড়িয়ে আরও একটা জিনিস খেতাম। সেটা হল বিচি কলা। আমাদের গ্রামের ভাষায় ‘আইঠঠা কেলা’। এই ‘আইঠঠা কেলা’ যারা পুড়িয়ে খান নি, তাদের জীবন স্বাদহীন, গন্ধহীন ছাইয়ের মতন পুড়ে ছারখার!


২০১২ এর ডিসেম্বর ৩১।
থার্টি ফার্স্ট নাইট। নেত্রকোনার তৎকালীন সংসদ সদস্যের আমন্ত্রণে বিরিসিরিতে গেছি একদল তরুণ সাংবাদিকের সাথে। সেই সাংসদ অতিথিদের আপ্যায়নের ভালো ব্যবস্থা করেছেন। যার একটা ছিল রাত বারোটায় মুরগী আর খাসির বারবিকিউ। আমার যে খাবার হিসেবে ভাঁজা পোড়া খুবই পছন্দের, আশা করি তা এতক্ষনে অনেকেই বুঝে গেছেন। বারবিকিউ মুরগীর রানগুলো মনে আয়েশে চিবুলাম। আহ! সেই স্বাদ জিহ্বায় লেগে থাকার কথা ছিল। কিন্তু লাগলো না খাসির বারবিকিউ দেখে। একটা আস্ত খাসির ভেতর লোহার শিক গলিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই খাসি গনগনে আগুনের আঁচে ঝলসানো হচ্ছে। আমরা তার শরীর থেকে টুকরো টুকরো মাংস খাবলে নিচ্ছি। তারপর আয়েশ করে চিবুচ্ছি।

খাসীটা হয়তো মানুষ নয়, তাই!

সেই খাসির দিকে আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। হয়তো এই তাকিয়ে না থাকতে পারার পেছনে যৌক্তিক কোন কারণ নেই। হয়তো আমার হার্ট দুর্বল। আমি ভীতু। ভীতু আমি ধীরে ধীরে চলে গেলাম রুমে।

তাও নিজেকে শান্তনা দিয়েছিলাম, খাসীটা অন্তত জবাই করার পর আগুনে ঝলসানো হয়েছিল। আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সেদিনের পর থেকে, ভাঁজা পোড়ার প্রতি কেমন এক অনাগ্রহ তৈরি হল। ভাঁজা পোড়া কিছু খেতে গেলেই সেই খাসির বারবিকিউ’র কথা মনে পড়ে।

তবে সেই বারবিকিউ খাসীটা আজ আমাকে মুক্তি দিয়েছে, সে আমার চোখের সামনে আর কখনও ভেসে উঠবে না। ভেসে উঠবে, আজ সকাল ১১ টায় ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামুল হকের বারবিকিউ শরীর। (ছবিটা কেউ দেখেছিন কি না জানি না, আমি দেখেছি!) আগুনে ঝলসানো শরীর। আগুনে পোড়া শরীর। একটা মানব শরীর। হ্যা, একটা মানব শরীর। কিছু মানুষ মিলে বারবিকিউ বানিয়েছে!!

ভাগ্যিস, খাসীরা মানুষ নয়, ওরা ওদের নিজেদের আগুনে ঝলসে বারবিকিউ করে না। আমরা করি, কারণ আমরা মানুষ! হয়তো কোন একদিন ওই আগুনে ঝলসানো মাংস আমরা খেতেও পারবো, ভাঁজা মাংস, পোড়া মাংস।

মানুষের মাংস!
জবাই করা খাসির বারবিকিউ না, জীবন্ত মানুষের বারবিকিউ!
কারণ, আমরা মানুষ!!
থুঃ মানুষ!!!
-----------------------------------------------------
থুঃ মানুষ/ সাদাত হোসাইন
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×